বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্র কৌশলগত অংশীদারিত্ব চুক্তিঃ যৌক্তিকতা এবং ভবিষ্যৎ

খালিদ
Published : 12 July 2012, 01:18 PM
Updated : 12 July 2012, 01:18 PM

ধারাবাহিক কূটনৈতিক ব্যার্থতা এবং আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সরকারের অসঙ্গত আচরণ স্বত্বেও বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ প্রকাশ এবং উক্ত সিদ্ধান্তের উপর এখনো পর্যন্ত অবস্থান আমাদের জন্য রীতিমত সৌভাগ্যের।­ 'কৌশলগত অংশীদারিত্ব'র ক্ষেত্রে অনেক দ্বিমত থাকলেও একথা নিশ্চিত যে সম্পর্ক উন্নয়নে লাভ ব্যাতিত কোনরূপ ক্ষতি নেই। কথাটা বাংলাদেশের মত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।

বিশ শতকের শেষের দিকে এসে একাধিক নতুন শক্তির উত্থান ঘটলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সব চেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হিসেবে বৈশ্বিক রাজনীতিতে এখনো পর্যন্ত আপন ছড়ি ঘুরিয়ে চলেছে। তাই এই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র মন্ত্রীর প্রতিটি পদক্ষেপের দিকে রয়েছে মিডিয়া থেকে শুরু করে আলোচক, সমালোচক এবং সর্বোপরি বিশ্বের সকল মানুষ না হলেও সকল মানুষের প্রতিনিধির চোখ। কারন এর মাধ্যমেই আসলে মার্কিন প্রশাসনের বৈদেশিক নীতির বহিঃপ্রকাশ ঘটে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই উক্ত পদে নিয়োগপ্রাপ্ত যেকোন ব্যাক্তিই প্রতিটি পদক্ষেপ গ্রহন করেন সব দিক থেকে পরিপূর্ন হিসাব নিকাশের পর। তাই বাংলাদেশ বর্তমান ওবামা প্রশাসনের কাছে গুরুত্বপূর্ন কিনা এই সরল প্রশ্নের সহজ উত্তর ২০০৩ সালের মার্কিন সেক্রেটারী অব স্টেস কলিন পাওয়েলের ঢাকা সফরের পর গত ৫ মে ২০১২ একই পদে অধিষ্ঠিত হিলারী ক্লিন্টনের ঢাকায় আগমন। চীন থেকে কলকাতা হয়ে দিল্লী যাওয়ার পথে তাঁর ঢাকায় কিছু সময়ের অবস্থানের প্রভাব মোটেও কিছু সময়ের জন্য নয়। বরং অনেকেই এই ঘটনাকে বাংলাদেশের প্রতি মার্কিন নীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন হিসেবে দেখছেন। তবে পরিবর্তনটি ইতিবাচক নাকি নেতিবাচক তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ রয়েছে।

'কৌশলগত অংশীদারিত্ব সংলাপ (Strategic Partnership Dialogue)' এর ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সাড়া দেওয়াকে যারা 'মেরুদন্ড সমস্যা' বলে উল্লেখ করছেন এবং যারা এটিকে বাংলাদেশের জন্য অপার সম্ভাবনা হিসেবেও দেখছেন উভয়পন্থীদের মার্কিন প্রশাসনের এধরনের আহ্বানের মূল উদ্দেশ্য বিবেচনায় রাখতে হবে ।

সম্প্রতি অনেকটা খোলাখুলি ভাবেই ওবামা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘোষনা এসেছে যে যুক্তরাষ্ট্র প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে তাদের প্রভাব বৃদ্ধি করতে চায়। এর কারন যে নব্য পরাশক্তি চায়না, সেটিও স্পষ্ট। এধরনের পদক্ষেপ মার্কিন ইতিহাসে একেবারে নতূন না হলেও সম্ভবত এবার দেশটি একটু অন্যভাব এগুতে চাইছে। সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ক্ষেত্রে যেমন সামরিক জোট গঠনের দৃষ্টান্ত দেখা গিয়েছিল ঠিক ঐধরনের কিছু চায়নার ক্ষেত্রে আমাদের চোখে পড়ছে না। বরং প্রতিটি দেশের সাথে পৃথক ভাবেই সম্পর্ক উন্নয়নে আগ্রহী যুক্তরাষ্ট্র। আবার অনেক বিশ্লেষকের মতে বৃহদ শক্তিসমুহের তুলনায় বর্তমানে তারা ক্ষুদ্র রাষ্ট্র সমূহের সাথে সম্পর্ক উন্নয়নে বেশি সচেষ্ট।

শুধুমাত্র বাংলাদেশের দিক থেকে বিচার করলে আমাদের কয়েকটি ভিন্ন বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আসা প্রয়োজন। সাম্প্রতিককালে কৌশলগত অংশিদারিত্ব বিষয়টি গুরুত্ব লাভ করলেও যুক্তরাষ্ট্র সেই সাথে অর্থনৈতিক ও প্রাকৃতিক সম্পদ সংক্রান্ত ব্যাপার গুলোতে যথেষ্ট আগ্রহী। যুক্তরাষ্ট্র যেমন বাংলাদেরশের পোষাক শিল্পের
একজন বড় ক্রেতা একই সাথে প্রাকৃতিক সম্পদ আহরণের ক্ষেত্রেও কয়েকটি মার্কিন কোম্পানীর সম্পৃক্ততা রয়েছে। তাছাড়া সম্প্রতি মায়ানমারের সাথে সমুদ্রসীমা নিয়ে বিরোধ নিস্পত্তি হওয়ায় এবং ২০১২ সালে ভারতের সাথেও এধরনের একটি সামাধানে আসার সম্ভাবনা থাকায় স্বাভাবিক ভাবেই বাংলাদেশ তথা বাংলাদেশের সীমানাধীন বঙ্গোপসাগরের গুরুত্ব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ আরো অনেক দেশের কাছেই বৃদ্ধি পেয়েছে।

