বিস্ময় নয়, ভয়

কাজী শহীদ শওকত
Published : 28 Oct 2016, 01:09 AM
Updated : 28 Oct 2016, 01:09 AM

ওখানে জঙ্গিদের তাণ্ডব, বোমা এবং বুলেট— রক্ত, মৃত্যু। ওদিকে ক্রসফায়ার, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, ধান্ধাবাজি। এদিকে আয়নাবাজি, গলাবাজি। চলছে। যার যেমন ক্ষমতা আর সুযোগ মিলছে, ইচ্ছেমতো ব্যবহার করছে। লোভও বাড়ছে। যে মাছওয়ালা এক সময় সিরিঞ্জভর্তি পানি মাছের পেটে ভরে দিয়ে ওজন বাড়াতো, সে এখন সিসার গুলি ভরে দেয় বিশ-ত্রিশটা। এ্যড ফার্মে চাকরি করতে গিয়ে এক-আধটু নিগোসিয়েশনের কাজ করতো যে, এখন সে পুরোদস্তুর পিম্প্‌। বিপদগামী কতিপয় তরুণ ছিনতাইকে পেশা হিসেবে নিয়েছে। এদের প্রায় সবাই স্কুল থেকে, কলেজ থেকে ঝরে পড়া বাউন্ডুলে। এদের আবার বড়ো ভাই আছে এক। তার আছে আরেক বড়ো ভাই। তার উপরে আরেক বাপ। বিপদে রক্ষা পাওয়ার উপায় আছে। দোকানে সোর্স পাঠিয়ে ইয়াবা গুঁজে নিরপরাধ দোকানিকে গ্রেফতারের ধান্ধায় গিয়ে যে অধমটা উত্তম-মধ্যম বেশ কিছু খেয়েটেয়ে কোনো রকমে জানটা নিয়ে দৌড়ে পালালো, যে কিশোরটা বাইকের টাকার জন্য বাবাকে খুন করে ফেললো, কিংবা যে মানুষটি তার বন্ধুর সর্বনাশ করে পালিয়ে গেলো নিশ্চিন্তে, এবং এরপর একদিন মরিবার সাধ হলো ওই যে মেয়েটার, ভালোবেসে যার বাঁচবার খুব সাধ ছিলো, অথবা ওই যে সাংবাদিক দম্পতিকে কিংবা এই যে সেদিন বাবুলের স্ত্রীকে যারা খুন করে দিলো, যারা তনুকে হত্যা করে পার পেয়ে গেলো, আর এই যে শিশুটাকে পাশবিকতায় মৃতপ্রায় করে দিলো যে পাষাণ্ড জ্যাঠা— এদের মধ্যে ওই খুনি কিশোর আর এই জ্যাঠা ছাড়া বাকিরা সৌভাগ্যবান। কতো দৃষ্টিকোণে কতো কিছুকে দেখা যায়! তনু, মিতুরা তো বড়ো মানুষ, আর পূজা মেয়েটি তো ছোট্ট শিশু…এজন্য কষ্ট বেশি—এমনটি ভেবে নিয়ে কিছুক্ষণ কুঁদন-রোদন করাও যায় হয়তো।

.

'বিশ্ব ডিম দিবসকে' কালো দিবস আখ্যা দিয়ে ডিম খাওয়া এদেশে হারাম ঘোষণা করা হলে কোনোদিন, যারা চমকে যাবেন তাদেরও ধাতস্থ হতে সময় খুব একটা লাগবে বলে মনে হয় না। দ্রুত মানিয়ে নিতে আমাদের মতো কে আর পারে এতো? তবু সংবেদনশীল মানুষ মাত্রেরই পাশবিকতার খবরে আঁতকে ওঠার কথা, গা শিওরে ওঠার কথা। চারপাশে যা যা ঘটে চলছে নিয়ত, সেসব বিবেচনায় এসব মোটেও অস্বাভাবিক কোনো ব্যাপার নয়। আমাদের সাংস্কৃতিক রুচিতে গত দেড় দশকে বহু রেসিপির আগমন, অবদান বৈপ্লবিক হয়েছে। বৈশ্বিক ঢেউ বদলে দিয়েছে আমাদের ঘুমের সময়, খাবারের মেন্যু, গায়ের পোষাক, বিনোদনের রকমসকম, সম্পর্কের টান, শিক্ষার মান। শহরের বিশাল বিলবোর্ডের চেহারা শুধু নয়, বদলেছে আরও অনেক কিছুই। রাস্তাঘাট, দোকানপাট, রাতের জীবন, দিনের জীবন। বিদ্যুৎ, পাওয়ার টিলার, মাড়াইকল, মোটরবাইক, ভটভটি, নসিমন যেমন অনেকখানি বদলে দিয়েছে গ্রামীন জীবন। হাতে হাতে মোবাইল ফোন, সুলভ ইন্টারনেট তো আছেই।

.

