কাটা ঘায়ে নৈঃশব্দ্যের নুন

কাজী শহীদ শওকত
Published : 6 August 2016, 06:25 PM
Updated : 6 August 2016, 06:25 PM

কোনো কোনো গানের এক-আধ লাইন বিভিন্ন প্রসঙ্গে হঠাৎ মনে পড়ে যায়। গুনগুন করে গাওয়ার স্বভাব সকলের নেই। যাদের আছে, তাদের শুনগুন শুনে নাকি মনের অবস্থা আন্দাজ করা যায়। ভর দুপুরে কারও কারও রবীন্দ্রসঙ্গীতে বিমল আনন্দ হতে পারে। তাই বলে আনন্দের সময় কারও কাছে বিষাদের গুনগুন সুস্বাদু হয় না নিশ্চয়ই। তেমনি বুকে যখন বিষাদ নামে, গানের পছন্দ তখন বিষাদই খুঁজে বেড়ায়।

.
কিন্তু একবার একদম অন্যরকম ঘটলো। কুমিল্লা থেকে ঢাকায় আসতেই সন্ধ্যা নামলো। আরেক টার্মিনালের বাস ধরার তাড়া ছিলো। সিএনজি অটোতে আমি একাই। মাঝ পথে গাড়িটা হঠাৎ থামলো। কিছু বুঝে ওঠার আগেই দুপাশের দুই দরজা দিয়ে চট করে উঠে পড়লো তিনজন। অটোর দরজায় কপাট লাগানোর ব্যবস্থা তখন ছিলো না। আগন্তুক তিনজন অস্ত্রশস্ত্র তাক করে ভয় দেখালো। মোবাইলটা নিলো। সাথে টাকা-পয়সা তেমন ছিলো না। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার, ওরা সবটা নিলো না। তরুণ দলপতি আমার গন্তব্যের খোঁজ নিলো। বাড়ি ফেরা বাবদ পাঁচশো টাকা পকেটে গুঁজে দিলো। ফোনের সিমটাও ফেরৎ পাওয়া গেলো। গাড়ি থেকে আমাকে নামিয়ে দিয়ে ড্রাইভার ওই তিনজনকে নিয়ে চম্পট দিলো। ভাড়াটা দিতে দিলো না। জীবনের প্রথম ফোনটা এভাবে খোয়া গেলে ভীষণ কষ্টে চোখে জল আসার কথা, কিন্তু সেরকমটি হলো না। বরং আনন্দে মুখে গান চলে এলোঃ 'ওগো যা পেয়েছি সেইটুকুতেই খুশি আমার মন'। খুশির নাকি রঙ হয়; রোদের যেমন গন্ধ হয়। কিন্তু জীবনানন্দের কবিতা নয়। হেমন্তের ওই গানটির দু'লাইন মনে পড়ছে এখনঃ
'দেখা আর না দেখার কাছাকাছি কোনো রঙ
চোখে আর ভাসবে কি কখনো?'

.

দেখাদেখির কতো কিছু আছে দুনিয়ায়! প্রথম ফোনের অধিকার সেকালে এখনকার মতো দেখার দরজা এতোটা উজালা পায়নি। আশির শিশু আর নব্বইয়ের শিশুর অনেক অভিন্ন অভিজ্ঞতার মতো ইন্টারনেট ব্যবহারও কারও বেশ পরে, কারও খুব আগে শুরু হয়েছে। কম্পিউটার এসে ভিসিআরকে নির্বাসনে পাঠালেও, মোবাইল ফোনে নেট এভেইলেব্‌ল হওয়ার ফলে সাইবার ক্যাফের ব্যবসায় কিন্তু ধ্বস নামেনি। গ্রাহক সেবায় এক ধাপ এগিয়ে থাকা অনেক ক্যাফেতে বাড়তি বিনোদনের খোরাক হিসেবে আছে পর্নো। একশো-দেড়শো জিবির ড্রাইভ ভর্তি মাংসল বিনোদন। ঘণ্টায় বিশ-পঁচিশ টাকা বড়ো কথা নয়। বহুকাল আগে সিনেমা হলগুলোতে এক টিকিটে দুই ছবির দর্শক উপচে পড়তো। এখন আর সেসবের কে রাখে খবর? সবই যে হাতের মুঠোয়!

.

