শীতের সকালে আদার বেপারি ব্রহ্মপুত্রের ধারে

কাজী শহীদ শওকত
Published : 15 Dec 2016, 10:53 PM
Updated : 15 Dec 2016, 10:53 PM

মিয়ানমারের বাতাস অশূচি হয়ে আছে; হিংসার আগুনে পোড়া মাংসের গন্ধ ধুয়ে-মুছেও শূচি-শুদ্ধ করা যাচ্ছে না শান্তির ক্ষেত। সেনা উপস্থিতিতে নির্যাতন অব্যাহত। ঝামেলা। অ্যালেপ্পোতে আবারও হামলা— বোমা পড়ছে, মানুষ মরছে। ঝামেলা। মার্কিন মুলুকে ইলেকটরদের জোটের প্রস্তুতি চলছে ট্রাম্পকে ঠেকাতে।  ঝামেলা বটে। নাইজেরিয়ার অর্থনীতির খুব খারাপ সময় যাচ্ছে। আবার অনেক দেশেই অর্থনীতি মঙ্গা দশা কাটিয়ে চাঙ্গারূপ ধারণ করছে, চাঙ্গাগুলো চাঙ্গাতর হয়ে ওঠছে। সেই সাথে রাষ্ট্রপ্রধানদের পরিকল্পনা, ক্ষুধা-তৃষ্ণা এবং খাওয়া-দাওয়া বেড়ে চলছে। ফিলিপাইনের প্রেসিডেন্ট ভরা পেটে টালমাটাল স্মৃতিচারণ করে গিয়ে এখন ফাটা বাঁশের চিপায়। ঝামেলা। প্রেসিডেন্ট দুতার্তে পাবলিকের হিতার্তে নিজের হাতে খুন করার সৎ (!) কারণ তুলে ধরে যা বলেছেন তার সাথে সুস্থতার সম্পর্ক জড়িয়ে যারা ট্রাম্পকে টেনে আনছেন তারা নাকি নিতান্ত দুর্মুখ। ওদিকে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রে নতুন নোটের সাপ্লাই কম, লোকজন অস্থির। ঝামেলা। ঝামেলা। আরও কতো কতো দেশের কতো ঝামেলার খবর আকাশ বাতাস ভারী করে তুলছে। এরই মাঝে দেশে দেশে ঠাণ্ডা বাতাসে শীতের কনকন।

.

.

আদার ব্যাপারি হয়ে দূর-দর্শনে মনযোগ দিয়ে যা দেখা যায় তার নাম উড়োজাহাজ-ডুবোজাহাজ যা-ই হোক, নানা কারণেই সেসব দেখাদেখি সময়ের অপচয়। আর তাই ভিনদেশের বিষয়াদিতে কর্ণপাত করে শীতরাতের আরামটুকুর  মুণ্ডুপাত করার কী দরকার— এরকম  ভেবে নিয়ে ঘুমকে জড়িয়ে থাকা শ্রেয় মনে হলো। বন্ধ জানলার ফাঁক-ফোকড় দিয়ে হিম ঢুকছে। ঘ্রাণ বলছে, নামছে কুয়াশা; ঘন থেকে ঘনতর। সত্যিই তো! পৌষ মাস এসে গেলো। বর্ষার প্রথম দিনে ভিজবার সাধ পূরেনি। তাই বলে পৌষের প্রথম রাতে ঘুম মিস করে শুধু শুধু অনিদ্রার রোগি হওয়া? না, সেটি হবার নয়।

.

.

আদার ব্যাপারির ঘুম ভেঙেছে খানিক আগে। সকাল হয়েছে অনেক্ষণ। কুয়াশা কাটছে না, তবে হাঁটতে অদ্ভুত লাগছে। বেপারি ধীরে ধীরে হাঁটছে। পার্কের কাছাকাছি যেতেই রোদ ওঠলো। কুয়াশা সরে যেতে সময় নিচ্ছে। প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছেন আরও অনেকেই। পথের পাশে দোকান দুয়েকটা খোলা আছে। একটার সামনে চুলোয় আগুন। চায়ের কেতলি গরম। ওদিকে বেঞ্চে বসে ঘোরের গল্প চলছে।

-বুঝলেই কী, না বুঝলেই কী। ঘোর তো ঘোরই।

ঘোর? কীসের ঘোর?

