ওরা জল চায়, কাতরায়- তাতে আমাদের কী দায়?

কাজী শহীদ শওকত
Published : 11 June 2017, 11:29 AM
Updated : 11 June 2017, 11:29 AM

পৃথিবী উষ্ণতর হচ্ছে। বাতাসে সীসা বাড়ছে, বিষাক্ত গ্যাস বাড়ছে। জলের-মাটির-আকাশের অনেক প্রাণী মরে যাচ্ছে। নির্বংশ হয়ে যাচ্ছে। সামনে আরও বিপদ। কিন্তু আছি তো। এই যে আছি। বেঁচে আছি। কালও চাঁদ ওঠলো। সুপারি গাছের উপর থেকে জ্যোৎস্নার ঢল নামলো। এক ফোঁটা বাতাস বইলো না সারাদিন। না হয় হলোই না। সারাদিন জ্বললো আকাশ। জ্বললোই না হয়। তাপমাত্রা চল্লিশে গেলো। যাক না। ঘামে ঘামে দগদগে জীবন জলের গ্লাসে ভাসলো। ভালো তো। সামনে নাকি বিরাট বিপদ। হেন করা দরকার তেন করা দরকার। ডরের ডিলার দেশবিদেশে ডর সাপ্লাই দেয়। দিক না।

ডর বাড়ছে। প্রতিদিন চাপ বাড়ছে। ভাব কিংবা ভাঁপ বাড়ছে। ভালো থাকার খরচ বাড়ছে। মনে হয়, এতো আয়োজনে, বাতাস-মাটি-নদী বিষিয়ে এই যে এতো এতো উপাচারে মানব জীবন, তবু যেনো শেষমেষ মানাতেই পারছি না নিজেদেরকে! গাছেরা কিন্তু দিব্যি আছে। ঝলমলে পাতা, টকটকে লাল-হলুদ ইত্যাদি রঙের ফুলগুলো। পথের পাশে, মাঠে ঘাসগুলোও ঝলমলে সবুজ। এতো রোদ! পাতারা পুড়ে তো গেলো না। সালোক-সংশ্লেষণে আলোর ইউজার তাপে আরাম পাবে এমন তো নয়। আসলে কিচ্ছু হবে না। গাছেদের পাতা যেদিন একে একে সব মরতে থাকবে রোদে, সেদিন বুঝবো পরিবেশ বিপর্যয়ে পড়েছে। আমাদেরকে মূলত আরও মানিয়ে নিতে হবে'—এরকম অনুভূতি নিয়ে আরেক গ্লাস ঠাণ্ডা শরবতে গলা ভেজানো যায়। আরাম পাওয়া যায়।

অথচ তেমন মৃত্যুর ঘটনা ঘটে চলছে প্রতি নিয়তই। মানুষের মতো উদ্ভিদও রোদে পুড়ে। সামলে ওঠে। তবে খরা দীর্ঘ হলে আর পানির যোগান না পেলে এরা বাঁচে না। পৃথিবীর হাজার হাজার বর্গকিলোমিটার এলাকা খরায় মরুময় হয়ে পড়ে আছে, যেখানে এক সময় গাছ-পালা আর মানুষে মুখর ছিলো। সবুজ মরে গিয়ে বেঁচে গেছে। মানুষ যারা মরার সুযোগ পায়নি, তারা উদ্বাস্তু হয়েছে। সুতরাং ঘর, দোকান আর হাসপাতালের বাইরে চোখ মেলে সামান্য বাস্তব দৃশ্য সম্পর্কে জানা থাকলেও,  গ্লোবাল ওয়ার্মিংকে ডুম-মংগার তথা ভীতিজীবীর গালগল্প জ্ঞান করবার উপায় কোথায়?

খরার প্রভাব তীব্র হলে গাছেদের কেভিটেশন বা এম্বোলিজ্‌ম হয়। ধরুন, আপনি স্ট্র দিয়ে বোতল থেকে পানি পান করছেন, এমনি অবস্থায় স্ট্রয়ের ভেতর কিছু আটকে যাওয়ার ফলে অনেক শক্তি খরচ করেও চুমুক দিয়ে পানিকে গলার ভেতর নেয়া যাচ্ছে না — গাছেদের এ সমস্যাটি অনেকটা এরকম। এদের গোড়ার দিকে শরীরের অভ্যন্তরে জাইলেম নামক অসংখ্য নল থাকে। শেকড় থেকে আসা পানি, আর উদ্ভিদকোষের পরস্পরে মধ্যে এক ধরণের আকর্ষণ বা চাপ তৈরি হয়, ফলে ওই টিউবগুলোর ভেতর দিয়ে গোড়া থেকে পাতা অবধি তরল প্রবাহ নিশ্চিত করা সম্ভব হয়। এটি  ঠিকঠাক না করতে পারলে বৃক্ষজীবন সংকটাপন্ন হয়।

