১৯৮০ সাল , মাধ্যমিক পরীক্ষায় ১ম বিভাগ পেয়েছি ময়মনসিংহ জিলা স্কুল থেকে । পরিবারে মোটামুটি একটু সম্মান রক্ষা করতে পেরে কিছুটা গর্বিত যদিও বাবা-মার আশা ছিল আরও বেশী সাবজেক্টে লেটার পাওয়ার কিন্তু আমি পেয়েছিলাম মাত্র ২ টিতে, অল্প কিছু নম্বর বেশী পেলে আরও ২টিতে পেতে পারতাম ।
আনন্দ মোহন কলেজে উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণীতে ভর্তির প্রস্তুতি নিচ্ছি । আমার বন্ধু ভাগ্য ভাল । আমার বন্ধুদের গ্রুপটা অনেক বড় । তবে যে সকল বন্ধুরা সকাল বিকাল একসাথে থাকতাম (শুধু দুপুরে খাওয়া ও রাত্রে ঘুমনো বাদে) তাদের মধ্যে আন্যতম নামগুলো হচ্ছে নানটু , ফারুক (মাঙ্কি), শাহিন (মোড়ল) , পুটটু (ধুন্ধা) , সাকিল (ঘাওরা) , সামিম ( সাকিলের বড় ভাই ) , রুমি (ভুইয়া) , মোশাররফ (মশা) , মাসুম (শিষ) , বাবুল (বাবুইল্লা) , টিপু , ইয়াহিয়া (মৃত) রহিম(অখিল) , মনির (ভল্কান), কামরুল সহ আরও অনেক । যদিও এর বাইরেও অনেক বন্ধু আমরা একসাথে জিলা স্কুল মোড়ে সিরাজ মেমোরিয়াল ক্লাবে সকাল বিকাল আড্ডা দিতাম কিন্তু এরা নিয়মিত ছিল না ।
কলেজে ভর্তির প্রথম দিনের স্মৃতি অত্যন্ত মর্মান্তিক, দুঃখজনক , রোমাঞ্চকর। ভর্তি পরীক্ষার ফরম জমা দিয়ে সকলে মিলে ক্যান্টিনের দিকে যাচ্ছিলাম , বিরাট অডিটোরিয়াম বিল্ডিঙের বারান্দা পেরিয়ে ক্যান্টিনে যেতে হয় । এই অডিটোরিয়ামে কোনও একটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল । আমাদের আগের ব্যাচের । উচ্চ মাধ্যমিক ১ম বর্ষ থেকে ২য় বর্ষে উত্তীর্ণের পরীক্ষা ।
অডিটোরিয়ামের বারান্দায় উঠার সাথে সাথে কিসের একটা গণ্ডগোল , দৌড়াদৌড়ি লক্ষ্য করলাম । জীবনের প্রথম কলেজে ঢুকেছি , কিছুটা ভীত ও বিব্রত । হটাৎ দেখলাম জিলা স্কুলের আমাদের আগের ব্যাচের – ৭৯ ব্যাচের শ্যামল, নয়ন, মাসুদ(বিষম) সহ আরও কয়েকজন (ঠিক মনে নেই) হাতে হকিস্টিক নিয়ে দৌড়ে আমাদের দিকে আসছে । আমাদের কাছে এসে হকিস্টিক গুলো রাখতে দিয়ে দৌরে পালিয়ে গেল । আমরা কয়েকজন কিছু বুঝে উঠার আগেই আরও অপরিচিত কয়েকজন দৌড়ে এসে আমাদের দেখে বলতে লাগল যে আমরা বহিরাগত সন্ত্রাসী । আমরা বোঝানোর চেষ্টা করলাম যে আমরা কলেজে নতুন এবং কিছ জানি না । কিন্তু হাতে হকিস্টিক থাকায় নিজেদের নির্দোষ বলে বোঝাতে পারছিলাম না । অগত্যা হাতের হকিস্টিক চালিয়ে দিলাম ওদের উপর । কিন্তু বুঝতে পারিনি কাদের উপর হকিস্টিক চালিয়েছিলাম ।
উনারা হচ্ছেন ময়মনসিংহ শহরের অত্তন্ত্য প্রভাবশালী তৎকালীন ছাত্রদল নেতা কাল্লু ভাই , জুলফি ভাই , নজরুল ভাই এবং আরও কয়েকজন যাদের ভয় পেত না এমন লোক শহরে ছিল না ।
আমরা তো ওদের পিটিয়ে কলেজ থেকে দৌড়ে জিলা স্কুল মোড়ে চলে আসি । এসে দেখি স্বপনের (বেরুলের ) নেতৃত্বে ৭৯ ব্যাচ ক্লাবে বসে মনের সুখে তাস খেলছে । অগ্রজদের ঘটনার বিবরণ দেয়ার পর তাদের মুখে যখন নামগুলো শুনলাম ভয়ে অবস্থা বেগতিক । যাদের আমরা পিটিয়েছি শহরের ছেলে-বুড়ো সকলেই এক নামে তাদের চিনে এবং ভয় পায় । আমরা যেহেতু কেবল ম্যাট্রিক পাস করেছি কাজেই নামে চিনলেও চেহারা দেখার সুযোগ এখনও হয়নি । আমরা তখন ভাবছি আনন্দ মোহনের পড়া আর হোল না , বাবা-মার কাছে কি জবাব দিব আবস্থা ।
