বুলবুলি দম্পতির সংসার আমাদের বারান্দার টবে

কাজী শহীদ শওকত
Published : 19 May 2016, 04:33 AM
Updated : 19 May 2016, 04:33 AM

বিষয়টি প্রথমে বাসার কারও নজরে আসেনি। পুরনো একটা স্টিলের আলনা বারান্দার এক কোণে; পরিত্যক্ত। বারান্দার ধার ঘেঁষে কয়েকটি টবে তুলসি, গোলাপ, গাঁদা, নাইটকুইন, এ্যলোভেরাসহ আরও কয়েক প্রজাতির গাছ লাগানো হয়েছে বেশ কয়েক বছর হলো। ওদের যত্নের কমতি নেই। বাসার কারও সর্দি হলে প্রাথমিক ব্যবস্থা হিসেবে তাকে তুলসি পাতার রস খেতে দেওয়া হয়। বিকেলে কি সন্ধ্যায় কখনও মুড়ি-চানাচুরের বন্দোবস্ত হলে সাথে পুদিনা পাতার যোগানটা বারান্দা থেকেই আসে। সম্প্রতি প্লাস্টিকের একটি মগ ব্যবহার অযোগ্য হয়ে যাওয়ায় ফেলে না দিয়ে ওটাতে মাটি ভরে পাতবাহার লাগানো হয়েছে। রাখা হয়েছে ভাঙা আলনাটার উপর। আর ওখানেই লালপুচ্ছ এক বুলবুলি বাসা বেঁধেছে কখন কে জানে! বুলবুলিরা সাধারণত সমতল থেকে ছয়-সাত ফুট উঁচুতে বাসা বানায়। এই আলনাটার হাইট ওরকমই হবে।

বাসার আশপাশের কয়েকটি গাছে পাখিদের ব্রেকফাস্ট, লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে। সকাল এবং দুপুরে এদিকটায় তাই নানা প্রজাতির পাখির আগমণ ঘটে। খেয়েদেয়ে আবার ওরা চলে যায়। দুদিন আগেও এখানে কোকিলের ডাক শোনা গেছে। শালিক আর চড়ুই তো সব সময়ই আসে। কাল দুটো কাঠঠোকরাকেও দেখা গেলো। বারান্দার গ্রিলে প্রায়ই একটা দুটো পাখি এসে বসে; নিজেদের মধ্যে গল্পগুজব করে; আবার ফুরুৎ করে উড়ে যায়। এর মাঝে কখন যে এই সুন্দরী বুলবুলিটা নিজের বাসা তৈরি করে নিয়েছে এখানে, কেউ জানে না। অবশ্য বাসা বানাতে বুলবুলির চার-পাঁচ দিনের দিনের বেশি লাগে না। তাছাড়া, একটু উঁচুতে হওয়ায়, আর পাতাদের আড়াল থাকায় এই বাসাটি সহজে কারও চোখে পড়ার মতো না।

বাসাটির অবস্থান জানা গেলো যখন, ততোদিনে বুলবুলি তার ডিমগুলোতে তা দেওয়া শুরু করেছে। ছোটো বাটির মতো দেখতে বাসাটি ভারি সুন্দর। খড়-বিচালি দিয়ে বানানো। চারপাশে আবার টুকরো কাপড়ের ঘির দেওয়া; কাপড়টুকু মাকড়শার জালের মতো নরম করে নেওয়া হয়েছে। বাসায় তিনিটে ডিম। হালকা গোলাপি কি সাদাটে ডিমগুলোর গায়ে অনেকগুলো লালচে ছোপ।

একদিন পাখি দম্পতির ছবি নেওয়ার জন্য বারান্দায় গেলাম। সকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে। বেশ তীক্ষ্ম স্বরে 'পিকপিক' করতে করতে উড়ে গেলো মা পাখিটি। গিয়ে বসলো টিভির ক্যাব্‌লে। কাল্‌চে চোখগুলোতে উৎকণ্ঠা আর উষ্মার আভাস স্পষ্ট। তারপরও আমাকে বেশ কিছুক্ষণ সময় দিলো ছবি তোলার জন্য। ওর পুচ্ছদেশের ওই লালচে অংশটির নাম অবসারণী–এ পাখিটির সবচে বিচিত্র, আকর্ষণীয় অংশ। এর কারণেই একে 'Red-vented Bulbul' বলা হয়। মাথার ঝুঁটিটিও অসাধারণ। ছবি তোলার সময় এই ঝুটিটা একবার বেশ খাড়া হলো, আবার নুয়ে পড়লো।

