সন্তানের প্রতি কতোটা দায়িত্বশীল হতে পারি আমরা?

কাজী শহীদ শওকত
Published : 8 July 2016, 05:56 AM
Updated : 8 July 2016, 05:56 AM

গুলশান হামলায় অংশ নেওয়া আত্মঘাতী হামলাকারীদের একজনের বাবা জাতির কাছে ক্ষমা চেয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, অল্প বয়স থেকেই ছেলে নানার হাত ধরে নামাজে যাওয়া শুরু করে। খুব সাদাসিধে, অন্তর্মূখী স্বভাবের এই ছেলেটির খুব তেমন বন্ধু-বান্ধবও ছিলো না। এমনিতে সে বাসার বাইরেও খুব বেশি যেতো না। বাসায় নিজের জন্য আলাদা কোনো কম্পিউটারও তার ছিলো না; একটি পিসিই সবাই মিলে ব্যবহার করতো বলে জানিয়েছেন তার বাবা। নিজের ছেলের এরকম বেপথু হওয়া তাকেও যারপরনাই বিস্মিত করেছে। ব্যাপারটি হতবাক করার মতোই।

.

জঙ্গি হামলার বিভীষীকা বর্তমানে পুরো দেশবাসীকে তঠস্থ করে রেখেছে। আর সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী প্রাণপণ চেষ্টা করে যাচ্ছে এসব হামলার ষড়যন্ত্রকারীদেরকে ধরতে, হামলার সম্ভাব্যতাকে ঠেকাতে; নেওয়া হচ্ছে প্রতিবেশি দেশের টেকনিক্যাল এসিস্টেন্স। প্রতিকারমূলক এসব প্রচেষ্টা নিশ্চয়ই খুব শীঘ্রই সফলতার মুখ দেখবে। এতো গেলো প্রতিকারের কথা। তবে ছেলেহারা এই বাবার কথার সূত্র ধরে গুরুত্বপূর্ণ যে প্রশ্নটি সামনে চলে আসছে, সেটি হলো আমাদের সন্তানদেরকে এ ধরণের ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যেনো আগামীতে কেউ ব্যবহার না করতে পারে  তার জন্য আমরা কী করতে পারি, অর্থাৎ সন্তানকে দেশের এবং জাতির শত্রু হওয়া প্রতিরোধে আমাদের কার কী কী করণীয়?

.

দেশে অনেক বিখ্যাত চাইল্ড সাইকোলজিস্ট আছেন, আছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞগণ। এটি এখন সময়ের দাবি যে, এঁদের সহযোগিতা নিয়ে সন্তানের প্রতি পরিবার তথা বাবা-মায়ের ভূমিকার বিষয়টি জনগণের কাছে শিক্ষণীয় করে তুলে ধরতে হবে, বিশেষ করে যারা ওয়ার্কিং প্যারেন্ট্‌স আছেন তারা কী করে নিজেদের রোজগার সংক্রান্ত কর্মব্যস্ততা আর সন্তানকে দেবার উপযোগি সময়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে চলতে পারেন সে ব্যাপারটিতে মনযোগ দেওয়া দরকার।

.

 এখানে তিনটি বিষয় জ্বলজ্বল করছে। একটি হলো, সন্তান যদি নামাজ না পড়ে তাহলে সে জেহাদি চেতনা থেকে এমনিতেই দূরে থাকবে–এরকম একটি থিওরি প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে মুসলিম পরিবারগুলোর সন্তানদের নামাজ-টামাজ পড়ার ব্যাপারে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা যেতে পারে। অনেক বিশেষ অজ্ঞ এ ব্যাপারে ইতোমধ্যেই এক আধটু ইঙ্গিত করেছেন এবং দৃশ্যতঃ সর্বশক্তি দিয়ে ইসলাম ধর্মের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে নেমেছেন। তারা মনে করছেন, ইসলাম পালন আর জঙ্গিবাদ লালন — এই দুয়ের মাঝে ইতর বিশেষ কিছু নেই। আর সরকার যদি মনে করে ধর্ম পালন নয়,বরং ধর্মের অপব্যাখ্যা, ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞতার অবসান ঘটাতে হবে, তাহলে সে মোতাবেক প্রত্যেক পাড়ায় মহল্লায় মসজিদগুলোতে ভালো ধর্মীয় জ্ঞানসম্পন্ন ইমাম নিয়োগ, এবং কোরান-হাদিসের বাণীগুলোকে সঠিকভাবে জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা করতে পারে। ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে আমি যতোটুকু জেনেছি তাতে বুঝি, ধর্মটি বর্তমানে নন্দ ঘোষের স্থলাভিষিক্ত হয়েছে। আজকাল অল্প টাকায় কোরানের, হাদিসের বাংলা কপি পাওয়া যায়। স্কুল-কলেজ কিংবা মসজিদ ভিত্তিক আয়োজনের মাধ্যমে মুসলিম ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ধর্মের সঠিক বাণী পৌঁছানো সম্ভব। ধর্মে প্রচণ্ড অনুরাগ, কিন্তু জ্ঞান কম — এ ধরণের পরিস্থিতি কারও থাকলেই বরং তাকে খুব সহজে ধর্মের নামে বায়াস করে বিপদগামী করা সম্ভব।

.