-ঘরের এবং পরের ঘোর। দুধের ঘোর। সরের ঘোর।

আই সব্বোনাশ! বিরাট ভাব লইছো দেহি আইজক্যা!

-ভাবেরও ঘোর আছে।

ধূর মিয়া, কী খালি ঘোর ঘোর করতেছো? কামের কথা কও।

-কামেরও ঘোর আছে, মিয়াভাই।

মিয়াভাই এবার রাগ করেন। 'চ'-বর্গীয় গালি হাঁকেন একটা খুব কষে। তারপর বিতৃষ্ণায় মুখ ফিরিয়ে নেন। চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে আসমান দেখেন। আসমান আন্ধার লাগে। ঘোরের গল্পকার নির্বিকার। বিড়িতে সুখটান দিয়ে বেপারির দিকে তাকায়। বেপারি চোখ সরিয়ে ফোনের স্ক্রিনে রাখে। ওদের কথায় কান পাতে। আর কথা নেই। গল্পকার আরেকটা বিড়ি ধরায়। যেখানে চা খাওয়া চলছে এই দোকানটা পার্কের ভেতরে নয়। বাইরে। এখান থেকে পার্কের গেইট জোর কদমে এক মিনিটের কম। জয়নুল আবেদীন সংগ্রহশালার ঠিক সামনেই । পার্কের অন্য প্রান্তের, মানে সারিন্দা পার্ক ক্যাফের দিকের গেইটটা দিয়ে লোকজনের চলাচল বেশি। ওদিকটায়, মানে পূব দিকে হিমু আড্ডার দিকে, গাছ-গাছালির ছায়ায় ছায়ায়, নদের ধার ধরে বেশ কিছুটা দূর হেঁটে যাওয়া যায়। ভালো লাগে।

.

.

প্রাচীরে ঘেরা পার্কের ভেতরটা দারুণ; ছুটির দিনে লোকারণ্য হয়ে ওঠে। ছোট, ছিমছাম একটি পাঠাগার গড়ে তোলা হয়েছে সম্প্রতি। চিড়িয়াখানা, নাগরদোলা ছাড়াও হালের কিছু রাইড, দুটো ক্যাফে, নানা জাতের গাছপালা আর চমৎকার আসন ব্যবস্থা— সবই নজর কাড়ার । প্রাঃতভ্রমণের সহায়ক বিশেষ ব্যবস্থাও চমৎকার। তবে এর বাইরে, নদের একই ধার বেয়ে গাছের ফাঁকে ফাঁকে চেয়ার পাতা। ফুচকার দোকান, চায়ের এবং পান-তামাকের দোকান।  হাতি-ঘোড়া-হাঁসের আসন পাতা রাইডও ছিলো। ছিলো মানে এখন নেই। প্রশাসনের উচ্ছেদ অভিযানে কয়েকদিন আগে এই জায়গাটা উলঙ্গ হয়েছে। অচিন কোনো গোরস্থান  যেনো। বেপারির ভালো লাগে না। সে ভাবে, ঘোরের বয়ান ছেড়ে চলে এসে ভুল হয়েছে। কী দোষ করেছিলো কয়েকটা ভ্রাম্যমাণ দোকান? প্লাস্টিকের লাল-নীল চেয়ারগুলো কী দোষ করেছিলো?

.