প্রসঙ্গত, মানুষের বাসস্থানের সুবিধাজনক স্থানে বুলবুলির বাসা বানানোর ঘটনা অস্বাভাবিক নয়। এমনকি এরা বাসের ভেতরও কখনও কখনও বাসা বানিয়ে ফেলে। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে টিকে থাকার অসাধারণ ক্ষমতা রয়েছে এই পাখিটির। আর নিজেদের মধ্যেও এরা লড়াই করে। তাই পক্ষী বিশারদগণ বুলবুলিকে লড়াইবাজ পাখি হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। এক সময় এদেশেও নাকি পোষা বুলবুলির লড়াই হতো। এরা ক্যামিকেলযুক্ত খারার এড়িয়ে চলে। বৈশ্বিক উষ্ণতা এবং নানাবিধ প্রাকৃতিক ও মানবসৃষ্ট প্রতিকূলতার প্রভাবে পাখিদের বিলুপ্ত হওয়ার ঝুঁকি যেখানে ক্রমশ বেড়েই চলছে, সেখানে বুলবুলি বেশ সাফল্যের সাথে বেঁচেবর্তে আছে। গত কয়েক দশকে এদের সংখ্যা নাকি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আর সেকারণেই 'প্রকৃতি ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংরক্ষণের আন্তর্জাতিক ইউনিয়ন' (International Union for Conservation of Nature and Natural Resources (IUCN)) এই বুলবুলিকে ন্যুনতম বিপদগ্রস্থ প্রজাতির তালিকায় স্থান দিয়েছে।

অবাক কাণ্ড হলো, রাতে পাখিটি এই বাসায় একাই থাকে। অবশ্য এ বাসাটির যা আকার তাতে সঙ্গীর ঠাঁই হওয়ার জো নেই। মা পাখিটি কোনো রকমে ডিমের উপর যুৎমতো বসে ঘুমুতে পারে; তখন ওর খান্দানি লেজখানা বাসার বাইরে বেরিয়ে থাকে। সেদিন রাত আটটার দিকে ওকে দেখতে গেলাম বারান্দায়। গিয়ে দেখি মাথাটাকে পাখনার একদিকে গুঁজে দিয়ে বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পাখিরা বোধ হয় 'আর্লি টু বেড আর্লি টু রাইজ'-এর কদর বোঝে। তাই বলে এই সন্ধ্যেবেলাতেই এত্তো ঘুম! আমি যে ওর গায়ের ঠিক উপর থেকে ফ্ল্যাশ দিয়ে কয়েকবার স্ন্যাপ নিলাম–বেচারি টেরই পেলো না। তখনও ওর ডিমগুলো ফোটেনি।

পুরুষ পাখিটি কোথায় তাহলে? সে কেনো আসে না স্ত্রী এবং অনাগত সন্তানদের খোঁজ নিতে? প্রশ্নগুলো মাথায় ঘুরছিলো। এর মধ্যে মাথাটা আরও ঘুরে গেলো যখন শুনলাম, দুপুরে এবং বিকেলে কোনো কোনো দিন চুড়ুই পাখির মতো দেখতে আরেকটি পাখিকে এই বুলবুলির কাছে, গ্রিলের উপর বসে থাকতে দেখা যায়। দুজনকে একসাথে উড়ে যেতেও দেখা গেছে। দুর্ভাগ্যবশত ওই পাখিটিকে ক্যামেরায় ধরা যায়নি। আমি ভেবে নিয়েছিলাম বুলবুলিটি হয়তো বিধবা; তাই স্বগোত্রের কাউকে সঙ্গী হিসেবে না পেয়ে অবশেষে অসম বর্ণের কাউকে ভালবাসতে শুরু করেছে। কিন্তু সেরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছার মতো যথেষ্ঠ এভিডেন্স পাওয়া গেলো না।

বুলবুলির ডিম ফুটে ছানা বের হতে চৌদ্দ দিন লাগে। সতেরো মে বিকেলে দেখা গেলো দুটো ছানা বেরিয়েছে, একটি তখনও ডিমের ভেতর। খেয়াল করলাম, বাচ্চা দুটো নড়াচড়া করছে, কিন্তু ডিমের খোসাগুলো সেখানে নেই। একজন জানালেন, এ পাখিরা ব্যক্তিগত পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারে বেশ সচেতন থাকে। রাতের কোনো এক সময় তৃতীয় ছানাটি ভূমিষ্ট হলো। পরদিন সকালে দেখি, এ কী! পুরুষ বুলবুলি পাখিটা ফিরে এসেছে। পিতৃত্বের টান বলে কথা। মা পাখিটা বাসায় বসে বাচ্চাদের উষ্ণতা দেয়, আর বাবাটা পাশে বসে থাকে গ্রিলে। আমাকে দেখেই মা-বাবা দুজনেই ফুরুৎ করে চলে গেলো। বসলো গিয়ে ওপাশের আমগাছটার মাথার পরে। এখনও ছানাগুলোর চোখ ফোটেনি। হাতে কালচে যন্ত্র নিয়ে আমাকে বাসার কাছে আসতে দেখে বুলবুলি দম্পতি চিৎকার করতে লাগলো। আমি তাদেরকে বোঝাতে পারিনি, আমি এখন আর পাখির বাসা ভাঙি না, ডিম চুরি করি না।