ঈশ্বরের সঙ্গে এক অবিশ্বাসীর কথোপকথন (পর্ব-১)

salauddin mia
Published : 8 August 2014, 10:37 AM
Updated : 8 August 2014, 10:37 AM

আমলনামায় চোখ বুলিয়ে অ্যাঞ্জেলকে উদ্দেশ্যে করে ঈশ্বর: এই অবিশ্বাসী-পাপীকে সোজা নরকে নিক্ষেপ করো।

অবিশ্বাসী: এইডা কোনো কথা কইলা?
কি এমন অপরাধ করছি আমি?

ঈশ্বর: তুই আমার কোনো নির্দেশ মানিস নাই।

অবিশ্বাসী: কোনডা যে তোমার নির্দেশ…….তা তো অহন পর্যন্তও বুঝবার পারলাম না। দুনিয়ায় হাজারটা ধর্ম পাঠাইছিলা তুমি। হাজারটা ধর্মীয় সম্প্রদায় মারামারি-ঠাপাঠাপি করেছে। তুমি যদি মানুষের ভালোই চাইতা তাইলে এই কাম করতা না।

ঈশ্বর: কস​ কি রে হালার পুত?

অবিশ্বাসী: ঠিকই তো কইছি। তুমি হাজারটা ধর্ম পাঠাইছো এবং প্রত্যেক ধর্মের অনুসারীদের মনের মধ্যে ঢুকাইছো যে, তাঁদের ধর্মটাই সঠিক, বাকিটা মিথ্যা। ফলে সব সাম্প্রদায় ঔদ্ধত্যপূর্ণ হয়ে উঠেছে। সম্প্রদায়ের লোকজন মনে করেছে, নিজের সম্প্রদায়ের লোকের ভাই ভাই, বাকিরা চুদির ভাই। এইটা কোনো কথা হইলো? তাইলে তুমি কোনডা মানতে বলতাছো আমারে? সবই তো খারাপ। লালনের গান হোনো নাই? : 'বেদ বিধি পদ শাস্ত্র কানা…………এক কানা কয় আরেক কানারে, চলো এবার ভবো পাড়ে। নিজে কানা পথ চেনে না পরকে ডাকে বারংবার'

ঈশ্বর: তুই যে সমাজে জন্মেছিস ওই সমাজের লোকজন যে ধর্ম মানতো, সেইটাই মানতিস।

অবিশ্বাসী: ওরকম ধর্ম মানার কোনো মূল্য আছে? দুনিয়াতে হাজার বছর ধরে অনেক মিথ্যাই প্রতিষ্ঠিত ছিল। হাজার হাজার বছর ধরে মানুষ জানতো, সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘোরে। আমার সমাজ আর পরিবার যদি তোমারে শয়তান বলতে শেখাতো আর আমি যদি তাই মানতাম তাইলে তুমি খুশি হইতা? প্যাগান ধর্মের লোকেরা নাকি শয়তানকে পূজা করতো। ওই ধর্মের অনুসারীদের ঘরে তুমি যে শিশু পাঠাইছো ওই শিশু বড় হয়ে শয়তানকেই পূজা করেছে। ওই শিশুর দোষটা কি?
যাইহোক, এই যে, কিছুক্ষণ আগে কয়েকজনরে স্বর্গে পাঠাইলা, উহারা কোনো মানুষের পর্যায়ে পড়ে? স্বর্গটাকে তো গরু-ছাগলের খোয়ার বানায়া ফেলতাছো। সেটা তোমার রুচি। তোমার রুচির ওপর আমার আস্থা কোনো কালেই ছিল না। গোলাম আযম-নিযামীরেও স্বর্গে পাঠাইলে অবাক হমু না।

