অপ্রকাশিত পত্রগুচ্ছে সিলভিয়া প্লাথের তিক্ত দাম্পত্যজীবন

muhit_hasan
Published : 22 May 2017, 04:19 AM
Updated : 22 May 2017, 04:19 AM

কবিদম্পতি সিলভিয়া প্লাথ ও টেড হিউসের বিবাহিত জীবন কখনোই খুব মধুর ছিল না, তা ওয়াকিবহাল ব্যক্তিমাত্রেই জানেন। কিন্তু সাংসারিক রাগ-বিরাগের সীমা ছাড়িয়ে টেড হিউস স্বয়ং, সিলভিয়া প্লাথকে রীতিমতো শারীরিক অত্যাচার করেছিলেন– এমন তথ্য যে কাউকে চমকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান সিলভিয়ার গর্ভে 'মিসক্যারিজ' হওয়ার দুদিন আগে তাঁকে আঘাত করেছিলেন টেড হিউস ও পাশাপাশি তাঁর মৃত্যুকামনা করেছিলেন–এমন তথ্য পেলে কি যে কারও গা শিউরে উঠবে না? সম্প্রতি সিলভিয়ার অপ্রকাশিত একগুচ্ছ পত্র জনসম্মুখে আসায় বিষয়টি জানা গিয়েছে।
চিঠিগুলো(সংখ্যায় মোট চৌদ্দটি) লেখা হয়েছিল ১৯৬০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৯৬৩-র ৪ ফেব্রুয়ারির মধ্যে, সিলভিয়া প্লাথ আত্মহত্যা করার সপ্তাহখানেক আগে শেষতম চিঠিটি লেখা হয়। চিঠিগুলো সিলভিয়ার জীবনের এমন একটা অধ্যায় মেলে ধরেছে, যা কিনা পাঠক ও গবেষকদের মধ্যে ধোঁয়াশাপূর্ণই রয়ে গিয়েছিল এতদিন। এমনিতে ইংল্যান্ডে তখন বসবাসকারী এই মার্কিনি কবি ছিলেন একজন দুঁদে পত্রলেখক, উপরন্তু এগারো বছর বয়স থেকে সবিস্তার দিনলিপি লেখার অভ্যাসও তাঁর ছিল। কিন্তু তাঁর মৃত্যুর পর টেড হিউস দাবী করে বসলেন, মৃত্যুর পরই সিলভিয়ার সব দিনলিপির খাতা খোয়া গিয়েছে। আর শেষতম দিনলিপির খাতাটি তিনি নিজেই নষ্ট করে ফেলেছেন, তাঁদের দুই সন্তান ফ্রিডা ও নিকোলাসকে 'রক্ষার স্বার্থে'।