ধীরে যাওয়ার সময় এখন দেশের হাতে নেই। পশ্চিমে পিডোফাইলদের সামলাতে বিশাল বাহিনী সদা তৎপর থাকে, ধরা পড়লে আর ছাড় নেই। তারপরও ওদিকে দেশে দেশে প্রতিবছর বহু বয়স্ক মানুষের কারাদণ্ড হয় শুধু কিডিপর্ন দেখার অপরাধে। আবার ওসব দেশ থেকে উড়ে আসা 'সেক্স টুরিস্ট'রা কেনো ভারত, বাংলাদেশ, থাইল্যান্ড-এ এতো আগ্রহী হয়ে ওঠে তা অনুমান করা কঠিন হওয়ার কথা নয়।

.

অবাক লাগে না, কিন্তু ভয় হয়। যেখানে অপরাধীর নিজের রাজনৈতিক, আর্থিক, প্রশাসনিক ক্ষমতা থাকা বা না থাকা তার শাস্তি কিংবা মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করে, সেখানে অপরাধপ্রবণতা দিনে দিনে কমে যাবে—এমনটি ভাবা স্রেফ কল্পনা বিলাস। আপাতত এই বিলাসে মন বসছে না বলে ভয় বাড়ছে। পাঁচ বছরের শিশুটিকে ধর্ষণ করেছে যে পাষাণ্ড, তার উপযুক্ত শাস্তি হবে—এ ব্যাপারে সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে এরূপ বর্বরতাসহ আরও অনেক অপরাধের প্রভাবশালী অনেক হোতা চোখের সামনে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, জিভ নাড়ছে, দাঁত কেলিয়ে হাসছে— তাদের কিচ্ছু হবে না। এরকম বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও তা বাস্তবায়ন করা যায়নি কারণ তাদের উপর রাষ্ট্রপতির ক্ষমা নাজেল হয়েছিলো। নবী না হয়ে কারও ওহিপ্রাপ্ত হওয়ার নজির না থাকলেও, ক্ষমার অযোগ্য অপরাধ করেও, মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত হয়েও রাষ্ট্রীয় ক্ষমায় মুক্তি পাওয়ার অধিকার কারও কারও থাকে বৈকি।

.

রাঘব বোয়াল কিংবা চতুর শেয়ালরাও মাঝেমধ্যে ফাটা বাঁশের ফাঁকে পড়ে, ধরা পড়ে। শাস্তিও হয়। একদা এদেশে ওসমান গণি নামক এক বনরক্ষক 'বনের রাজা' খেতাব পেয়েছিলেন; তার ঘরের এখানে ওখানে (বালিশে-তোষকে, চালের ড্রামে) টাকার খনি আবিষ্কৃত হয়েছিলো, মনে আছে? একদা এদেশে এক শিশু সাহিত্যিক শিশুপর্নো তৈরি ও বিদেশে তা পাচারের দায়ে ধরা পড়েছিলো, মনে আছে? ইনারা এখন কেমন আছেন, কোথায় আছেন, কেউ জানেন কি? আমরা কি ধরে নিতে পারি, বনবিভাগে বর্তমানে ওসমান গণির মতো টারজান আর কেউ নেই? আমরা কি ধরে নিতে পারি এদেশে এখন আর শিশুপর্নো তৈরি হচ্ছে না? ধরে তো নেওয়াই যায়। কে মানা করেছে?

.

সত্য তো এটাই যে, সরকার চাইলেই আইন ও বিচার প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রোধ করতে পারে। তেমন হলে অপরাধ প্রবণতা নিশ্চয়ই কমে যেতো অনেক, মানুষের ভয়ও কেটে যেতো। ইতিবাচক আরও অনেক কিছুই হতো, হবে। তবে রক্ষকের ভক্ষক হওয়ার কালচারটা মূলসহ উপড়াতে হবে আগে।