টাইল্‌সমোড়া বেঞ্চগুলো সুন্দর। শুক্র-শনিবারে এদিকে যখন ঢল নামে মানুষের, তখন ওই কয়েকটা বেঞ্চের কোনো একটাকে খালি পাওয়া মুশকিল হয়। আগে মুশকিলের ওই সময়টাতে বয়স্ক ক্লান্তজনের, কিংবা মায়ের-বাবার হাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে আর পারে না যে শিশু তার বসবার সংস্থান হতো এখানে পাতা চেয়ারগুলোতে। গল্পগুজব, আড্ডা, চটপটি-ফুচকা, বাচ্চাদের হৈচৈ-আনন্দে উচ্ছ্বল এই এলাকাটার আকর্ষণ দূর্বার না হবার কথা নয়। বেশ কয়েক বছর ধরে চর্চিত অভ্যাসে সুন্দর এবং কবি-সাহিত্যিক, ছাত্র-শিক্ষক, গায়ক-বাদক, জব সিকার, বাউন্ডুলে, দম্পতি আর প্রেমিক-প্রেমিকার শখের এই স্থান আজ বিরান। আচ্ছা, এই যে এতোগুলো মানুষের আয়-রোজগারের ব্যবস্থা হয়েছিলো এখানে, এরা এখন কেমন আছেন, কোথায় আছেন? বেপারির মন খারাপ হয়।

.

.

লোকজন হাঁটছে। ব্যায়ামটেয়াম করছে। বেপারির খুব ডাইয়্যা লাগে। পাছ-পাতার আড়াল ছেড়ে টাইলমোড়া একটি বেঞ্চের উপর দুই চিলতে রোদ পড়েছে। ওখানে বসে আদার বেপারি শান্ত নদের দিকে তাকায়। কিছুটা আরাম লাগে। প্রয়োজনীয় উষ্ণতা ধীরে ধীরে ফিরে আসে।। কিন্তু এই জায়গাটা এখন আর আগের মতো ভালো লাগে না।

.

"সমস্যা নাই, মিয়াভাই। দুই-চাইরদিন আসা-যাওয়া করলে দেখবাইন ঠিক অইয়া যাইবো।" বেপারি চমকে উঠে বলে, "আরে! তু…মি? তুমি কি সবাইরে মিয়াভাই কইয়া ডাকো নাকি মিয়া? এই লোকটা কীভাবে যেনো মানুষের মন রিড করতে পারে।

-হ। আপনের প্রশ্নগুলা আজাইরা।

কী কও মিয়া! কিসের প্রশ্ন?

-এই যে মনে মনে প্রশ্ন করতাছিলাইন এট্টু আগে। লাল-নীল চেয়ারগুলা কী দোষ করছিলো? কী দোষ করছিলো দোকানগুলা? আমি এগুলার উত্তর জানি।

তাইলে কও শুনি।

-প্রথম কতা অইলো, এইগুলান অবৈধ দোকান। প্রশাসন চায় না এখানে কোনো অবৈধ দোকানটোকান হোক। হোক সেইডা পার্কের মূল অংশের বাইরে, তাতে কী?

তো তোমার প্রশাসন, শহরের ফুতপাত দখলকারি দোকানওলাগরে ওঠায় না কেরে? এইখানে কয়শো দোকান ছিলো? পাঁচ-সাতটার বেশি তো নয়। তো অবৈধ হইলে ওগুলারে বৈধ কইরা নেওন যাইতো না? এখানে এগুলোর দরকার নেই মনে করার কারণের সাথে দরকার আছে কী কী কারণে সেইটা ভাবলো না?

– সেডা ভাইব্বাই তো এডা করছে। তাছাড়া অভিযোগ আছে এখানে কোনো কোনো দোকানে গোপনে নেশার বস্তু বিক্রি হয়। এবং স্কুল-কলেজ ফাঁকি দিয়া পোলাপান আড্ডা মারতে আসে সকালে, ভর দুপুরে।

অই মিয়া, অভিযোগ যার নামে আছে হেরে ধরা কী অসম্ভব ছিলো? অভিযোগের এই অজুহাতে সব দোকান এইভাবে হুট কইরা উঠাইয়া দেওয়ার দরকার ছিলো? আর এইটা উঠায়্যা দিলেই কি সকাল-দুপুরে আড্ডা মারা পোলাপাইন সব বাসায় যাইয়্যা বই লইয়া বইয়া পড়বো নাকি সারাদিন? শহরে এখন কত্তোগুলা রেস্টুরেন্ট হইছে তোমার মাথায় আছে? ওইগুলা কি পার্কের চাইতে কম সুবিধার জায়গা?