সিলভিয়া প্লাথ নিজের ব্যক্তিগত মনোচিকিৎসক রুথ বার্নহাউজকে লিখেছিলেন এই চিঠিগুলো। উল্লেখ্য, এই রুথ বার্নহাউজের আদলেই তাঁর আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস বেল জার-এর ডা.নোলান চরিত্রটি গড়া হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়ে থাকে। আমেরিকায় আসার পর সিলভিয়া যখন(১৯৫৩ সালের আগস্ট মাসে) প্রথম আত্মহননের প্রয়াস নিয়েছিলেন– ডা. রুথই ওই ঘটনার পর থেকে তাঁর চিকিৎসা করছিলেন। অবশ্য তিনি এর আগেও একাধিকার আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকতে পারেন বলে কারও কারও ধারণা, কিন্তু তা কারো গোচরে আসেনি। এই চিঠিপত্রের গুচ্ছটিকে কার্যত সিলভিয়ার জীবনের শেষাংশের একমাত্র ছাঁটকাঁটবিহীন ও এখন অব্দি রক্ষা পাওয়া দলিল বলে মনে করা হচ্ছে। আদতে তিনি নিজের বিখ্যাত কবিতাগুলোর বেশ কয়েকটি লিখেছিলেন জীবনের অন্তিম পর্যায়ে এসে। তাঁর সুবিখ্যাত কাব্যগ্রন্থ এরিয়েলও ওই সময়েই রচিত হয়েছিল। সিলভিয়া যখন জানতে পারেন, তাঁর স্বামী তাঁদের দুজনেরই বন্ধু আসিয়া ওয়েভিলের সাথে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছেন তখন তিনি অন্তত নয়টি চিঠি লিখেছিলেন ডা.রুথকে।
বস্তুত এই পত্রগুচ্ছ সিলভিয়া-সংক্রান্ত একটি আর্কাইভের অংশ। যা কিনা নারীবাদী গবেষক হ্যারিয়েট রোজেনস্টাইনের উদ্যোগে নির্মিত হয়েছিল। হ্যারিয়েট কবির মৃত্যুর সাত বছর পরে এই আর্কাইভ তৈরির কাজে হাত দিয়েছিলেন। আসলে তাঁর উদ্দেশ্য ছিল সিলভিয়ার একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনী লেখা, কিন্তু তা আর সমাপ্ত হয়নি। হ্যারিয়েট শুধু সিলভিয়ার পত্রাবলী সংগ্রহ করেই থেমে থাকেননি তখন। সংগ্রহ করেছিলেন ১৯৫৪ সাল থেকে মৃত্যু অব্দি সিলভিয়ার তাবৎ চিকিৎসা সংক্রান্ত রিপোর্ট, পত্রালাপ করেছিলেন তাঁর বন্ধুদের সাথে আর সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন ডা.রুথেরও যে আলাপচারিতার গোটা অংশ জুড়েই ছিল সিলভিয়াকে মানসিক চিকিৎসাদানের সময়কার অভিজ্ঞতার প্রসঙ্গ। কিন্তু এই আর্কাইভ আলোয় এলো কী করে? এলো স্রেফ ব্যবসায়িক আয়োজনের ফলে। এক পুরোনো বইয়ের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গোটা সিলভিয়া-আর্কাইভটির সম্ভাব্য দাম হেঁকেছিলেন আট লক্ষ পঁচাত্তর হাজার ডলার মাত্র। তারপরই এ নিয়ে শুরু হয় তুমুল আলোচনা।

