গত ফেব্রুয়ারিতে ব্রহ্মপুত্র নদের সৌন্দর্যের চিত্র তুলে ধরে একটি পোস্ট দিয়েছিলাম। নাম ছিলো আমাদের ব্রহ্মপুত্র–ঐশ্বর্যে অনন্য, এখনও। সে সময় কোনো কোনো সুহৃদ এ নদের ভবিষ্যত অস্তিত্ব নিয়ে শঙ্কার কথা জানিয়েছিলেন। এটা তো ঠিকই যে, নদ-নদী নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া অবধি সব সময়েই কিছু না কিছু সুন্দর ধরে রাখে। সেই সুন্দরকে দেখার চোখ যাদের আছে তাদের অবদান সাধারণত উচ্চারণেই সার; কাজে গড়ানোর ক্ষমতা কই? তাই মুগ্ধতার সাথে ঝুলন্ত কষ্টের নাম ‘মায়া’ হয়। তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজর মাগি। কিন্তু নদের বুকে কুনজর যাদের, তাদের মনে সেই মায়া হয় না। সত্যিটা হলো, কুমির তার শিকার গিলতে গিয়ে শিকারের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না কখনও। লালসা আর নান্দনিকতা সাইড বাই সাইড চলে না। তবুও ব্রহ্মপুত্রকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে ‘কার্যকর ভূমিকা’ বরাবরই খুব খুব মিস করি।

স্যাটেলাইট ছবিতে ব্রহ্মপুত্রের জন্মস্থান
অপরিকল্পিতভাবে বালু উত্তোলন, জল আটকে দিয়ে মাছ ধরা, ভয়ানক মাত্রার দূষণ আর সময়মতো ড্রেজিং না করা অন্যান্য বিপন্ন নদ-নদীর মতো ব্রহ্মপুত্রের জন্যও কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতো প্রাচুর্যে ভরা প্রাকৃতিক এসব জলের আধার পরিচর্যায় বিন্দুমাত্র ইচ্ছেও যখন থাকে না, তখন ক্রমশ বিলুপ্তপ্রায় কোনো নদের শীর্ণ জলের রেখায় সুন্দরকে দেখে সুখ পাওয়া মানুষের সুস্থতাও প্রশ্নবিদ্ধ হয় হয়তো। এই শুষ্ক মৌসুমে ময়মনসিংহে এই নদটির বিবর্ণ চেহারা দেখে কারও বুঝতে অসুবিধা হবে না, কী বিশাল পরিমাণ পলির বোঝা এর বুকের উপর পাথর হয়ে পানির সহজ প্রবাহের অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে।

ছবি ১- ব্রহ্মপুত্র, ময়মনসিংহ
এখানে ব্রহ্মপুত্রের যে তিনটি ছবি দেখা যাচ্ছে তার প্রথম ও দ্বিতীয়টি কয়েকদিন আগের; নদের ঠিক বুকের উপর, যেখানে এখন সদ্য জেগে ওঠা বিশাল চর, হাঁটাহাঁটি করছে মানুষ অনায়াসে। তৃতীয় ছবিটি গত বছর মার্চের। স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে, তখনও মাঝ নদের পানির ধারা বেশ চওড়াই ছিলো। এই এক বছরেই কতো বদলে গেছে নদের চেহারা! নদের তীরবর্তী উদ্যানে বেড়াতে আসা মানুষজন এখন উদ্যান ছেড়ে নদীতে গিয়ে দৌড়ায়, ব্যয়াম করে, বসে বসে চিপ্স খায়, বাদাম খায়, ক্রিকেট খেলে। নৌকাওয়ালারা বেকার। স্থানীয় মাঝিদের সাথে কথা বলে জানা গেলো, এবারের মতো এতো খারাপ অবস্থা তারা গত বছর বা তার আগের কোনো বছর দেখেননি। এ অঞ্চলের মানুষ যাঁরা ব্রহ্মপুত্রের ভরা যৌবন দেখেছেন, তাঁরা জানেন, এক সময় সুন্দরের কী এক উদার জলদ ভাণ্ডার ছিলো এই নদ। চৈত্র-বৈশাখেও বেশ থৈ-থৈই করতো। বছরের এ সময়েও প্রচুর মাছ পাওয়া যেতো। ময়মনসিংহ, শেরপুর, জামালপুরের বহু মানুষের জীবিকার উৎস ছিলো এ নদ। এসব অঞ্চলের মানুষের নিত্যদিনের প্রোটিনের চাহিদা মেটাতো এ নদের বুকে বেড়ে ওঠা বিবিধ প্রজাতির মাছ।