-কী জানি মিয়াভাই, আমার মনে অইলো কইলাম। ওহ্‌ ওই যে পার্কের বিতরে দুইটা বড়ো দোহান আছে, ওগুলাতে বিক্রি কম তাই এগুলা বন্ধ করছে এমনও হইতে পারে। আবার নতুন ডিসি আইছে, হে যে আইছে, এইটা জানান দেওনের জন্যও এইটা করতে পারে।

ধুর মিয়া, ফাইজলামির আর জায়গা পাইলা না। তোমারে একটু আগেও বুদ্ধিমান ভাবছিলাম এখন তো দেহি তুমি শালার একটা রাম ভোদাই। হুদাই আমার সময় নষ্ট করলা।

-মিয়াভাই, আপনে কি নিজের সময়ের দাম বোঝেন?

কী কইবার চাও?

-মানে আপনার যদি সময়ের দামই থাকতো, তাইলে এইখানে দোকান থাকলে কী আর না থাকলে কী—এগুলা লইয়া আপনে মাতা ঘামাইতেন না। আডাআডি কইরা চুপচাপ চইল্লা যাইতেন কামে। আদার বেপারি হইয়া জাহাজের খবর নিয়া লাভ কী?

.

কথাগুলো বলেই গল্পকার লোকটা হনহন করে হেঁটে গেলো। বেপারি চরম তাজ্জব হয়ে বসে রইলো। এ পাগলটা তার পেশার নামও জানে! তার ঘোর ঘোর লাগে। আমি দেখি, গল্পকার লোকটা একবারও পিছু তাকালো ন। বেপারিও ঘুরে বসে তার ঘোর লাগা চোখে সেই যে নিদের স্থির পানিতে তাকিয়ে আছে আর চোখ সরানোর নাম নেই। একটা বক বসেছে জলের ধারে। অথচ বেপারির মনে হচ্ছে ওটা একটা কাক। ময়মনসিংহ জং-এ জং-ধরা ইস্পাতের গায়ে যেমন বসে থাকতে দেখা যায়। আর আমি এদের কাণ্ড দেখলাম। এদের মানে ওই ঘোরের গল্পকার আর এই আদার বেপারির। এদের সম্পর্কে জানা হলো। আরও অনেক কথা আছে। সব কথা আমার জানার কথা নয়। ভাবারও কথা নয়। ঘোরের গল্পকার কিংবা আদার বেপারি— কারও কথাই আমি আর ভাবছি না এখন। আমার অতো সময় কই? খেয়েদেয়ে আমার কাজ আছে। এসব গল্পটল্প, পার্কটার্ক, লাল চেয়ার, ফুচকা চটপটি দিয়ে আমার কী?

.

অনেক দিন আগে নদের ওপার থেকে এপারের দৃশ্যকে ভিডিও করা হয়েছিলো।  এখনও আছে ওটা। ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে নদের বিভিন্ন চেহারা নিয়ে করা ওই ভিডিওর প্রথম কয়েক সেকেন্ডে এপারে এই বিরান জায়গাটার অতীত এক ঝলক দেখে নেওয়া যায়। গল্পটল্প, পার্কটার্ক, লাল চেয়ার, ফুচকা চটপটি দিয়ে আমার কী? মিয়ানমারের বাতাস অশূচি হয়ে আছে, অ্যালেপ্পোতে আবারও হামলা, মার্কিন মুলুকে ইলেকটরদের জোটের প্রস্তুতি, নাইজেরিয়ার অর্থনীতির খারাপ সময়, দুতার্তে পাবলিকের হিতার্তে মুখ ফসকে কী সব বলেছেন— সেসব দিয়ে আমার কী? খেয়েদেয়ে আমার কাজ আছে। বনে অনেক মোষ আছে।

https://www.youtube.com/watch?v=qNlAnGirpmY