খরার সময় গাছের পরিবাহী এসব নলের ভেতর চাপ বেড়ে যায়, আর তখন  এগুলোর চারপাশে থাকা ফলে জলীয় অংশে বাব্‌ল (বাতাস-বল) তৈরি হয় যা জাইলেম নামক এসব নলের ভেতর দিয় তরলের ঊর্ধ্বমূখী প্রবাহকে বাধা দেয়। এই সমস্যাটিই হলো কেভিটেশন। গাছেরা এরকম কেভিটেশনের ছোটখাটো ধকল কুলিয়ে ওঠতে পারে। কিন্তু খরা প্রচণ্ড ও দীর্ঘ হতে থাকলে একসময় সমস্ত উদ্ভিদপ্রাণ দেহত্যাগ করতে বাধ্য হয়।

সুতরাং গাছেরা দাবদাহের দিনগুলোতে আরামেই থাকে, তেমনটি সত্যিই ভাবা যাচ্ছে না। আর হ্যাঁ, গাছেদের অনেক সহ্য ক্ষমতা। মানুষের ততোটা নেই। মানুষের বুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও নিজের জন্য, গাছেদের জন্য ক্রমাগত বিপদ ডেকে আনছে। অদূরদর্শী কর্মকাণ্ডে, স্বেচ্ছাচারে প্রকৃতিকে নির্যাতন করছেঃ গাছের ফল খাচ্ছে, গাছ কেটে আসবাব বানাচ্ছে, গাছেদেরকে জন্মস্থান থেকে উপড়ে ফেলে দিয়ে সেখানে গড়ে তুলছে দালাকোঠা, আরও কতো ধরণের নৃশংসতা! অথচ গাছ লাগানোয় মনযোগ নেই একদম। বট, অশ্বত্থ, বহেরা, হরিতকি, মণিরাজ  ইত্যাদিকে বাঁচানোর বৃহত্তর কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। তাই বলে ওদিকে বনসাই কিনে রুচিশীল প্রকৃতিসেবী কিংবা নান্দনিকতাপ্রিয় সাজবার আয়োজনে কার্পণ্য নেই কিন্তু মোটেও। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হারবেরিয়াম-এর ওয়েবসাইটে বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদের একটি তালিকা দেওয়া আছে। প্রতিষ্ঠানের নামের মতো এই তালিকাটিও ইংরেজিতে প্রণীত। এ মাসেই প্রতিষ্ঠানটির একটি প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজ শেষ হবার কথা। প্রকল্পের নাম 'সার্ভে অব ভাস্কুলার ফ্লোরা অব চিটাগাং এ্যণ্ড দ্য চিটাগাং ট্রাক্টস্‌।' মাতৃভাষার প্রতি প্রতিষ্ঠানটির দরদ মুগ্ধকর না হোক, কাজগুলো সুষ্ঠুভাবে হোক–এই আশাবাদ আছে। হারবেরিয়ামের কার্যক্রমের তালিকা খুব খাটো নয়-

অনুন্নয়ন কার্যক্রম

বিদেশি গাছের যথেচ্ছ অনুপ্রবেশে দেশীয় বিভিন্ন জাতের গাছগাছালির উপর কী প্রভাব হচ্ছে সেটি খতিয়ে দেখবার ইচ্ছে থাকলেও উদ্যোগ নেই বলে জানি। প্রজাতি সংরক্ষণে আন্তরিকতার উদাহরণ হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের বোটানিক্যাল গার্ডেনের সৌখিন প্রয়াসের উল্লেখ উজ্জ্বল হয়ে আছে। এছাড়াও কদিন আগে মিডিয়াতে চাউর হওয়া বিলুপ্তপ্রায় উদ্ভিদ সংরক্ষণে অভিনব উদ্যোগ শিরোনামের খবরে মন ভরেছে। পাশাপাশি অভিনব নয় এমন আরও ব্যাপক ভিত্তিক উদ্যোগে ঘুচে যেতে পারে অনেক অবহেলা। সাফল্যের গল্পগুলো আমাদের জানা চাই। ডকুম্যান্টেশন, সর্টিং, স্যাম্পলিং, রিসার্চ কার্যক্রমের বাইরে, আমাদের দেশি গাছেদের বিলুপ্তি ঠেকাতে উদ্যোগের ছিঁটেফোঁটা, ঘনঘটা সকলকে নাড়িয়ে দিক।

যা হোক, কেভিটেশনের কথায় ফিরে আসি। গাছের যখন এ অবস্থা চলে তখন গাছের ভেতর থেকে এক ধরণের শব্দ আসে যা কেবল যান্ত্রিক উপায়ে শ্রবণোপযোগি করা যায়। বছর চারেক আগে ফ্রান্সের বিজ্ঞানীরা খরা কবলিত গাছেদের কান্নার আল্ট্রাসনিক আওয়াজ শুনতে পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন। ই শব্দকে এর আগে বিজ্ঞানীরা পাত্তা দেননি। গাছের ভেতর থেকে ওই শব্দ আসলে খরায় মরতে বসা গাছের ভেতর যন্ত্রণার শব্দ। গাছেদের কেভিটেশন নামক কান্নায় যেনো মানুষের নামে অভিশাপ বেজে ওঠে। কথা হলো, গাছপালা-লতাপাতার সবুজকে সাথে নিয়েই বাঁচতে হবে; নয়তো কী হতে পারে তার কিছু নমুনা ইতোমধ্যে খুব স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে