আদিম লতাগুল্মময় শেকসপিয়রের নগ্ন প্রদর্শনী

বিপাশা চক্রবর্তীবিপাশা চক্রবর্তী
Published : 5 June 2016, 06:45 AM
Updated : 5 June 2016, 06:45 AM

না সেদিন আকাশ ভেঙ্গে পড়েনি মাটিতে। মান সম্মান আর রীতিনীতির সুতোয় বোনা সভ্যতার চাদরও টুটে যায়নি কোথায়ও। সেদিন সূর্যাস্তের ঘন্টাখানেক আগে। নিউইয়র্ক শহরের সেন্ট্রাল পার্কের সবচেয়ে উঁচু যে জায়গাটি সামিট রক, সেখানে তারা জড়ো হলেন। আট জন অসাধারণ অভিনয়শিল্পী, তিন জন মেধাবী নৃতশিল্পী ও দক্ষ দুইজন বাদ্যযন্ত্রী। ১৩ জনের সবাই নারী । তারা প্রদর্শন করলেন উইলিয়াম শেকসপিয়রের অমরকীর্তি জাদু আর বিভ্রমের নাটক 'দ্য টেমপেস্ট'। খোলা আকাশের নিচে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে। অভিনয় করলেন নগ্ন হয়ে। সম্পূর্ণ নগ্ন বলতে যা বোঝায়–উলঙ্গ হয়ে। পুরো দু'ঘন্টা। মাত্র একশ গজ দূর থেকে শুরু হয়েছে দর্শকের সারি। পার্কে আগত স্থানীয় লোকজন, পর্যটক, ছেলেবুড়ো নারী পুরুষ সব মিলিয়ে প্রায় ২০০ জন দর্শনার্থী। উপভোগ করলেন অভিনব কায়দায় উপস্থাপিত ঐতিহাসিক নাটকটি। কিন্তু এ ঘটনা ২০০ জন দর্শকের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকল না। ছড়িয়ে গেল সারা পৃথিবীতে। দ্য ইন্ডিপেনডেন্ট, দ্য গার্ডিয়ান, দ্য ডেইলী মেইল, নিউ ইয়র্ক নিউজ ডে'সহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ পত্রিকা আর অগুনতি ওয়েবসাইটের মাধ্যমে। বেশ গুরুত্ব দিয়ে তারা প্রকাশ করল 'দ্য টেমপেস্ট' নাটকের এই বিশেষ প্রদর্শনীর কথা। একদিন না পরপর দুদিন। একইস্থানে ১৯ ও ২০মে হল এই প্রদর্শনী। ঝড় আর বৃষ্টির পূর্বাভাস থাকা সত্ত্বেও রচিত হল ডাকিনীবিদ্যা আর ষড়যন্ত্রের ইন্দ্রজাল 'দ্য টেমপেস্ট'। মহান নাট্যকার ও কবি শেকসপিয়রের ৪০০তম মৃত্যুবার্ষিকী পালিত হয়েছে ২০১৬ তে। এ উপলক্ষে সারা বিশ্ব জুড়ে নেয়া হয়েছে নানা কর্মসূচী। এমনকি প্রকাশনী সংস্থা হোগার্থ-এর উদ্যোগে 'দ্য টেমপেস্ট' কে একুশ শতকের পাঠকের জন্য নতুন রূপে পরিচয় করিয়ে দিতে উপন্যাস আকারে লিখছেন বর্তমান সময়ে জনপ্রিয় ঔপন্যাসিক ও কবি মার্গারেট এটউড। নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে আয়োজিত নাটকটিও শেকসপিয়রের মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনের অংশ ছিল। কিন্তু কেবল মৃত্যুবার্ষিকী উদযাপনই এর মূল উদ্দেশ্য না-কি অন্য কিছু?