কতো বিচিত্র সব অভিধায় পাতায় পাতায় থরে থরে সাজানো দৃশ্যের সুখ। আঙুলের আলতো ছোঁয়ায় পাওয়া যায়। যে সত্যিই প্রিয় করে নিয়েছে, তার জানা আছে- আঠালো এসব ছবির পিকজেলে ব্যাপক বিনোদনই শুধু নয়, জ্ঞানেরও বিকাশ হয়। বয়ঃসন্ধির আগেই আজকাল জেনে নেওয়া যায় সম্ভোগের কলা, যাকে প্রকাশ্যে জানা দায়। মগ্ন চৈতন্যে হঠাৎ চ্ছলাৎ বড্ড একরোখা হয়। এমন নিগূঢ় সত্যের খোঁজ এতো সহজে ভাগ্যিস পাওয়া যায়!

.

প্রথম ফোনের সাথে আরও অনেক অভিজ্ঞতার প্রথম জড়িয়ে থাকে জীবনে জীবনে। এ এক অদ্ভুত, অতুল হুল্লোড়— কতোসব রাখঢাকে এতোদিন যাকে অস্পষ্ট রেখেছে সবাই! জানবার প্রচণ্ড সাধ বারণের সব বাঁধ নিমেষে ভাঙে। কৈশোরে জ্ঞানের বান ডাকে। বানভাসি ইচ্ছেরে তখন কে আছে এমন যে রুখে? চুরমার বিনোদনের এসব পাঠে মনযোগ খুব খাঁটি হয়। প্ররোচিত খায়েসের হিশহিশ উপশমের নাম করে অবদমনে আশ্রয় খোঁজে। খলবলে চিড়বিড় নিভৃতে বাতাসা খায়। তত্ত্ব তালাশের এই গিগাবাইট যাত্রায় কতো যে রাত যায়, দিন যায়— আর সহসাই কতো সহজেই কেমন বড়ো হয়ে যাওয়া যায়! দৃশ্যের রগরগ ঢকঢক সুমধুর হয়। জ্ঞানের পুঁথি কতোদিন ধূলোয় ঢাকা, মনে পড়ে না। আরও কতো জ্ঞান ভাণ্ডার পড়ে আছে চারপাশে— রুচি নেই। আবিষ্কারের তৃষ্ণায় সাত সমুদ্দুর পাড়ি দেওয়া অভিযাযাত্রীর জানা নেই কতোদূর ভেসে গেলে বহুদূর হয়।
.
গত দেড় দশকে দেশে মটর গাড়ির সংখ্যা ব্যাপকভাবে বেড়েছে। পরিবেশ দূষণ বাড়ছে। ঠিক তেমনি প্রযুক্তির বিকাশের সাথে তাল মিলিয়ে ডিজিটাল দূষণও কেবল বেড়েই চলছে। এখানে রুচি বদলের বর্ণিল আয়োজন আছে—আর তাই আকর্ষণের চুম্বকে সেঁটে থাকায় আনন্দ। সামান্য পাটখড়ির পাঁচিল যতো উঁচুই হোক, তাকে টপকানো যায়। তাই "ওখানে যেওনা, ওখানে রাজ্যের সাপ!"—এ ধরণের নসিহত একালে খুব বিনোদনমূলক বটে।

.
ক্রমোন্নত সচেতন সমাজে খুব বেমানানভাবে যৌনতার মতো জীবনের অতি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়কে ট্যাবু জ্ঞান করে বেহুদা ভদ্রতার বিলাস এখনও আমাদের রুচির উদাহরণ হয়ে আছে। নিশ্চুপ থাকার এবং রাখার চর্চায় উপেক্ষিত পড়ে আছে ক্ষয়িষ্ণু প্রিয়জন—সচেতনের জানা নেই। না জানায় শান্তি আছে। জানায় বহুত ঝুটঝামেলা।

.

গত এপ্রিলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট তারানা হালিম তাঁর ফেইসবুকে এক ব্যক্তির প্রশ্নের জবাবে বলেছিলেন, এক সপ্তাহের মধ্যে পর্নোসাইট সব বন্ধ করে দেবেন (খবরের লিংক)। কিছুদিন আগে ফেইসবুক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিলো। অসফল প্রয়াসের সেই স্মৃতি অস্পষ্ট নয়। সৌদি আরবেও কিন্তু সরকার সব পর্নো সাইট বন্ধ করে রেখেছে। সেখানে প্রক্সি সার্ভার দিয়েও এগুলো চালনো সম্ভব নয়। তবুও সেদেশে যারা দেখতে চায় তারা একটু কসরত করে দেখে নেয়। তালা যতো দামিই হোক, তাকে ভাঙা যায়। তারপরও এসব সাইট বন্ধ করার উপকারিতা আছে। তবে যে কথা ভুললে চলবে না তা হলো, মৌনতার পর্দা টেনে, খড়ির দেয়াল তুলে স্খলনের সম্ভাবনা ঠেকানোর স্বপ্নটা প্রিয় হলেও, ভীষণ অশ্লীল।