ভর্তি পরীক্ষা প্রসঙ্গঃ লাভ ক্ষতির হিসেব

খালিদ
Published : 14 August 2012, 05:28 PM
Updated : 14 August 2012, 05:28 PM

সরকারী এবং বেসরকারি মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজগুলোতে এখন থেকে এইচএসসি এবং এসএসসি এর জিপিএ -এর ভিত্তিতে শিক্ষার্থী ভর্তি করার সিদ্ধান্ত হলো। সেটা ঠিক না ভুল সেই বিচার করার পূর্বে আমাদের এর গুরুত্ব নির্ধারন করতে হবে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে দেশের উচ্চ শিক্ষার বলতে গেলে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল এই মেডিকেল কলেজ গুলো।

আমাদের দেশে ছেলেমেয়েদের ছোটবেলা থেকেই 'জীবনের লক্ষ' রচনা মুখস্ত করানোর মাধ্যমে তাদের ডাক্তার হওয়ার স্বপ্ন দেখতে শেখাই আমরা। যার কারনে জীবনের লক্ষ নির্ধারন করার মত কঠিন কাজটি যারা করতে পারে না তাদের বেশিরভাগ ভবিষ্যতে নিজেকে একজন ডাক্তার হিসেবে দেখতে বেশি আগ্রহী, বিশেষত সামাজিক দিক থেকে তুলনামূলকভাবে পিছিয়ে থাকা মেয়েরা।

তাই নিঃসন্দেহে মেডিকেল কলেজ গুলো যেমন একদিক থেকে মানুষের স্বপ্ন গড়ার কারখানা তেমনি আসন সঙ্কটের কারনে অসংখ্য ছাত্র ছাত্রীর স্বপ্ন ভাঙার কেন্দ্রবিন্দুও। সে কারনে এই সকল প্রতিষ্ঠানে ভর্তি'র পদ্ধতি নির্ধারনে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সর্বাধিক সতর্কতা অবলম্বন করা উচিৎ, আশা করি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তাবৃন্দ তা করেছেনও।

মানুষের ভেতর প্রতিক্রিয়া আমরা মিশ্র দেখতে পাই। এটা ঠিক যে যেকোন সিদ্ধান্তের কিছু ভালো এবং কিছু খারাপ দিক থাকেই। তবে উক্ত সিদ্ধান্ত বহাল রাখা হবে কিনা তা নির্ভর করবে দেশের মানুষ কি চায় এবং সিদ্ধান্তের ভালো এবং খারাপ দিকের অনুপাতের উপর।

মেডিকেল ও ডেন্টাল কলেজে ভর্তির ব্যাপারে স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের সিদ্ধান্ত অনেকেই সমর্থন করছে ঠিকই তবে তারা সংখ্যার দিক থেকে সংখ্যাগুরু নয়। তাদের সমর্থন করার কারন এই সিদ্ধান্তের ফলে কোচিং বাণিজ্য, প্রশ্ন ফাঁশ কিংবা সরকারি ব্যায় সংকোচনের মত কিছু দিক। কিন্তু সেই সাথে আমাদের উক্ত সিদ্ধান্তটির খারাপ দিকগুলোও বিবেচনায় নিয়ে আসতে হবে যেমনটি আমি আগে বলেছি। আর সেই ক্ষতিকর দিক গুলো প্রশমনের মাধ্যমেই আমরা একটি ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে পারি।

এখন প্রশ্ন হলো মেডিকেল ভর্তি প্রশ্নে প্রশাসনের সিদ্ধান্ত সঠিক কিনা, যাদের জন্য এত কিছু সে শিক্ষার্থী বৃন্দ ব্যাপারটিকে কীভাবে দেখছে?

কিছু সুবিধার পাশাপাশি স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের এই সিদ্ধান্তে মারাত্মক কিছু গলদ পরিলক্ষিত হচ্ছে। প্রথমত এই ধরনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত এমন সময় নেওয়া হলো যখন মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীবৃন্দ তাদের প্রস্তুতি প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে যাদের ভেতর দ্বিতীয়বার ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে ইচ্ছুক গত একবছর যাবত কঠোর পরিশ্রমকারী ছাত্র-ছাত্রীও রয়েছে, কোচিং সেন্টার গুলো হাতিয়ে নিয়েছে প্রচুর টাকা এবং সর্বোপরি পরীক্ষার আর মাত্র কয়েক মাস বাকি ছিলো বলেই সকলের ধারনা ছিলো। এই দিক থেকে তাই সিদ্ধান্ত সঠিক কি বেঠিক সেটি তর্কসাপেক্ষ হলেও নিঃসন্দেহে তা সময় অনুপযোগী।