এটা ঠিক যে চলচ্চিত্র, চিত্রকলা, আলোকচিত্রসহ শিল্পকলার নানা মাধ্যমে নগ্নতা এসেছে বার বার। অনেক ক্ষেত্রে তা শিল্পের চরম উৎকর্ষতার পরিচয় দিতেও সক্ষম হয়েছে। কিন্তু মঞ্চনাটকের ক্ষেত্রে আমরা সাধারণত দেখতে পাই, পোষাক-পরিচ্ছদ আর অন্যান্য সাজসজ্জা এর অন্যতম আকর্ষণ। বিশেষ করে শেকসপিয়রের নাটকের জন্য আরো বেশি প্রযোজ্য। এযাবতকালে শেকসপিয়রকে উপজীব্য করে নাটক সিনেমা গল্প উপন্যাস যত হয়েছে আর যত রকমের পরীক্ষানিরীক্ষা হয়েছে তা বোধ হয় আর কাউকে নিয়েই হয়নি। তবে সেদিন সেন্ট্রাল পার্কে যা হলো তা কেবল নতুনই নয় বরং অবিশ্বাস্য রকমের চমকপ্রদ। চমক তো কতভাবেই সৃষ্টি করা যায়। কিন্তু এমন প্রকাশ্যে নগ্নতা? সভ্য সমাজে এর কি কোন গ্রহণযোগ্যতা আছে? আর এর জন্য 'দ্য টেমপেস্ট'কেই কেন বেছে নেয়া হল? শেকসপিয়রের তো আরো অনেক বিখ্যাত নাটক ছিল।


ছবি: মারিসা রোপার অভিনয় করেছেন মিরান্ডার ভূমিকায়
উত্তরগুলো শোনা যাক আয়োজকদের মুখ থেকেই।
প্রদর্শনীর শেষ হবার পরপরই সাংবাদিকদের কাছে দেয়া সাক্ষাৎকারে নাটকের প্রযোজক চার্লস আরদাই'এর আত্মবিশ্বাসে ভরপুর উচ্চারন "নগ্নতা মানেই যৌনতা বা অশ্লীলতা নয়।নগ্ন নারীদেহকে নিয়মমাফিকরণ, সমাজ যাতে নগ্ন নারীদেহকে স্বাভাবিকভাবেই গ্রহণ করে- এটাই আমাদের কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য। আমরা দেখতে পেয়েছি দর্শকদের প্রতিক্রিয়া ছিল দারুণ। প্রাথমিক অস্বস্তি কাটিয়ে তারা ক্রমশ অভ্যস্ত হয়ে উঠছিল।তারা দেখছিল মানব শরীর, নারী দেহ নয়"।
প্রথাবিরোধী এই প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল 'আউটডোর কো-এড টপলেস পালপ ফিকশন এপ্রিসিয়েশন সোসাইটি'। যারা সংক্ষেপে 'টপলেস বুক ক্লাব' নামে পরিচিত। এই সংগঠনের সদস্যদের প্রায়ই দেখা যায় সেন্ট্রাল পার্কে, ওয়াশিংটন স্কোয়ারে অথবা নিউ ইয়র্ক শহরের অন্য কোন জনবহুল চত্বরে দলবেঁধে পিকনিক করছে কিংবা সার বেধে শুয়ে রোদ পোহাচ্ছে আর বই পড়ছে। কিংবা ব্যায়াম করছে। তবে সবারই শরীরের উপরের অংশে কোন বস্ত্র নেই। উর্ধাংশ নগ্ন বা টপলেস। গত ছয় বছর ধরে সংগঠনটি এই কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে । তবে সম্পূর্ণ নগ্ন হয়ে জনসাধারণের সামনে কোন নাটক মঞ্চস্থ করা এই প্রথম। অর্ধ নগ্ন হয়ে নিউ ইয়র্কে চলাফেরা করাটা কিন্তু আইনের বাইরে নয়। 'নিউ ইয়র্ক সিটি ল' বা 'নগর আইন' তাই বলছে। ১৯৯২ সাল থেকে নিউ ইয়র্ক শহরে এই আইনটি প্রচলিত। যে কোন লিঙ্গের মানুষ টপলেস বা শরীরের উপরের অংশ আবৃত না রেখেও চলাচল করতে পারেন স্বাধীনভাবে। তাদের কেউ বাধা দেবে না। এমনকি শিল্পকলা বা বিশেষ কোন প্রয়োজনে সম্পূর্ণ নগ্ন হবারও আধিকার আছে। এজন্য পূর্বানুমতি নিতে হয়। আর এই ব্যাপারটিরই প্রয়োগ ঘটেছিল সেন্ট্রাল পার্কের সেদিনের নাট্যপ্রদর্শনীর ক্ষেত্রে।


ছবি: সেদিন নিউইয়র্ক সেন্ট্রাল পার্কে 'দ্য টেমপেস্ট' নাটকের মূখ্য দুই চরিত্র প্রসপ্যারো আর মিরান্ডা (গিনা মেরি রাসেল ও মারিসা রোপার)