দ্বিতীয়ত, সন্তানের জন্য দৈনিক কোয়ালিটি সময়ের বরাদ্দ নিশ্চিত করা চাই।  বাবা-মা নিজেরা যতো ব্যস্তই হননা কেনো, সন্তানকে সময় দেওয়ার বিষয়টিকে অপশনাল করে রাখা যাবে না। অনেকেই ভাবেন, 'বাচ্চার জন্য দশটি টিচার রেখে দিয়েছি, আমার আর সময় দেওয়ার কী আছে?' এমনটি মোটেই ঠিক নয়। অনেক বাবা-মাই জানেন না সন্তানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু কে কে এবং তাদের কী পরিচয়, সে কী করে কোথায় যায় তো পরের কথা। আমাদের দেশে মোটর গাড়ি কীভাবে চালাতে হবে, চাকরি কীভাবে পেতে হবে, ব্যাটিং-বোলিং কী করে করতে হবে ইত্যাদি জরুরী তালিম নেওয়ার জন্য অনেক কোচিং সেন্টার আছে কিন্ত সংসার কীভাবে চালাতে হবে সে ব্যাপারে দিক নির্দেশনা দেওয়ার প্রাতিষ্ঠানিক কোনো সেট-আপ নেই। উন্নত দেশগুলোতে ম্যারিজ এ্যন্ড ফ্যামিলি কাউন্সেলরের কাছ থেকে দাম্পত্য সংক্রান্ত নানাবিধ ইস্যুর প্রফেশনাল সাহায্য পাওয়ার সুযোগ আছে নাগরিকদের, কিন্তু আমাদের এখানে এগুলো আমরা এখনও সিরিয়াসলি ভাবতে পারছি না। সরকার এ বিষয়টি ভেবে দেখতে পারে। প্রফেশনাল তৈরির জন্য ইউনিভার্সিটিগুলোতে এ বিষয়ে কোর্স চালু করা যেতে পারে।

.

তৃতীয় যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলতে চাই তা হলো আমাদের খাসলত। আমরা জানি, খাসলত সহজে বদলায় না। এও অজানা নয় যে, শিশুরা দেখে শেখে। কিশোরেরাও না দেখে শেখে না। সন্তানের ভালোর জন্য ছুটে বেড়াচ্ছেন যে বাবা বা মা, তিনি নিজে একজন অসৎ মানুষ। এরকম ক্ষেত্রে দেখা যায়, অল্প বয়স থেকে সন্তান জেনে যায়, তার বাবা বা মা দুনম্বরি ইনকাম করেন। এরপর স্কুলে বা অন্য কোথাও যখন কারও মুখ থেকে সততার গল্প শুনে, বা অসৎ কাউকে গালি দিতে দেখে ওই সন্তান ভেতর থেকে কুঁকড়ে যেতে থাকে। কখনও নিজ বাবা বা মায়ের অসততার পক্ষে যুক্তি দাঁড় করিয়ে শান্তি পেতে দেখা যায় এদের কাউকে কাউকে। এরা বাপকা অথবা মা কা বেটা-বেটি হবে হয়তো। তবে অনেকেই আছে, যারা নিজেরা বুঝতে শেখে, তাদের প্যারেন্ট একজন অন্যায়কারী। কিন্তু নিজে অতো ছোট হয়ে তাঁকে কিছু বলার চেয়ে চেপে যাওয়া শ্রেয় মনে করে। এই সন্তানগুলো খুব অভাগা হয়। না পারে বাবা বা মায়ের অসততাকে মেনে নিতে, না পারে ঠেকাতে।  এ ধরণের ইনার কনফ্লিক্টওয়ালা সন্তানের পক্ষে হঠাৎ কোনো আদর্শবাদের ঠিকানা আপন মনে হতে পারে। খুবই স্বাভাবিক। আমরা যদি সাম্প্রতিক হামলায় নিহত জঙ্গিদের পরিবারগুলোতে একটু ভালো করে খোঁজ নিয়ে দেখি তাহলে হয়তো এ বিষয়ে বেশ কিছু ইনফরমেশন পেয়ে যেতে পারি।

.

যা হোক, আন্তর্জাতিক সুনাম(!) কুড়ানো দুর্নীতিপরায়ন জাতির ভাগ্যাকাশে এতো চাঁদ একসাথে ওঠবে না জানি, তবু 'আজি হতে শতবর্ষ পরে' হলেও কারও যদি মনে ধরে, ধীরে ধীরে গোড়া থেকে দুর্নীতি পরিহারের না হলেও নিয়ন্ত্রণের জাতীয় উদ্যোগ শুরু নিশ্চয়ই হবে। দেশের জন্য না থাক, প্রজন্মের জন্য ভালোবাসা কার না আছে?

.

জীবনকে যাপনের খরচ আর প্রযুক্তিগত উৎকর্ষের সাথে তাল মিলিয়ে মানুষেরও দৌড় বেড়েছে–জীবিকার দৌড়। সকালে বেরিয়ে গিয়ে ফেরা হচ্ছে সন্ধ্যায়, কখনও রাতে। ক্লান্ত শরীর। বাবা-মা দুজনই চাকরিজীবী হলে তো কথাই নেই। অনেকের তো আবার ছুটির দিনেও ব্যস্ততার শেষ নেই। নিজেদের সোস্যালাইজেশন আছে, কিংবা অফিসেরই কিছু পেন্ডিং কাজ পড়ে থাকে–করতে হয়।  সন্তানদের সাথে খুব বেশি যোগাযোগের জো কি আছে? তবু চাইলে সম্ভব নয়– কাজটি মোটেই তেমন নয়। এই দেখুন না, এই কর্মজীবী মা কী বলেন