জলে-জঙ্গলে, জালে ও জেলে-সামাল, বেসামাল

কাজী শহীদ শওকত
Published : 11 June 2016, 05:45 AM
Updated : 11 June 2016, 05:45 AM

আমাদের দেশে মা ইলিশ রক্ষায় বিঘ্ন ঘটানোকে ভীষণ অন্যায় গণ্য করা হয়; প্রতি বছর অনেক জেলের জেল হয়। সুতরাং যে জাতি জাতীয় মাছ রক্ষায় সচেতনতার পরিচয় দিতে জানে সে জাতির সভ্যতা আর মানবতাবোধ অনেক উচ্চমার্গীয় বলে মানতে হবে। বড়ো হওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, আপনাকে বড়ো না বললেও বড়ো ভাবা।

জঙ্গলে, জলের কাছে বকেরা শিকার খোঁজে। প্রেম করে, ঘর বাঁধে, বাচ্চা দেয়। নিজেরা স্বাধীন ভাবে হয়তো নিজেদেরকে। তাই হয়তো ওড়ে। কখনও একা, কখনও দল বেঁধে। ডকুম্যান্টারিতে দেখেছি, সুটি টার্ন-ও তেমনি। জলের কাছে থাকা চাই।  হাওয়াই দ্বীপে সুটিদের অভয়ারণ্য আছে। এদের বাচ্চা হলে পুরো এলাকায় হৈচৈ পড়ে যায়। শিশু সুটিরা বাবা-মায়ের এনে দেওয়া মাছ-টাছ খায়। আদরে আদরে বড়ো হয়। ওড়তে শেখে। তবে ছোটোদের জীবন নিরাপদ নয়। মায়েদের, বাপেদের তাই সতর্ক থাকতে হয়।

অন্য আরেক অভয়ারণ্যে এ্যলবাট্রসের বাচ্চারা বড়ো হয় ওই একই সময়ে। ওদের জন্য ওদের বাবা-মা সুটিদের পাড়ায় এসে বাচ্চা ধরে নিয়ে যায়। সন্তানকে ছিনতাই হতে দেখে সুটি দম্পতি চিৎকার করে, এ্যলবাট্রসের পিছু নেয়–কিন্তু পেরে ওঠে না। প্রতিবেশি সুটি যারা বড়ো, তারা নিজেদের বাচ্চা সামলায়, নয়তো চোখ বুঁজে রোদ পোহায়, বাতাস খায়–পাশের জনের আহাজারিতে তাদের কিচ্ছু আসে যায় না। এসব দেখে দেখে ওরা নিশ্চয়ই অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছে। ওদের জানা আছে, এ্যলবাট্রসের সাথে লেগে লাভ নেই। তবু এদের মাঝে কেউ কেউ এই লাভ নেই জেনেই কিংবা ওসবের হিসেব না করেই চোখ খুলে রাখে, রুখে দাঁড়ায়। এরা বোকাই হবে হয়তো; অন্তত যারা নিশ্চিন্তে আছে, চোখ বুঁজে আছে তাদের কাছে তো বটেই।

শফিক মিতুলকে মৃতের মতো পড়ে থাকতে দেখলাম। শরীর জুড়ে আঘাতের দাগ। শফিক কী করেছিলো? অন্যায়ের প্রতিবাদ করেছিলো। অপহরণের হাত থেকে এক নারীকে বাঁচাতে গিয়েছিলো বোকাটা। এতো বড়ো একটা দলের ধর্ম বিষয়ক সম্পাদক; তা সে যতো কুলাঙ্গার আর লম্পটই হোক না কেনো–তার মুখের উপর উচিত কথা বলেছিলো শফিক। আমাদের চোখ বোঁজা বুদ্ধিজীবীদের মতো বুদ্ধিমান হলে নিশ্চয়ই তাকে এরূপ হামলার শিকার হতে হতো না। শফিক মিতুলকে সহব্লগার হিসেবে চিনি। গেলো এক আড্ডায় তাঁর সাথে দেখাও হয়েছে। প্রাণবন্ত এই মানুষটিকে হঠাৎ করে সংবাদ শিরানামে আর ছবিতে এভাবে দেখার কষ্ট আছে। তবে অবাক হচ্ছি না, যেহেতু দেশেই আছি। চুপ করে আছি। আমি তো একা নই, সাথে আছেন আমাদের চিন্তার আর বিনোদনের যোগানদাতা কতোসব ইন্টেলেকচুয়াল গুরুগণ।