একজন পুরুষ উদোম হয়ে ঘুরে বেড়ালে মানুষের কিচ্ছু যায় আসে না কিন্তু মানুষ হিসেবে একই রকম অধিকার থাকার পরেও নারীদের বেলায় তার ব্যত্যয় ঘটে। নারীদেহ সম্পর্কে যাবতীয় সংস্কার ঝেড়ে ফেলায় সমাজকে উদ্ভুদ্ধ করা, মত প্রকাশ ও অভিব্যক্তির স্বাধীনতা উপভোগ করবার জন্য অভিনব কায়দায় এই আয়োজন। ফলে নাটকের চরিত্রের সবাই নারী। সবারই প্রথম নগ্ন অভিনয়। অথচ সবাই ছিলেন পুরোমাত্রায় সাবলীল স্বছন্দ্য। এমনকি নাটকের অন্যতম পুরুষ চরিত্র 'প্রসপ্যারো' সেও নারী। এই ভূমিকায় অভিনয় করেন গিমা মেরী রাসেল।


ছবি: সারা শরীরে রঙ্গীন উল্কি এঁকে এরিয়েলের ভূমিকায় দেখা গেল রিয়েন্না রোয়ানেকে।
কিন্তু শেকসপিয়রের 'দ্য টেমপেস্ট'ই কেন? এ সম্পর্কে জানতে চাওয়ার আগে তাকানো যাক 'দ্য টেমপেস্ট' এর পটভূমির দিকে।
ধারণা করা হয় উইলিয়াম শেকসপিয়র নাটকটি রচনা করেছিলেন ১৬১০ থেকে ১৬১১ সালে। অর্থাৎ তাঁর মৃত্যুর কিছুকাল আগে। তবে কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে রচনাকাল আরো আগে। নাটকে দেখা যায়, মিলানের রাজা বা ডিউক প্রসপ্যারোকে ষড়যন্ত্র করে সিংহাসনচ্যুত করে তারই ভাই অ্যান্টনিও। আর এই বিশ্বাসঘাতকতায় অ্যান্টনিওকে সহযোগিতা করে নেপলসের রাজা আলান্সো। নিরুপায় প্রসপ্যারো তাঁর কন্যা মিরান্ডাকে নিয়ে রাজ্য ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়। একটি ছোট নৌকায় করে মানবসভ্যতা থেকে দূরে এক দ্বীপে আশ্রয় নেয়। দ্বীপে সে দুজন অতিপ্রাকৃত শক্তির অধিকারী অধিবাসীর সন্ধান পায়। এরা হচ্ছে এরিয়েল ও ক্যানিবান। এই দ্বীপে আগে সাইকোরাক্স নামে এক ডাইনি বাস করতো। যে প্রসপ্যারো আসার আগেই মারা গেছে। কিন্তু মারা যাবার আগে সে এরিয়েলকে একটি গাছের ভেতর বন্দী করে রেখে যায়। প্রসপ্যারো এসে এরিয়েলকে মুক্ত করে বন্দীজীবন থেকে। ফলে এরিয়েল প্রসপ্যারোর অনুগত ভৃত্যে পরিণত হয়। পরের ১২টি বছর প্রসপ্যারো যাদুবিদ্যা অনুশীলন করে যাদুশক্তির অধিকারী হয়ে ওঠে। এ বছরগুলো ধরে কন্যা মিরান্ডাও দ্বীপের প্রাকৃতিক পরিবেশে স্বাধীনভাবে বেড়ে উঠতে থাকে । ক্যানিবান প্রেমে পড়ে মিরান্ডার। নাটকের শেষে দেখা যায় প্রতিশোধ নেবার ইচ্ছে থেকে প্রসপ্যারো যাদুবলে ঝড় তৈরি করে। সেই ঝড় আন্টনিও আর আলোন্সোকে দ্বীপের উপকূলে এনে ফেলে। এখানে প্রসপ্যারোকে সাহায্য করে এরিয়েল আর ক্যানিবান। পুরো নাটকটি একটি জনবিচ্ছিন্ন দ্বীপকে ঘিরে। এখানে প্রকৃতির সাথে নিবিড় সম্পর্ক প্রাণের। এখানে বাস করে সভ্যতা থেকে বহুদূরে মানুষের আদিম সত্ত্বা যেখানে আরোপিত কিছু নেই। নাটকের প্রতিটি চরিত্র স্বাধীনতা চায়। নিজেকে মুক্ত করবার জন্য লড়াই করে। নিজের আমিত্বের পরিচয় অনুসন্ধান করে। আর এ জন্যই 'দ্য টেমপেস্ট'কে বেছে নেয়া। বলছিলেন নাটকের সহকারী পরিচালক এলিস মোতেলা। যেহেতু নাটকটি একটি নির্জন প্রাকৃতিক পরিবেশ দাবী করে আর এর জন্য সেন্ট্রাল পার্কের সামিট রক'ই আদর্শ স্থান। এটা অনেকটা সেই নির্জন দ্বীপের আবহ বহন করে। আর দর্শকরা যেভাবে গোল হয়ে আমাদের ঘিরে বসেছিল তাতে তা যেন সত্যি এক দ্বীপে পরিণত হয়েছে। সহকারী পরিচালক আরো যোগ করেন,"আমরা সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে শরীর ও অভিব্যক্তির স্বাধীনতা খুঁজেছি। সমতা প্রকাশ করতে চেয়েছি। নাটকের চরিত্ররা ঠিক যেভাবে নিজেকে খুঁজেছে। এটা বন্দীদশা বনাম স্বাধীনতা। নিজেতে পরিণত হওয়া। আমি যা তাই হওয়া"। মোতেলাসহ সংশ্লিষ্ট সবার বক্তব্য এমনটিই ছিল।