ঈশ্বর: স্বর্গে যাদের পাঠাইলাম ওরা মানুষ না? সমস্যা কি ওদের? ওরা তো আমারে মানছে।

অবিশ্বাসী: ওরা যে তোমারে যে মানছে—-ওইটাই তো সমস্যা। জন্মের পর থেকে ওদের সমাজ আর পরিবার বলছে যে, ইশ্বর আছে, ঈশ্বর ভালো, ঈশ্বরের নিয়ম মানতে হবে। তাই ওরা মানছে। ওদের পরিবার-সমাজ যদি বলতো ঈশ্বর নাই বা ঈশ্বর আসলে শয়তান, আর শয়তানই আসলে ঈশ্বর, মহৎ…। ওরা তো তাই-ই মানতো। ওদের তো বিচার বুদ্ধিই নাই্। ওয়ারিশ সূত্রে ওরা আস্তিক ছিল ওরা। ওদের কোনো ছিদেম (বিচারবুদ্ধি) নাই। ওরা ছাগল ছাড়া আর কি! দুনিয়াতে এই ছাগলগুলোরে নিয়েই ধর্ম ব্যবসায়ীরা খেলেছে। দুনিয়ায় অশান্তি তৈরি করেছে। ওই ছাগলগুলো ছিল ধর্ম ব্যবসায়ীদের ফুটবল।
তুমি তো দেখছোই, তোমার দেওয়া বহুবিধ ধর্ম দুনিয়ায় অশান্তি সৃষ্টি ছাড়া কোনো কামে আসে নাই। ইউরোপে খ্রিস্টানরা যখন ধর্মীয় শাসনকে লাত্থি মেরেছে তখনই তারা উন্নতি করেছে। দাসপ্রথা বিলুপ্ত করেছে। সব নাগরিককে সম্মান দিতে শিখেছে। যদিও সাম্রাজ্যবাদী ওই দেশগুলো অন্য গরিব দেশের জন্য মঙ্গলজনক ছিল না। তাঁরা পশ্চাদপদ ধর্মীয় প্রভাবিত দেশে সাম্রাজ্য বিস্তারের জন্য ধর্মকেই ব্যবহার করেছে। তারাই তালেবান বানিয়েছে নিজেদের স্বার্থে। আবার তালেবানরে সন্ত্রাসীও বানিয়েছে, নিজেদের স্বার্থে। সে অন্য বিষয়। পুঁজিবাদী সাম্রাজ্য বিস্তারের লক্ষ্যে ওই সব দেশের কূট রাজনীতি অন্য দেশের জন্য ক্ষতিকর ছিল। কিন্তু এটা তো মানতেই হবে, ধর্মের বলয় থেকে বের হয়ে উন্নত দেশগুলোর নাগরিকেরা সভ্য হয়েছিল। তারা অন্তত নিজেদের দেশের সব মানুষকে সম্মান করতে শিখেছিল। কিন্তু যে জাতি যত বেশি ধর্মপ্রবণ ছিল ওই জাতি ততো বেশি দুই নম্বর অসৎ ছিল। তা তো তুমি দেখেছোই। লোভ আর ভয় থেকে কখনোই মানুষ নৈতিক হয়নি।

ঈশ্বর (কিছুক্ষণ চিন্তামগ্ন থাকার পর): বুঝলাম। তুই কোনো ধর্ম না-হয় নাই মানলি, আমারে তো মানবি। বিশ্বাস করবি। নাকি?

অবিশ্বাসী: আরে রাখো তোমার মানা। মানা না মানায় কি আসে যায়? আমি কি তোমার হাত-পা ধরে বলেছিলাম, আমারে দুনিয়ায় পাঠাও? আর দুনিয়াতে তোমার ইজারাদারদের (ধার্মিকেরা) কর্মকাণ্ডে তোমার ওপর মেজাজটাই তো বিগড়ে ছিল। দুনিয়ায় কোনো কর্মকাণ্ডেই তোমার উপস্থিতি দেখি নাই। একটা শিশু পাপ করার আগেই কানাখোড়া হয়ে কেমনে জন্মায়? ওই শিশুর দোষটা কি? ফিলিস্তিনে ইহুদিরা নারী-শিশুসহ বাড়িঘর-মাজার বোমা মেরে তুলা-তুলা বানায়া ফেলাইছিল। কই আছিলা তহন? …..অাঁটি বান্দিতিছিলানি? যাউকগা, তোমার কাছে একটা প্রশ্ন: কোনো লোক যদি খারাপ উদ্দেশ্যে খারাপ কিছু তৈরি করে তবে সে ভালো না খারাপ?

ঈশ্বর: অবশ্যই খারাপ।

অবিশ্বাসী: তাইলে শয়তানরে যে বানাইছে সে কেমন?

ঈশ্বর: তুই একটা বেয়াদব।

অবিশ্বাসী: আমারেও তো নাকি তুমিই বানাইছো? দুনিয়াতে উচিত কথা বলতাম বলে ভণ্ড সব লোকজন আমারে বেয়াদব কইতো। এহন তুমিও যদি ওই একই কথা কও, তাইলে কেমনে হয়?

