লতিফ সিদ্দিকী’র পতন এবং অস্পষ্টতা

খালিদ
Published : 4 Oct 2014, 04:36 PM
Updated : 4 Oct 2014, 04:36 PM

আওয়ামী লীগ দলটি আচরণগত কারণে নিজেদের জনপ্রিয়তা হারালেও তাদের দলীয় অবস্থান দেশের অন্য যেকোন দলের তুলনায় বর্তমানে অনেক বেশি শক্তিশালী। এই মুহুর্তে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী এই দলটিতে রয়েছে পর্যাপ্ত যোগ্য ব্যক্তি এবং শক্তিশালী নেতৃত্ব। যার কারণে 'ক্রাইসিস ম্যানেজমেন্ট' ব্যাপারটা তারা একের পর এক বেশ দক্ষতার সাথেই করে চলেছে। সেই শাহবাগ আন্দোলন থেকে শুরু করে দেলোয়ার হোসেন সাইদী'র কারাদণ্ডের রায় পর্যন্ত প্রত্যেকটি পর্যায়ে আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের দক্ষতা আমাদের নজরে আসে। এসব কিছু বিবেচনায় নিয়ে আমরা বলতে পারি এই সরকারের বিগত শাসনামলে পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয়ের এবং বর্তমান আমলে ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব উন্মাদ কোন ব্যক্তি পাবেন না। এছাড়া লতিফ সিদ্দিকী'র দীর্ঘ রাজনৈতিক ক্যারিয়ার সম্পর্কে আমরা সকলে বেশ ভালো ভাবেই অবগত। বেশ ঝানু রাজনীতিক হিসেবে আমরা সকলেই তাকে চিনি। এই ঝানু রাজনীতিকদের একটি অত্যাবশ্যকীয় বৈশিষ্ট হচ্ছে তাঁরা 'পাব্লিক সেন্টিমেন্ট' ব্যাপারটা বেশ ভালো বোঝেন। উদাহরণ হিসেবে 'দেশ চলবে মদিনা সনদ অনুযায়ী' মাননীয় প্রধান মন্ত্রী'র এই উক্তিকে সামনে আনতে পারি। কিন্তু, কেন জনাব সিদ্দিকী এমন একটি বক্তব্য হঠাৎ করে বসলেন যেটি 'পাব্লিক সেন্টিমেন্ট'- এর উপর আঘা হানে তো বটেই, খোদ প্রধানমন্ত্রীর জন্য যা সরাসরি অপমানজনক। শেখ হাসিনা নিজে বেশ কয়েকবার ঘটা করে হজে গিয়েছেন সেকথা কে না জানে। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রী পুত্র, যাকে অনেকে কৌতুক করে রাজপুত্র বলে থাকেন, সেই সজিব ওয়াজেদ জয়কে নিয়েও জনাব লতিফের বক্তব্য আওয়ামী প্রসাশনের একেবারে আঁতে ঘা দিয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছেন, এমন কেন হল?