পাশাপাশি লক্ষ লক্ষ জি পি এ ৫ প্রাপ্ত শিক্ষার্থী'র ভেতর থেকে কিভাবে যোগ্যদের নির্বাচন করা হবে সেই ব্যাপারেও কিছু পরিষ্কার করা হয়নি। যার কারনে অনেকেই এর ভেতর অনেক কিছুর গন্ধ পেতে শুরু করেছেন। সেই সাথে আমাদের একটি ব্যাপারও মাথায় রাখতে হবে যে এইচ এস সি কিংবা এস এস সি পরীক্ষার মান আমাদের দেশে বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ। বেশিরভাগ জিপিএ ৫ প্রাপ্ত ছাত্র ছাত্রী ভর্তি পরীক্ষায় অংশগ্রহন করেও যখন মেডিকেল কলেজ গুলোতে নিজেদের সুযোগ করে নিতে ব্যার্থ হয় তখন মাধ্যমিক এবং উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার মান সম্পর্কিত আমাদের ধারনাটির ভীত আরো মজবুত হয়। মাধ্যমিক এবং উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে পর্যাপ্ত সংস্কার সাধন না করেই এই ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া গাছের গোড়া কেটে আগায় জল ঢালারই নামান্তর, যেই গাছ থেকে সুমিষ্ট ফলের আশা করা আকাশ কুসুম কল্পনার চেয়ে বেশি কিছু নয়। এমত অবস্থায় সেই পর্যায়ের সেই জিপিএ জিনিসটিকেই সর্বাধিক গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত প্রশাসন কেন নিলো সেটি একটি বড় প্রশ্ন।

বিক্ষোভ ব্যাপারটি আমাদের জন্য বর্তমান সময়ে একটি সাধারন ঘটনা হয়ে উঠেছে। শ্রমিক বিক্ষোভ থেকে শুরু করে ছাত্র বিক্ষোভ, সাংবাদিক বিক্ষোভ ইত্যাদি একের পর এক লেগেই আছে। বর্তমানে তার সাথে একটি নতুন বিক্ষোভ যুক্ত হয়েছে, আর তা হল মেডিকেল ভর্তিচ্ছু শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ। কিন্তু সেটা করে কতটুকু লাভ হবে জানা নেই। কারন, ঐযে বললাম বিক্ষোভ আমাদের বর্তমান সময়ে একটি অতি সাধারণ ঘটনা। সরকার বিক্ষোভ ব্যাপারটির সাথে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছে। এই বিক্ষোভ ব্যাপারটির সাথে একটি ব্যাপার গভীর ভাবে সম্পৃক্ত, সেটি হল পুলিশের লাঠি চার্জ। মেডিকেল ভর্তি ইস্যুতে অবশ্য সেই ধরনের কিছু দেখা যাচ্ছে না, তবে দেখা গেলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই। প্রশাসনের ভাষ্যমতে এই বিক্ষোভ সমূহের পেছনে কোচিং সেন্টার গুলোর ইন্ধন রয়েছে ঠিকই কিন্তু এই ধরনের সিদ্ধান্তের সাথে সকলে যাতে করে মানিয়ে নিতে পারে তার জন্য সময়ের প্রয়োজন, প্রয়োজন প্রস্তুতি যা কারোরই ছিলো না। যার কারনে অনেকটা নিজের তাগিদেই অনেকে রাজপথে নেমে এসেছে। তাই তাদের এমন মুহূর্তে যে একজন সরকারী উচ্চপদস্থ ব্যাক্তি 'ঘরে বসে মুড়ি খাওয়ার এবং সিনেমা দেখা'র পরামর্শ দিলেন তা সমর্থন করা যাচ্ছে না।

তবে ব্যাপারটা আদালতে গড়ালেও প্রথম থেকেই প্রশাসনকে তেমন কঠোর হতে দেখা যাচ্ছে না। সরাসরি 'হবে না' এমন করে এখনও সম্ভবত কেউ বলেনি। কিন্তু আদালতের রায়ের উপর অনেকে নির্ভর করলেও সেই পরিমান সময় আমাদের হাতে নেই। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের পরীক্ষা এগিয়ে আসছে। এমন সময় এরকম একটি অযাচিত সিদ্ধান্ত সত্যই দুঃখজনক। আমরা সকলে আশা করবো সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে শিক্ষার্থীদের এই ধরনের হয়রানি থেকে মুক্ত করবে প্রশাসন অতি অল্প সময়ের ভেতর। অন্তত নতুন এই পদ্ধতি কিছুদিনের জন্য পিছিয়ে না দিলে সবকিছু গোলমাল হয়ে যাবে। সেই আভাসই চতুর্দিক থেকে পাওয়া যাচ্ছে।