কতো লাল দোল খায় পাতাদের ভাঁজে আজ!

কাজী শহীদ শওকত
Published : 9 May 2016, 06:09 AM
Updated : 9 May 2016, 06:09 AM

ময়মনসিংহে কৃষ্ণচূড়ার লাল এবার ফুটেছে ভীষণ। কৃষ্ণচূড়া উরফে গোলমহর গাছ। শহরের জয়নুল আবেদীন পার্কে আছে সাত কি দশটি। এর বাইরেও, নদের ধারে এবং বিভিন্ন লোকেসনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে আরও অনেক। টাউন হল মোড়ে, জুবলি ঘাটে বুড়া পীরের মাজারে ও কাচারি ঘাটের গাছগুলো পুরনো কিন্তু এখনও টকবগে তরুণ।  সবুজ-লালের হৈচৈ বাঁধিয়ে দিয়েছে এবারও। তামাগলা সূর্যের দুপুর কিংবা বিকেলে স্বাস্থ্যবান কৃষ্ণচূড়ার ছায়া ঠিক বাঁশ ঝাড়ের ছায়ার মতো নিবিড়। শীতল। শান্তিময়।

টিএ্যন্ডটি কলোনির ভেতর যে চারটি কৃষ্ণচূড়া গাছ ছিলো, ওদের একটি সেদিনের ঝড়ে মারা পড়েছে। বাকি তিনটি দাঁড়িয়ে আছে ঠিকই, কিন্তু সদ্য মৃত প্রতিবেশীর কষ্টেই কি না কে জানে, ওদের লাল এখন খসে গেছে অনেকটাই। তাই এই আগুন বৈশাখে এসব প্রাকৃতিক লালের উৎসব দেখতে হলে আপনাকে যেতে হবে অন্যদের কাছে।

এদের মধ্যে কাচারি ঘাটে, নদের ধারেই যে গাছটা –ওটাকে সবচে হ্যান্ডসাম লাগলো। পাতার সবুজ চিরল চিরল; ঘন হয়ে একটার পরে আরেকটা বসে বসে সূর্যকে ঠেকিয়ে দিয়েছে— আকাশের ঈষৎ নীলের নিচে পতাকার দুই রঙ সামিয়ানা যেনো। গাছের তলায় এসে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালে মনে হবে এ যেনো গাছ নয়; বিশাল সবুজ ছাতা।

বিকেলে ওই ছায়াতে দাঁড়াতেই গ্রামের বাঁশ ঝাড়ের কথা মনে পড়লো। বাড়ির ওঠোনের কোণ ঘেঁষে এখনো দুটো ঝাড় আছে। ঘন ছায়ার ঝাড়। তার নিচেই টিউবওয়েলটা। ঠাণ্ডা পানির ওই স্বাদ এ শহরে অসমানি মিঠাই। তারপরও কাচারি ঘাটের কৃষ্ণচূড়াটার তলে একটা টিউবওয়েল থাকলে ভালোই হতো।

সূর্যাস্তের সময় কৃষ্ণচূড়া কেমন দেখায় জানা নেই। তবে অনেক দিন আগে একবার এক গ্রামের রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময়, ঝাঁশ ঝাড়ে সন্ধ্যা নামতে দেখা গিয়েছিলো। বিস্ময় ঠেকানো যায়নি—এটা বেশ মনে আছে। এতো পাখির এতো কলরব এই কান কোনো দিন আর শোনেনি। এখানে অবশ্য পার্কের গাছে দুয়েকটা পাখি কখনও কখনও দিন-দুপুরে দু-চার মিনিট বসে; কিন্তু সন্ধ্যায় কোথায় যেনো উড়ে যায়। কেনো উড়ে যায়, এখানে থেকে গেলে কী এমন হয়–এ ব্যাপারে পাখিরা মুখ না খুললেও বোঝা যায়, নগরের উদ্যানে ওদের ডর বেশি।

বাতাসে পার্কের বেঞ্চিতে, রাস্তায় কৃষ্ণচূড়া খসে পড়ছে। কেউ কেউ ফুঁ দিয়ে সরিয়ে বসছে। লুটানো লালের ফুলেল বিস্তার দেখতে বেশ লাগে। কী অদ্ভুত সুন্দর! এই লালে রক্তের রঙ কেমন করে মিশে আছে, সেটা নিশ্চয়ই অবাঙালির বোঝার কথা নয়। তাই বলছি, বাঙালির কাছে কৃষ্ণচূড়ার আরেক নাম বিষাদ কুসুম হলে ক্ষতি কী?