ছবি ২- ব্রহ্মপুত্র, ময়মনসিংহ
নাড়ীর খোঁজ নিতে গিয়ে জানা গেল, নদটি হিমালয়ের মানস সরবর থেকে চীন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে প্রবেশ করে। পরবর্তীতে এটি যমুনা নাম ধারণ করে নদের প্রধান অংশ জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ হয়ে চলে যায় এবং জামালপুরের ইসলামপুর ও দেওয়ানগঞ্জ হয়ে এই নদের বাকি অংশ শেরপুর-জামালপুর সীমারেখা দিয়ে প্রবহমান হয়ে এই নদ ময়মনসিংহ হয়ে পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নাম ধারণ করে। দীর্ঘ এ পথে ভারত ও চীনে অসংখ্য বাঁধ থাকায় এবং বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে চর জেগে ওঠার কারণে নদটি ধীরে ধীরে ভরাট হয়ে যাচ্ছে।

ছবি ৩- ব্রহ্মপুত্র, ময়মনসিংহ
ব্রহ্মপুত্র নদ ময়মনসিংহ শহরের সৌন্দর্য ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এই নদ শুকিয়ে মরে গেলে হয়তো এখানে শপিংমল বানানো যাবে, বড় বড় এ্যাপার্টম্যান্ট কিংবা থিম পার্ক প্রতিষ্ঠা করা যাবে। কিন্তু দেশের গুরুত্বপূর্ণ এই স্রোতের সম্রাট, শহরবাসীর প্রাণের এই নদ যে অভূতপূর্ব স্নিগ্ধতা আর ভালোবাসায় জড়িয়ে রেখেছে যাপনের ধারাপাত, চৌকাঠ এখনও– তার ঘাটতি পূরণ হবার নয়। মানুষ কিংবা জন্তু-জানোয়ার হত্যার দায় হয়তো বেশিদিন ঝুলে থাকে না। কিন্তু নদ-নদী হত্যার খেসারত বহু বছর ধরে দিতে হয় বলেই বিশ্বাস হয়। তাই বেঁচে থাকা মানুষের জন্য, অনাগত প্রজন্মের জন্য অবিলম্বে এই নদে ড্রেজিং-এর ব্যবস্থা করে এর প্রবাহ নির্বিঘ্ন করা উচিত। ব্রহ্মপুত্রের সর্বনাশ হলে আমাদের পৌষ মাস নয় নিশ্চয়ই।
.
কৈলাশ পর্বতের ছবিটি উইকিপিডিয়া থেকে নেয়া
ফারদিন ফেরদৌস বলেছেনঃ
হায় রুপসী ব্রহ্মপুত্র, আবার কবে ফিরবে তোমার সেই মনোলোভা রূপ? কবে আবার বাজবে তোমার অবাধ জলের কলকল সুরলহরী?
তোমাকে চাই আমি আগের মতোন। তোমাকে আপনরূপে ফিরতেই হবে এই বাংলায়। আমার নদী বন্দনা সমর্পিত হলো কাজী শহীদ শওকত ভাইয়ের এই উপযোগী নিবন্ধের করকমলে। নদনদী বাঁচুক, আমরাও বাঁচি। ধন্যবাদ শওকত ভাই।
কাজী শহীদ শওকত বলেছেনঃ
আপনার এই উচ্চারণের সাথে আমারও সজোর স্বর। অনেক ধন্যবাদ, ভাই।
তানজির খান বলেছেনঃ
প্রাকৃতি এখন হুমকির মুখে। ধীরে ধীরে মরে যাচ্ছে সব নদী,নালা,খাল,বিল। আশাকরি এই লেখাটি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরে পড়বে।
ধন্যবাদ আপনাকে
কাজী শহীদ শওকত বলেছেনঃ
আপনাকেও অনেক ধ্যবাদ, তানজির ভাই।
মজিবর রহমান বলেছেনঃ
দেশে আজ জানোয়ারে ভরপুর।
কে করবে কারো কাছে নায় কোন আবদার?
চারিদিকে শুধু হাহাকার আর হাহাকার
বিচারের বানী কান্দে নিরবে
নাই কারো মুখে হাসি।
মানুষই বিচার পায়না। প্রকৃতি কিভাবে বিচার পাবে?
সুন্দর পোস্টের জন্য ধন্যবাদ।
কাজী শহীদ শওকত বলেছেনঃ
তবু আকুতি জানাই, নদ-নদী রক্ষায় সরকারি মনযোগ কাজে গড়াক। মজিবর ভাই, আপনার জন্য অনেক অনেক শুভ কামনা। ভালো থকবেন।
মজিবর রহমান বলেছেনঃ
সরি আন্দার নয় হবে আবদার। শওকত ভাই।
নিতাই বাবু বলেছেনঃ
আমাদের নারায়ণগঞ্জের শীতলক্ষ্মা নদীর চেয়েও ভয়াবহ রূপ৷ দনী মাতৃক দেশ এখন শুধু মুখে-মুখে, অন্তরে নাই একথার বিন্দুমাত্র বিশুদ্ধতা৷ ড্রেজার সংস্থা নামক একটা সংস্থান আছে ঠিক,কোন কাজে নাই, শুধু’ই সংস্থা৷ ধন্যবাদ দাদা ভালো থাকবেন ৷
নিতাই বাবু বলেছেনঃ
ভুল বশতঃ (দনী) হবে নদী ৷ শোধরে নিবেন৷
কাজী শহীদ শওকত বলেছেনঃ
হ্যাঁ, দাদা, আপনার ‘শীতলক্ষ্যা নদীর মরণ ব্যাধি‘ শিরোনামের লেখাটি পড়ে নদীটির বুকে দূষণের ভয়াবহতা সম্পর্কে জেনেছি। একমাত্র সরকারের সদিচ্ছাই দেশের নদীগুলোকে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচাতে পারে। সেটি না হলে ‘বাঙালির দাঁত’ বিষয়ক বিখ্যাত প্রবাদটির মতো আমাদের নদ-নদীর মর্যাদা বুঝতে হলে সেগুলোর বিলুপ্তি সম্পন্ন হতে হবে।
সগীর হোসাইন খান বলেছেনঃ
ময়মনসিংহ আমার নানা বাড়ি। ছোট বেলায় কত এই নদীতে বাবার সাথে ঘুড়েছি। এখন দেখলে কান্না পায়। এখন পানি কম চর বেশী দেখা যায়।
লেখাটার জন্য ধন্যবাদ।
কাজী শহীদ শওকত বলেছেনঃ
ঠিকই বলেছেন, ভাই। নদের অবস্থা খুব খারাপ।
আরজু পনি বলেছেনঃ
মায়ের পরে ভালোবাসায় যার কাছে ফিরে যাই সে আমার প্রাণের ব্রহ্মপুত্র। এমন করুণ অবস্থা মেনে নেয়া সত্যিই কষ্টকর!
নদের তীরবর্তী উদ্যানে বেড়াতে আসা মানুষজন এখন উদ্যান ছেড়ে নদীতে গিয়ে দৌড়ায়, ব্যয়াম করে, বসে বসে চিপ্স খায়, বাদাম খায়, ক্রিকেট খেলে। নৌকাওয়ালারা বেকার। …কতো ভয়ঙ্কর কষ্টের কথা !
আশা করছি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এব্যাপারে সুনজর দিবেন ।
পোস্টটি শেয়ার করার জন্যে অনেক ধন্যবাদ রইল।