নাটকের প্রয়োজনে ও চরিত্রের খাতিরে কিছু একান্ত আবশ্যকীয় আনুষঙ্গিকতার দরকার ছিল। কোন চরিত্রের গায়ে আঁকা ছিল মনস্তাত্বিক রঙিন উল্কি। গয়না, কাপড়ের অংশবিশেষ, চাদর, ফুল,পালক, ফিতা, কাঠ আর বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদি ব্যবহার করা হয়েছে।
সেন্ট্রাল পার্কের সেই ঘোরলাগা সন্ধ্যায় নাটকের শেষ অংকের অন্তিম মূহূর্তে এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারনা হয়। প্রধান চরিত্র প্রসপ্যারো তার যাদু শক্তি থেকে মুক্ত হতে চায়। সে বর্জন করে যাদুকে। উপসংহার টেনে দর্শকদের উদ্দেশ্য আকুতি জানায়, যেন তাকে মুক্ত করে দেয়া হয় দ্বীপের এই নির্বাসিত জীবন থেকে। যদিও সে জানে দ্বীপ ছেড়ে চলে যাওয়া মানে মৃত্যুর দিকে যাওয়া। সে ভাগ্যের পরিহাস থেকে মুক্ত হতে পারবে না। তাই ধীরে ধীরে সে তার পোশাকগুলি পরে নিতে থাকে। কেননা নাটকের শেষ অংকের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে নগ্ন থাকাটা ততই বেআইনি হয়ে যাচ্ছে। নাটক শেষে তাদের আবার নিজেদের ঢেকে নিতে হবে বস্ত্রে।
নাটক চলাকালীন সময় দু'ঘন্টার জন্যই নগ্ন থাকার অনুমতি ছিল শিল্পীদের। একারণেই শেষ দৃশ্যে প্রসপ্যারোর মুক্ত হবার সেই আহ্বান।


ছবি: প্রসপ্যারো'র ভূমিকায় গিনা মেরি রাসেল ও এরিয়েলের সাজে রিয়েন্না রোয়ানে।
তবে শেষবারের মতো নাটকের শিল্পীরা সবাই নগ্ন হয়েই দর্শকদের উদ্দেশে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে মাথা নত করে যবনিকা টানেন। ততক্ষণে সন্ধ্যা নামার প্রস্তুতি হিসেবে শীত আর অন্ধকার জেঁকে বসতে শুরু করেছে। কিন্তু তা উপেক্ষা করেই কোনো কোনো দর্শক তাদের শার্ট খুলে ফেলেছেন নাটকদলের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করবার জন্য। কারণ এই তের জন শিল্পী গত দুঘন্টায় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন, মানুষের শরীর আসলে মানুষের শরীর। আর কিছুই না। এর জন্য কিছু দরকারও নেই। শুধু সামান্য সম্মান ছাড়া।

ছবি সৌজন্য: 'আউটডোর কো-এড টপলেস পালপ ফিকশন এপ্রিসিয়েশন সোসাইটি'র অফিশিয়াল ওয়েব সাইট।
তথ্যসুত্র: 'আউটডোর কো-এড টপলেস পালপ ফিকশন এপ্রিসিয়েশন সোসাইটি', দ্য গার্ডিয়ান, হাফিংটন পোস্ট ইউএস।

আর্টস বিভাগে প্রকাশিত বিপাশা চক্রবর্তীর আরও লেখা:
জীবন ও মৃত্যুর সঙ্গম: অর্ধনারীশ্বর অথবা তৃতীয় প্রকৃতি