বুকের রক্তেই নয় শুধু, ওই লাল মিশে আছে প্রাণীর জন্মের প্রতিটি সূচনায়। জঠরে জঠরে। জঠর শব্দটি মনে হতেই এক কবিতার কয়েকটি লাইন মনে ধরলো,

মায়ের জঠরে এক পুষ্পগোপনতা
যখন ঝরতে থাকে গন্ধের বৃষ্টিতে
………..ভিজে যায় অনঙ্গ সংসার।
তবু মর্মপাথরের বিষণ্ন কঙ্কাল
অন্ধ জাতকের মতো ছুঁড়ে দিলে
তিনিও ভিজেন, যেন কান্নাশকুনের
শাণিত ঠোঁটের পাশে বেদনার সাদা দুধ জমা হলে
আমি এক স্তন্যঘেরা বিবর্ণ সন্তান-
………..ফুলমোহনার ঘাসে ঘাসে
তাকে শুধু মাড়িয়ে গেলাম।

আমরা হয়তো বাতাবি অথবা জাম্বুরার সবুজ, নয়তো আকৃতি দেখি। গোল তরমুজের জুস খুঁজি কালো বীজ খুঁটে খুঁটে। ওসবে প্রেম থাকে, কাম থাকে; রঙ তো নিশ্চয়ই থাকে। আশঙ্কায়, আশাবাদে আর দৈনিক চর্চায় ওগুলো সাধারণ হয়ে থাকে। এমনকি ঠোঁটের লালেও লেপ্টানোর সাধারণ ভয় থাকে। কিন্তু কৃষ্ণচূড়ার লালটা অন্যরকম। একদম অন্যরকম। অসাধারণ। রক্ত ছাড়া আর কিছুর সাথে তেমন যায় না।

কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া গাছ বেশ অপুষ্টিতে আছে বলে মনে হলো। ফুল নেই তেমন। শরীর লিকলিকে। ফুলের সাথে পাতারাও ঝুরঝুর করে পড়ে যাছে। এ গাছগুলোর যত্ন নিতে দেখা যায় না। সংসদ ভবনের আশেপাশে কিংবা হাতিরঝিলের কৃষ্ণচূড়া গাছগুলোর ভাগ্য ভালো। কিন্তু দেশের সব অঞ্চলেই যদি এসব গাছের জন্য কিঞ্চিত কেয়ার নেয়ার ব্যবস্থা করা যেতো, কতোই না ভালো হতো! আমাদের প্রেমে, সংগ্রামে এমন ভাবে আর কোনো গাছ জড়িয়ে আছে বলে জানা নেই।

একটু আগেই জানলাম, 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা''র আয়োজন চলছে চন্দ্রিমা উদ্যানে। ভীষণ ভালো উদ্যোগ। কাছাকাছি যাঁরা আছেন তারা তো বটেই, ঢাকার বাইরে যাঁরা থাকেন, তাঁরাও যদি সবাই আসতে পারেন তবে দারুণ হবে। সবাই চেষ্টা করুন; সত্যিই কোনো অতি জরুরি কাজ না থাকলে মিস করা অব্লগারসুলভ, অমানবিক হবে।

কৃষ্ণচূড়া আমাদের ভালোবাসায় বেঁচে থাক চিরকাল। কেউ আসবে বলে নয়, যারা এসেছে, যারা পাশে আছে তাদের জন্যই এই লাল ফুটে থাক প্রাণের সবুজে। কবিরাও আরও লিখুন। প্রেমিক আরও ভালোবাসুন। ভাবুক আরও ভাবুন। আর এসব দেখে ভীষণ বিজ্ঞানমনস্ক কেউ না হয় একদিন অন্ত্যমিলে লিখে ফেলুন এরকম যা মন চায়,

এক গাছ ক্লোরোফিল বুকে, কনকনে বায়ুর শনশন

বৃষ্টির রাতে; উষ্ণতার ছলে সে কি সালোক সংশ্লেষণ?

ছবিগুলো ময়মনসিংহ মহানগরের জুবলি ঘাট, কাচারি ঘাট, জয়নুল আবেদীন পার্ক এবং টাউন হল মোড় থেকে নেওয়া। 
কবিতার দশ লাইন  প্রিয় কবি কাজী নাসির মামুনের কবিতা 'জঠর'-এর।