নিজস্ব স্বার্থ রক্ষা হচ্ছে না এধরনের কোন সিদ্ধান্ত গ্রহন রাষ্ট্রীয় আচরনের সাথে সামাঞ্জস্যপূর্ণ নয়। তাই কৌশলগত অংশিদারিত্বের আহ্বানের পেছনে যেমন মার্কিন স্বার্থ জড়িত একই ভাবে উক্ত আহ্বানের বিপরীতে সবুজ সংকেত প্রদর্শনের পেছনে বাংলাদেশের স্বার্থও নেহাত কম নয়। প্রথমত সম্পর্ক উন্নয়নের আহ্বানে সাড়া না দেওয়া বা অনাগ্রহ প্রকাশ করা স্বাভাবিক ভাবেই সম্পর্ক অবনতির কারন হয়ে দাঁড়ায়। আর যুক্তরাষ্ট্রের মত পরাশক্তির সাথে শীতল সম্পর্ক কখোনই আমাদের মত তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের জন্য সুবিধাজনক অবস্থান নয়।

এখন প্রশ্ন হলো এধরনের আহ্বাবানে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের কি ধরনের স্বার্থ সংরক্ষিত হচ্ছে। প্রথমত ক্ষুদ্র রাষ্ট্র হিসেবে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের অবস্থান যদি আমরা সুদৃঢ় করতে চাই তবে অবশ্যই কোন একটি পরাশক্তির সুস্পষ্ট সমর্থন প্রয়োজন। আর এই ধরনের সমর্থন আমেরিকার কাছ থেকে আশা করা আমাদের জন্য সহজ হতে পারে এই কৌশলগত অংশিদারিত্ব চুক্তি স্বাক্ষর এবং তার সুষ্ঠ বাস্তবায়নের মাধ্যমে।

পরিবেশ বিষয়টি যদি ধর্তব্যের ভেতর নেই তবে এই ধরনের চুক্তির প্রয়োজনীয়তা আমরা আরো ভালোভাবে উপলব্ধি করব। পরিবেশ প্রশ্নে আমরা পুরোপুরিভাবে পরনির্ভরশীল। আর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে থাকা একটি সুষ্ঠ সম্পর্ক এক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করবে বলেই আশা করা যায়।

তাছাড়া গত ৫ মে ২০১২ তারিখের হিলারী ক্লিনটন ও দীপু মণি কর্তৃক স্বাক্ষরিত চুক্তি অনুযায়ী এই দু'টি দেশ প্রতি বছর যে সংলাপে বসতে যাচ্ছে তাতে নিজেদের দ্বিপাক্ষিক বিষয় সমূহ ছাড়াও বাংলাদেশের পক্ষে আরো কিছু বিষয়ের বিশেষত কিছু সমস্যা সমূহের অবতারনা করার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে যেগুলো হয়তো মার্কিন প্রশাসনের পক্ষে সমাধান করা সম্ভব হবে।

পর্যাপ্ত পরিমানে সুবিধা থাকলেও এধরনের চুক্তি স্বাক্ষরের পর নিশ্চিন্ত থাকবার কোন কারন নেই। ১৩ মে, ২০১২ তারিখের নিউ এজ পত্রিকার রিপোর্ট অনুযায়ী হিলারীর সফরের পর 'একুইজিশন এ্যান্ড ক্রস সার্ভিসিং এগ্রিমেন্ট' নামে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সামরিক চুক্তি সম্পাদনের জন্য চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্রের 'ব্যুরো অব পলিটিক্যাল-মিলিটারী এফেয়ার্স' এর সহকারী সেক্রেটারী এন্ড্রু জে শেপিরো গত ১৯ এপ্রিল ঢাকা সফর করার পর গত ২৪ এপ্রিল ওয়াশিংটনে এক বক্তৃতায় বলেন, 'এই আধুনিকীকরণ কর্মসূচি আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা সম্প্রসারণের সুযোগ দেবে…আমাদের বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র সহযোগীদের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে।' এই ধরনের আলোচনা মোটেও স্বস্তি পাওয়ার মত কোন বিষয় নয়।

নিজস্ব সুবিধার ব্যাপারটি বাংলাদেশকে সকল দিক থেকে বিবেচনা করতে হবে। এক পরাশক্তির নেক নজর অর্জন করতে গিয়ে অন্যের চক্ষুশূল হয়ে ওঠার ভেতর কোন যৌক্তিকতা নেই। অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী কোন দেশের সাথে কোন ধরনের চুক্তিতে আসা মানে যদিও উক্ত দেশের তাবেদার রাষ্ট্রে পরিনত হওয়া নয় তবে ব্যাপারটি একেবারে অসম্ভবও নয়। তার মানে দাড়াচ্ছে আপন স্বার্থেই আমাদের সকল পক্ষকে যতদুর সম্ভব খুশি রাখতে হবে। 'বাংলাদেশকে সঠিক সময়ে সঠিক তাসটি খেলতে হবে।' অর্থাৎ পরিবর্তনরত বিশ্ব রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আমাদের সুযোগ নেওয়ার অনেক সুযোগ থাকলেও ভূল করার কোন সুযোগ নেই। তবে এসব কিছুর ভয়ে নিজেদের গুটিয়ে রেখেও লাভ নেই। ভবিষ্যতে মাথা ব্যাথা হবার ভয়ে মাথা কেটে ফেলা নিঃসন্দেহে কোন বাস্তবধর্মী সিদ্ধান্ত নয়।