ঘুড়িটা সেদিন সত্যিই যেনো উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিল আমাকে। চৈত্রে না বৈশাখে— ঠিক মনে নেই। উত্তরের মাঠে থৈ-থৈ বাতাস। ততক্ষণে উড়ো মেঘের আড়াল নিয়ে আমাদের কতিপয় ঘুড়ি রোদে-ছায়ায় অনেকটা দূর। সূতোর টানটা হাতের মুঠোয় পুরে ওই আসমানে চোখ। অনেক্ষণ ওভাবে তাকিয়ে ঘাড় ব্যাথা হতো কিনা মনে নেই, তবে হাত ব্যাথা করতো। আমাদের নাটাইগুলোর যান্ত্রিক সুবিধে কম ছিলো। কিন্তু সেদিনের দুর্ঘটনার কারণ সেটি নয়।
আকাশটা সেদিন একটু উদ্ভটই ছিলো। তবে তা ওরকম ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠবে তেমনটি কেউ বুঝিনি। বাতাস স্বাভাবিক। ঘুড়ি ওড়ছে। খাকি কাগজে তৈরী মজবুত চিলঘুড়ি। নাটাইয়ে টানটান নাইলনের সুতা। মুহূর্তে আরও আরও মেঘসব কোত্থেকে এসে রোদ খেয়ে নিলো। শহরে সন্ধ্যার মুখে বিদ্যুৎ চলে গেলে হঠাৎ আন্ধার যেমন, তার চেয়ে আরেকটু কম কালো আকাশটা সেদিন খুব থমথমে হলো না।
সাধারণত এ সময় বাতাস পড়ে যায়। খুব গরম লাগে। শরীর ঘামে। তবে যে দিনটির কথা বলছি, সেদিন ওরকমটি হবার ছিলো না। বাতাস বাড়তে লাগলো। দমকা এবং ঠাণ্ডা। ঘুড়ির জন্য ভয়। সুতা ছিঁড়ে উড়ে যদি যায়! বৃষ্টিতে ভিজে যদি যায়! আমাদের বুকের পাটা ভেতরে ভেতরে কম্পমান।
এতো দীর্ঘ সুতা দু-চার মিনিটে গুটিয়ে নেওয়ার মতো নয়। তার উপর বাতাস এমন ক্ষ্যাপাটে হলো যে, সুতাকে পেঁচানো তো দূরের কথা, নাটাইটাকে দুহাতে ধরে রাখতেই জান যায় যায়। এক পর্যায়ে ঘুড়ির অধিকার রক্ষার সংগ্রামে অক্লান্ত থেকেই টের পেলাম, পা ছেঁচড়ে নিজেও যাওয়া শুরু করেছি সুতার টানে। কোনো রকমে একটা গাছের শরীরে তুমুল সুতাটা পেঁচিয়ে নিজকে সামলানো গেছে অবশেষে। তার পরপরই ভয়ঙ্কর দু-চারটে বাউলি কেটে ঘুড়িটা বাঁধন ছিঁড়ে আলগা হলো। ছুটে গিয়ে চোখের আড়াল হতেই বৃষ্টি নামলো খুব। বৃষ্টিতে সান্ত্বনা মেলেনি।
এখন আতঙ্ক অন্য রকম। যেখানেই উৎসবের ভিড়, সেখানেই আতঙ্ক। আনন্দ আর আতঙ্ক মিলে কি উপভোগ্য হয়? হয় হয়। ভুতের গল্পে, ভুতের ছবিতে যেমন হয়। আমরা এটার নাম দিতে পারি শঙ্কানন্দ। বর্ষবরণের এই দিনে শঙ্কানন্দে ভাসবে বাংলাদেশ। শুভ কামনায় ছেদ পড়ে গেলেই বা কী আসে যায়! জীবন কতক মৃত্যুর লোভে কেবলই বেঁচে থাকে, অসভ্যের মতো। আজও কেউ কেউ কোথাও যাবে না। কেউ কেউ ঠিকই যাবে।