হটাৎ স্বপন বলল , মিমাংসা একটা তো করতেই হবে আরও একটু পিটুনি বেশী দেয়া দরকার ছিল । যাক , পরদিন মিমাংসা হোল । ছোট হিসাবে আমরা মাফ চেয়েছি না চিনে বেয়াদপির জন্য । অগ্রজদের জোরাল ভূমিকার কারনে সম্মানজনক মিমাংসা হোল ।
বিষয়টি ছিল এরকম , উচ্চমাধ্যমিক ১ম বর্ষ উত্তীর্ণ পরীক্ষা অগ্রজরা দিতে চায়নি কিন্তু প্রিন্সিপাল পরীক্ষা ছাড়া ২য় বর্ষে সরাসরি উত্তীর্ণ করবে না । এই নিয়ে টানাটানির এক পর্যায়ে প্রিন্সিপাল পরিক্ষার তারিখ ঘোষণা করে । যথারীতি কিছু সুবোধ ভাল ছাত্র পরীক্ষার হলে বসে যায়। অগ্রজরা পরীক্ষার হলে ঢুকে হকিস্টিক দিয়ে সবাইকে তাড়িয়ে ফেরার সময় আমাদের পেয়ে হকিস্টিক গুলো আমাদের হাতে দিয়ে নিরাপদে বাইরে চলে আসে আমরা কিছু বুঝে উঠার আগেই ।
যাহোক , মিমাংসা হোল আমরাও কলেজের ১ম বর্ষে ভর্তি হলাম , বন্ধুরা মিলে সিদ্ধান্ত নিলাম আমরা সবাই একরকম খাতা ব্যাবহার করবো । শহরের পেপারল্যান্ড নামক নামকরা একটি খাতা পেন্সিলের দোকান থেকে সবাই লাল রঙের খাতা কিনলাম । এই খাতাই হচ্ছে আমাদের গ্রুপের পরিচয় । দেখা গেল আমাদের জিলা স্কুলের সব বন্ধুরাই লাল খাতাধারী হয়ে গেল । আস্তে আস্তে লাল খাতাধারীর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেল । ময়মনসিংহ শহর এবং আশপাশের স্কুলগুলোর যত প্রথম বিভাগ পাওয়া ভাল ছাত্র ছিল সবাই আনন্দ মোহন কলেজে ভর্তি হওয়ার চেষ্টা করে । ১ম বর্ষে দুই সেকশন মিলে প্রায় ৫০০ ছাত্র ভর্তি হলাম । ভর্তির সময় যাদের সিরিয়াল বেজোর তারা "এ" সেকশন এবং জোর সংখ্যা ওয়ালারা "বি" সেকশনে পড়ল । অগ্রজদের কল্যাণে বিষয়টি আমরা জেনে ফেললাম । সেই মোতাবেক ভর্তির লাইনে একজনের পর পর এমন ভাবে দারালাম যেন সবাই বেজোড় হয়ে এ সেকশনে যেতে পারি । হলও তাই ।
১ম বর্ষে আমাদের গ্রুপ অনেক বড় হয়ে গেল । লাল খাতার সংখ্যা সেটা বলে দিত। জিলা স্কুলের বাইরের সিটি স্কুল , কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল সহ শহরের সবকয়টি স্কুলের ছাত্ররা ছিল কিন্তু কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় স্কুল থেকে আগত বন্ধুরা আমাদের গ্রুপের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে গেল। তান্নু, কামাল , রানা , হাকিম , লম্বু রানা এরা ছিল ।
১ম বর্ষ বেশ ভালই কাটছিল । সকালে এসে ক্লাসে হাজিরা দিয়েই ছুটতাম ক্যান্টিনে, কমনরুমে অথবা মিছিলে । আমাদের ক্লাসরুমটি অনেকটা পার্লামেন্টের মত গ্যালারী সিস্টেম বেঞ্চ , তাও আবার অর্ধ চন্দ্রাকৃতির । টিচার নিচ থেকে সবার চেহারা দেখতে পারতো । আমরা সাধারণত শেষ বেঞ্চের কোনার দিকে বসতাম । ক্লাসে নাম ডাকা শেষ হওয়া মাত্র পিছন থেকে টপাটপ নেমে পড়তাম । পিছনের বেঞ্চ গুলো এত উচু যে নামার পরে টিচার এর পক্ষে আর কিছু দেখা সম্ভব ছিল না । টিচার শুধু দেখত আস্তে আস্তে পিছনের বেঞ্চ খালি হয়ে গেছে । কলেজের টিচারদের এটুকু সম্মানই যথেষ্ট মেনে নিয়ে আর কিছু বলত না । তবে জাঁদরেল টিচারও ছিল, উনাদের ক্লাস হয় পুরোটা করতাম অথবা অনুপস্থিত থাকতাম । তবে সবাই মিলে একটা ক্লাস কখনও ফাঁকি দিতাম না । সেটা ইংরেজি ক্লাস , ম্যাডাম এতটা সুন্দরী ছিলেন যে তখন সামনের বেঞ্চে কে বসবে তা নিয়ে কাড়াকাড়ি হতো, এমনকি লটারিও হতো ।