উত্তর অনেকেই খুজে ফিরবেন 'প্রথম আলো'র গত এক তারিখের প্রধান শিরোনামে। 'লতিফ সিদ্দিকীর ৪৬ অনিয়ম।' বর্তমান সরকারের বিগত আমলের পাঁচ বছরে বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় ৪৮টি সরকারি প্রতিষ্ঠান বেসরকারি খাতে হস্তান্তর বা বিক্রি করেছে। এ সময় দুটি ছাড়া বাকি সব প্রতিষ্ঠান বিনা দরপত্রে, অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায়, বিনা মূল্যে বা কম মূল্যে বেসরকারীকরণ বা বিক্রি করা হয়। সেই সময়ের জনাব সিদ্দিকী বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এককভাবে সিদ্ধান্ত নিয়ে এ ধরনের কর্মকাণ্ড করেছেন। এ কারণে গত ২২ ফেব্রুয়ারি তাঁর মন্ত্রণালয়ের ওপর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কমিটি গঠন করা হয়। মূলত বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সম্পত্তি বেসরকারীকরণের ক্ষেত্রে আইন ও বিধি মানা হয়েছে কি না এবং চুক্তির শর্ত মেনে সম্পত্তি বিক্রি বা হস্তান্তর হয়েছে কি না, তা যাচাই করার জন্যই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মহাপরিচালক পবন চৌধুরীকে প্রধান করে এই কমিটি গঠন করা হয়েছিল। জনাব সিদ্দিকী'র অনিয়মের ফিরিস্তি দিয়ে যে কমিটি গত ৩১ আগস্ট তাদের প্রতিবেদন তৈরি করে। গত ১৫ সেপ্টেম্বর প্রতিবেদনটি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে পাঠানো হয়েছে। বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয়ের সচিব ফণীভূষণ চৌধুরী সেই প্রতিবেদন পেয়েছেন বলেও স্বীকার করেছেন। যথাযথ মূল্য নির্ধারণ না করা, বিনা দরপত্রে হস্তান্তর, কেবল মন্ত্রীর সিদ্ধান্তে বিনা মূল্যে স্থায়ী বন্দোবস্ত দেওয়া, বিক্রির আগে অর্থনৈতিক সম্পর্কবিষয়ক মন্ত্রিসভা কমিটির অনুমোদন না নেওয়া, বিক্রির শর্ত না মানা, আইনগত জটিলতা নিরসন না করেই হস্তান্তর এ সকল অভিযোগ একত্রিত করলে যা দাঁড়ায় তা হচ্ছে মন্ত্রী মহোদয় সে সময় কারো পরোয়া করেননি।

বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি অনুযায়ী ক্ষমতায় গিয়ে কেউ সৎ থাকুক কিংবা অসৎ হোক সেটা তেমন কোন ব্যাপার নয়। তবে যেই উপর মহলের বদান্যতায় আপনি ক্ষমতা অর্জন করছেন তাকে সন্তুষ্ট রাখতে হবে। জনাব সিদ্দিকী সম্ভবত সেটি করতেই ব্যর্থ হয়েছেন। সরকারের পাওনা বিপুল অঙ্কের সুদ একক সিদ্ধান্তে মওকুফ করেন এই মন্ত্রী। বেশ কিছু কারখানা অবিশ্বাস্য কম মূল্যে বিক্রি করা হয়েছে। ফলে সরকার পায়নি তেমন কিছুই। এখন সরকার টাকা না পাওয়ার অর্থ হচ্ছে মন্ত্রী মহোদয় ব্যাতিত আরো অনেকের অনেক কিছু না পাওয়া। সেক্ষেত্রে উপর মহল থেকে অনেকেই জনাব সিদ্দিকী'র উপর নাখোশ হবেন সেটাই স্বভাবিক। এখন মজার ব্যাপার হচ্ছে তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য সেই নাখোশ হবার খবর লতিফ সাহেবের কাছে থাকবেই। আর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের কমিশন কি ধরণের প্রতিবেদন পেশ করেছে সেটাও জনাব সিদ্দিকীর অগোচরে ছিলোনা যখন তিনি হজ, তাবলীগ ও সজীব ওয়াজেদ জয় সম্পর্কে সেই বহুল আলোচিত মন্তব্য করেছিলেন। অনেকেই মনে করেন অতিমাত্রায় আত্ম অহমিকা বোধের কারণেই তিনি এমন বক্তব্য প্রদান করেছেন যে স্বভাবজাত দোষটি তিনি পেয়েছেন পারিবারিক ভাবেই। ছোট ভাই কাদের সিদ্দিকী ও পিতা অ্যাডভোকেট আলি সিদ্দিকীও এ ধরণের অহমিকাবোধের উদাহরণ সৃষ্টি করে আলোচনার জন্ম দিয়েছেন একাধিকবার। কিন্তু এই যুক্তির প্রতিযুক্তি হচ্ছে লতিফ সিদ্দিকীর মত একজন অভিজ্ঞ রাজনীতিক কখনো শুধুমাত্র নিজের আত্মগরিমার বশবর্তী হয়ে এমন কোন আলোচনার জন্ম দেবেন না যার ফল স্বরুপ তাকে মন্ত্রীত্ব খোয়াতে হবে। এটা কি তবে সময় ফুরিয়ে আসছে জেনে শেষ ধাক্কা দেওয়া? নাকি অন্য কিছু? এই ডামাডোলের মাঝেই যে গ্যাসের দাম বাড়ানো হয়েছে সে সম্পর্কে কি আমরা অবগত?