তাঁরা বুঁজে থাকা চোখের বিলাসওয়ালা বিদ্বান। কারে ধরলো, কারে মারলো, কে কীভাবে দেশের ইয়ে মারলো –এসব নিয়ে তাঁদের মাথা ব্যথা নেই। তাঁদের মাথায় সৃষ্টিশীলতার প্রস্রবন। ভীষণ ব্যস্ত। কবে কোথায় কোন্‌ অনুষ্ঠান, আগামি বই মেলার বেস্ট সেলার নির্মাণ ইত্যাকার ভাবনায় তাদের সমৃদ্ধ জগৎ–এতোই যে, হাউকাউ শুনলে মাথায় যন্ত্রণা হয়। ইন্টেল্যাক্‌চুয়ালি ইম্পোর্টেন্ট এবং ইম্‌পোটেন্ট এসব সেলিব্রিটিগণ আমাদের বুকের আসনে দেবতা হয়ে ঘাপটি মেরে আছেন। ভক্তরা বলেন, 'ওনারা ধ্যানে বসেছেন; ডিস্টার্ব করবা না কেউ।' ঘরের ভেতর শুয়ে শুয়ে জাল বোনা যায়। সুতরাং আমাদের এসব পপুলার বুদ্ধিজীবীগণ নিজেদের আরামের জন্য একটু চুপসে গিয়ে ঝাঁকের কৈ হয়ে শুয়ে শুয়ে স্নিগ্ধ কোনো ভাবনার জাল বুনতে বসবেন এতেও নিশ্চয়ই অবাক হওয়ার কিছু নেই। দুর্বলতম ঈমানদারের মতো কেবল মনে মনে অপকর্মের প্রতিবাদ জানিয়ে তাঁরা প্যাট্রিয়ট বনে যান। কারণ জানা আছে, জালে আটকে যাওয়ার ভয় আছে। তাই জলের চেয়ে জঙ্গল ভালো আশ্রয়। নিজেকে যতোটা সম্ভব নিরাপদ রেখে (প্রয়োজনে জনপ্রিয় সেই অধ্যাপকের সেই বিখ্যাত পল্টিবাজি ব্যবহার করে হলেও) কীভাবে পাবলিক ভেনারেশন আস্বাদন করা যায় সে শিক্ষা আমাদেরকে প্রতিনিয়তই দিয়ে চলেছেন আমাদের সেলিব্রিটিরা। শফিক মিতুল শিখে নিতে পারতো কীভাবে চুপসে যেতে হয়। শেখেনি, কারণ ওর স্বভাবের দোষ, শিক্ষার ফল।

অপরাধীকে দল থেকে বহিষ্কার সময়োচিত হয়েছে। নিশ্চয়ই যথাযথ প্রক্রিয়ায় তার যথোপযুক্ত শাস্তি সকলের স্বস্তি নিশ্চিত করবে। তবে ঘর সামলানোর মহান দায়িত্বটা যদি রাজনৈতিক দলগুলো ঠিকঠাক পালন করতো, তবে তা দেশের এবং দশের নিরাপত্তায় ভীষণ ইতিবাচক হতো বলেই মনে হয়। শৃঙ্খলা যদি  কেবল বিশৃঙ্খলার পরেই গুরুত্ব পায়, অন্য সময়ে নয়, তাহলে সেটা লোক দেখানো শিল্পের খ্যাতি পায়। আইন কিন্তু সবার জন্য সমান। নিশ্চয়ই ভুলে যাইনি আমরা যে, পাবলিক পরিক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁসের গুজব ছড়ালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে ১৪ বছর পর্যন্ত জেল এবং এক কোটি টাকা পর্যন্ত জরিমানা করতে পারবেন আদালত। আর প্রশ্নপত্র ফাঁসের যেকোনো ধরনের চেষ্টা চালালে পাবলিক পরীক্ষা আইনে চার বছর পর্যন্ত জেল ও জরিমানা করা হবে। তো গুজব ছড়াতে কোন্‌ শালা যাবে? গুজব নেই। প্রশ্ন ফাঁস নেই। আজকাল চমৎকার সাজেশন পাওয়া যায় পরিক্ষার কয়েক ঘণ্টা আগে। আশ্চর্য ফলদায়ক! সমাধান যদি এরূপ হয় তবে সমস্যাও শাকের সবুজে ঢেকে রবে আর এর কৃতিত্বের শেয়ার সরকার ভিন্ন অন্য কোনো ব্যক্তি বা এজেন্সিকে দেওয়া অন্যায়।