ঈশ্বর: দুনিয়াতে তুই আমার নামে আজেবাজে কথা বলেছিস।

অবিশ্বাসী: আজেবাজে কথাতো কই নাই। সমালোচনা করেছি। তোমার যে চরিত্রের কথা বিশ্বাসীদের মুখে শুনেছি, তাতে সমালোচনা করাটা স্বাভাবিক না? হাগামোতা থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে তোমার মন্ত্র পড়তে হবে। সব সময় তোমার পূজা করতে হবে। এসব কোনো কথা হলো? দুনিয়ায় গেছি কি বাল ছেড়ার জন্য? দুনিয়াটা দেখুম না? অলটাইম তোমার নাম নেওয়া আর পূজো করার এই বিধান দেখেই বোঝা যায়, তোমার মানসিকতা অত্যন্ত নিচুমানের। আদিম যুগের মানুষের মতো।

ঈশ্বর: কস কি?

অবিশ্বাসী: ঠিকই কই। ধরা যাক, কাউরে আমি কোনো জিনিস দিলাম। আর আমি মনে মনে চাইলাম ওই ব্যক্তি সারা জীবন আমার নাম নিক এবং আমার স্তুতি করে যাক। আমি কি তাহলে ছোটলোক মানসিকতার লোক নই? যে মানুষটাকে আমি জিনিসটা দিয়েছিলাম, সে যদি জানতে পারে আমার মানসিকতা এ ধরনের তবে ওই মানুষটার ন্যূনতম ব্যক্তিত্ব থাকলে বলবে, তোর এই বালের জিনিস কি আমি চেয়েছিলাম? নে ধর, ফিরিয়ে দিলাম। তোমার যায়গায় আমি হলে এসবে ধুনফুনের কথা কইতাম না। আমি মানুষরে স্বাধীন বানায়া দিতাম। জন্মের সময়ই কাউরো কানা-খুঁড়া-আন্ধা বানাইতাম না। সব মানুষরে সমান অধিকার দিতাম। আর তুমি, যে কয় খান কেতাব পাঠাইছো, ওই কেতাব শান্তি প্রতিষ্ঠা না করে হাজারটা বিভাজন তৈরি করেছে। তুমি যদি মানুষের শান্তিই চাইতা, তাইলে এমন বাণী পাঠাইতা, যা হতো শ্বাশ্বত, চিরন্তন। এবং সবাই মেনে চলতো।

ঈশ্বর: তাইলে তুই কি কইতে চাস? আমি ভুল করছি?

অবিশ্বাসী: এইডা যদি এহনও না বোঝো, তাইলে কেমনে হয়। তুমি লোভ আর ভয় দেখাইছো। তুমি ক্ষমতার জোরে পূজো আদায় করতে চাও। সম্মান কি জিনিস তাই তো বোঝো না তুমি। আমাকে জানার পর কোনো ব্যক্তির যদি আমাকে পছন্দ হয়, তবে সে মন থেকে সম্মান করবে। ওইটাই প্রকৃত সম্মান। আর আমার ক্ষমতা আছে, তাই ভয়ে কোনো লোক যদি আমারে সম্মান করে তাহলে ওইটা কোনো সম্মান হইলো? তুমি লোভ আর ভয় দেখায়া সম্মান-শ্রদ্ধা এসব আদায় করতে চাইছো।

ঈশ্বর: তার মানে তুই কি বলতে চাস? কেউ আমারে মন থেকে সম্মান করে নাই? ভয় আর লোভ থেকে সম্মান করে?

অবিশ্বাসী: এ ব্যাপারে আমি তোমারে কোনো কথা কইতে চাই না। তবে তোমারেই একটা প্রশ্ন করি: তুমি যদি বলতে, দুনিয়ার পর সব শেষ, আর কোনো হিসাব-নিকাশ থাকবে না। স্বর্গ-নরক বলে কিছু নেই। তারপরও তোরা মানুষেরা যদি আমার কতোগুলো নির্দেশ পালন করিস, তবে আমি খুশি হবো। তাহলে কি তোমার খুশির মূল্য দিত মানুষ?

ঈশ্বর: তোরা (মানুষ) খারাপ। লোভ আর ভয় না দেখাইলে তোরা ঠিক হইতি না।

অবিশ্বাসী: হা…হা…হা….হা…। লোভ আর ভয় দিয়ে মানুষ কি ঠিক হইছিল? বরং দুনিয়াতে মানুষের মনের মধ্যে মারাত্মক লোভ ঢুকাইয়া রাখছিলা। লোভ আর ভয়ই ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে খারাপ জিনিস।

ঈশ্বর: কেমনে খারাপ?

অবিশ্বাসী: তুমি কইছো দুনিয়াতে মাল (মদ) খাওয়া হারাম। আর স্বর্গে মালের নদী (সারাবুন তাহুরা) বানায়া রাখছো। এইটা কোনো কথার মতো কথা? আবার তুমি কইছো, দুনিয়াতে অবাধে সেক্স করা যাবে না। অথচ বেহেশতে হুরপরী দিয়া ভইরা রাখছো। এসব কি? এর মানে তুমি মানুষের মনে ঢুকায়া দিছ: মাল খাওয়া, আর সেক্স করাটাই আসলে বিরাট সুখের জিনিস। এ কারণে আরবের বাদশারা তাদের দেশরে বাইজী বাড়ি বানায় ফালাইছিল। তেল বেঁচে মদ আর মাইয়া নিয়ে পইড়া ছিল তারা। অথচ দেখ, নাস্তিক অধ্যুষিত ইউরোপের নাগরিকেরা মাল খাইতো পরিমিত। আর তোমার পেয়ারের লোভী বান্দারা মাল খাইয়া বুঁদ হয়ে পইড়া আছিল। একদিকে ইহুদিরা ফিলিস্তিনের মানুষরে বোমা মাইরা তুলা তুলা বানায়া ফেলছিল। আর অন্যদিকে ইহুদিদের সাপ্লাই দেওয়া মদ আর মাইয়া নিয়ে পইড়া ছিল বাইজি বাড়ির বাদশারা। তারা গরীব মুসলিম দেশের শিশু নিয়ে উটের জকি বানায় রাখতো। গরিব মাইয়া নিয়ে তারা কাজের বেটি বানাইতো আর ভোগ করতো। ওইসব গরিব শিশু আর মেয়েদের কি কোনো ঈশ্বর আছিল না? তাছাড়া তোমার সৃষ্ট বহুবিধ ধর্ম মানুষের মারাত্মক ক্ষতি করছে। তুমি নিজেই হিসাব করে বের করো তো, ধর্মীয় ও জাতীয়তাবাদী সাম্প্রদায়িকতার কারণে যুগে যুগে দুনিয়ায় কত হানা​হানি আর রক্তপাত ঘটেছে? হিন্দু ধর্মের কঠোর নিয়মকানুন এক কালে কতো পতিতা তৈরি করেছে? তোমার পাঠানো বাণীতে লোকজন বিভ্রান্ত হয়েছে, ঠাপাঠাপি করেছে।

ঈশ্বর: মানুষ যদি না বুঝে বিভ্রান্ত হয় তাতে আমার কি দোষ?

অবিশ্বাসী: হা..হা..হা..। তুমি নাকি সর্বশক্তিধর। তুমি মানুষরে শান্তিতে থাকার জন্য যুগে যুগে বাণী পাঠাইছো। অথচ মানুষ ওই বাণীতে বিভ্রান্ত হয়েছে। এটাতো তামার বাণীরই ব্যর্থতা। তুমি কি বুঝতে পারো নাই যে, তোমার বাণীতে ভুল ব্যখ্যার অবকাশ রয়েছে। তোমার বাণীতে ভুল ব্যখ্যার অবকাশ রাখা হলো কেন? আবার তুমি বাণী পাঠিয়েছে নির্দিষ্ট একটি গোত্রের ভাষায়, সার্বজনীন কোনো ভাষায় নয়। আমি কেন হিব্রু, আরবি, সংস্কৃত পড়তে যাব? তুমি সার্বজনীন কোনো ভাষা তৈরি করে সেই ভাষায় বাণী দিতা। তাইলেও নাহয় বুঝতাম। আর তোমার নির্দেশনার কোনো সার্বজনীনতা নেই। তোমার বাণী চরমভাবে ব্যর্থ।

ঈশ্বর: আমি মানুষরে পরীক্ষা নিতে চাইছি।

অবিশ্বাসী: তুমি কিন্তু কথা ঘুরায় ফেলতাছো। আমি কইলাম তোমার বাণীর ব্যর্থতার কথা, আর তুমি আনছো পরীক্ষার কথা। আর পরীক্ষা নেওয়ারই বা কি আছে? তার মানে, তুমি পরীক্ষার ফল কি হবে তা জানো না? মানুষ তো ফল জানতো না, তাই পরীক্ষা নিত। আমার এক বন্ধু আমার প্রতি কতোটুকু উপকারী তা জানার জন্য ওই বন্ধুর কাছে আমি কিছু অর্থ চেয়েছিলাম। সে আমাকে অর্থ দিয়েছিল।কিন্তু আমি যদি আগে থেকেই জানতাম, ওই বন্ধু টাকাটা আমাকে দিবে। তবে আমি পরীক্ষার নাটক করতে যাব কেন? এসব নখরামি কেন? কি সব আবোলতাবোল কথা কও?

(চলবে………………)