একজন সাহসী পুলিস সদস্য তার সাহসিকতার বিনিময়ে পাবেন স্ত্রীর রক্তাক্ত লাশ, যেমন আরও অনেক পেশাজীবীই নিজেদের পেশাগত   দায়িত্বে নিষ্ঠাবান হওয়ার দায় মিটিয়েছেন জীবন দিয়ে। কিংবা একজন সাংবাদিক তার সামনে ঘটা অন্যায়ের প্রতিবাদের দায় মেটাবেন নির্মম লাঞ্ছনার শিকার হয়ে–এসব তো আর আজগুবি নয়। আমার বরং আনন্দ এজন্য যে, শফিক বেঁচে আছে।  আপাতত এইটুকু আনন্দ নিয়ে এ্যলবাট্রসদের জীবনযাপন, সুখ-দুঃখ নিয়ে বাকি কথাটুকু বলে নেওয়া যায়।

হ্যাঁ,Sooty tern-দের কথা বলছিলাম। এ্যলবাট্রস তাদের বাচ্চা শিকার করে খায়। উচ্চ মাধ্যমিক-এ ইংরেজি বইয়ে কোলরিজের 'দ্য রাইম অব দ্য এ্যনশ্যান্ট ম্যারিনার' কবিতাটির গদ্যরূপ পড়েছিলাম। এ্যলবাট্রসের প্রতি মায়া তখন থেকেই। কিন্তু বিশাল ডানাওয়ালা সুন্দর এই পাখিটির এরূপ নিষ্ঠুরতা দেখে সেই মায়ায় শর্ট সার্কিট হওয়ার উপক্রম হলো। মায়া আর ঘৃণা বাস্তসংস্থানের ধারাপাত নির্ভর নয়। তবে এ্যলবাট্রসেরও সন্তান হারানোর অনুরূপ যন্ত্রণা দেখে পুরনো মায়া স্বস্থানে ফিরে গেছে। এ্যলবাট্রসের বাচ্চারা ওড়তে শেখার সময় অল্পতেই টায়ার্ড হয়ে পড়ে। তখন সাগরের জলের পরে আয়েশ করতে বসে। আর সেই সুযোগে নিপুণ শিকারি হাঙর এসে হামলে পড়ে ওদের উপর। জলের তলা থেকে ফুঁস করে মাথাটা তুলে বাচ্চা এ্যলবাট্রসকে মুখে পুরে সোজা জলের তলায়। ডাঙায় থাকা বড়ো এ্যলবাট্রসদের এই ক্ষতি মেনে না নিয়ে উপায় থাকে না। হাঙরেরা ঠিক হিসেব করে এ সময়টাতেই জায়গামতো ওঁৎ পাতে। তাই বলে তারা সুটি টার্নদের আত্মীয় হয় এমন ভাবা অনুচিত। সুটি, এ্যলবাট্রস অনেক সুন্দর পক্ষী। হাঙরও সুন্দর প্রাণী।

মাকড়শার জালও দেখতে সুন্দর হয়। সেবার শীতের এক সকালে সার্কিট হাউজের কাছে ছোটো এক আমগাছে দেখা জালটার একটি ছবি আছে। মাকড়শা নিপুন কারিগর। দেশি বিদেশি অনেক জাতের মাকড়শা হয়। কতোগুলো খুবই বিষাক্ত।