তবে ডা.রুথকে লেখা সিলভিয়ার ওই চিঠিপত্রগুলো আপাতত আর বিক্রি করা যাচ্ছে না। কারণ তা নিয়ে একটি মামলা কোর্টে উঠেছে। সিলভিয়া প্লাথের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্মিথ কলেজের তরফ থেকে ঠোকা ওই মোকদ্দমায় দাবি করা হয়েছে যে ডা. রুথ ওই চিঠিগুলো কলেজকে দান করে গিয়েছিলেন, তাই সেসব আর বিক্রয়যোগ্য নয়। বিষয়টির আইনি সুরাহা না হওয়া পর্যন্ত চিঠিগুলোর ভবিষ্যৎ কী, তাও জানার উপায় নেই।
আমেরিকার পাট চুকিয়ে সিলভিয়া প্লাথ যখন আবার ইংল্যান্ডে ফিরে যান, তখন ডা.রুথের সাথে তাঁর চিকিৎসাঘটিত যোগাযোগও স্বাভাবিকভাবেই বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তাঁরা একে অপরকে চিঠি লেখাটা তখনও ছাড়েননি। তাঁরা একটি আবেগঘন বন্ধুত্বের বন্ধনে বাঁধা ছিলেন যেন। যেখানে তাঁদের পরস্পরের প্রতি এক সহজাত আগ্রহবোধ জন্মেছিল। ডা.রুথকে লেখা তাঁর চিঠিপত্রে তাই মেলে এক উষ্ণ ও উন্মুক্ত অন্তরঙ্গতার আবহ, পাশাপাশি পাওয়া যায় মার্জিত রসবোধের ছোঁয়াও। এ কারণে ডা. রুথের সাথে সিলভিয়ার বন্ধুত্ব প্রাতিষ্ঠানিক গবেষকদেরও আগ্রহের বিষয় হয়ে উঠেছে।
অবশ্য বলাই বাহুল্য যে কেবলই অন্তরঙ্গ মধুর আলাপ নয়, সিলভিয়া প্লাথ উক্ত পত্রগুচ্ছে টেড হিউসের পরকীয়ামত্ত হওয়া নিয়ে বেদনা প্রকাশও করেছেন প্রচন্ডভাবে। আর পত্রগুচ্ছের মধ্যেকার সবচেয়ে বেদনার্ত অংশটি হলো যখন সিলভিয়া জানাচ্ছেন টেড তাঁকে শারীরিকভাবে আঘাত করেছেন তাঁদের দ্বিতীয় সন্তান গর্ভেই বিনষ্ট হয়ে যাবার কিছুদিন আগেই, এই দুঃখজনক ঘটনাটি ঘটেছিল ১৯৬১ সালে। আর সিলভিয়া সেই প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছিলেন ১৯৬২ সালের ২২ সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা একটি পত্রে, ওই মাসেই তাঁর সাথে টেড হিউসের ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। উল্লেখ্য, তাঁর 'পার্লামেন্ট হিল ফিল্ডস' কবিতাটিও ওই সময়ে লেখা, যাতে কিনা গর্ভের সন্তান বিনষ্ট হবার প্রসঙ্গটি এসেছিল। সিলভিয়ার প্রতি টেড হিউজের বিদ্বেষ তখন কত ভয়ানক ও চূড়ান্ত পর্যায়ের ছিল, তার নমুনা পাওয়া যায় ডা.রুথকে লেখা তাঁর আরেকটি চিঠিতে। ১৯৬২ সালের ২১ অক্টোবর লেখা ওই চিঠিতে সিলভিয়া জানাচ্ছেন যে টেড তাঁকে মুখের ওপর বলেছেন, তিনি তাঁর(সিলভিয়ার) মৃত্যৃকামনা করছেন।
সিলভিয়া প্লাথকে নিয়ে যাঁরা গবেষণা করছেন বা করেছেন, তাঁদের কাছে এই পত্রগুচ্ছ ও সিলভিয়া সংক্রান্ত আর্কাইভটিকে তাঁর জীবনী রচনার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হচ্ছে। সিলভিয়ার জীবনী রচনার ক্ষেত্রে এই আর্কাইভ ও এর অন্তর্গত পত্রাবলি নতুন উপাদান যুক্ত করবে বলেই অনেকের বিশ্বাস। এরই মাঝে প্রখ্যাত প্রকাশনা সংস্থা 'ফেবার অ্যান্ড ফেবার' থেকে সিলভিয়া প্লাথের লেখা চিঠিপত্রের একটি সংগ্রহ প্রকাশের তোড়জোর শুরু হয়েছে। দুই খন্ডে প্রকাশিতব্য সংকলনটির প্রথম খন্ড প্রকাশের সম্ভাব্য তারিখ এই বছরের ৫ অক্টোবর। প্রকাশিতব্য এই সংকলনের সহ-সম্পাদক পিটার স্টেইনবার্গ জানিয়েছেন, "এটা এমন সব উপাদানের অসামান্য সংকলন, যা কিনা পুরোপুরি আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরেই রয়ে গিয়েছিল।"

তাহলে কি ডা. রুথকে লেখা সিলভিয়ার বিস্ফোরক পত্রগুচ্ছও এই সংকলনে অন্তর্ভুক্ত হতে পারে? এমন সম্ভাবনাও দেখা দিয়েছে। পিটার জানিয়েছেন, ডা. রুথকে লেখা চিঠিগুলো এখনও তিনি দেখেননি, তবে তা অত্যন্ত 'চিত্তাকর্ষক' বলেই তাঁর ধারণা। এবং ওই পত্রগুচ্ছ সিলভিয়ার জীবনের হারানো ডায়েরি ও চিঠিপত্রের অভাব পূরণ করতেও সক্ষম হতে পারে, ফলে তাঁর জীবনের একটা অজানা পর্যায়কে উদঘাটনের সুযোগও সামনে চলে আসবে। পিটারের আশা, সিলভিয়ার চিঠিপত্রের সংকলনের দ্বিতীয় খন্ডে এই চিঠিগুলো প্রকাশ পেতে পারে। পিটার আরো মনে করেন, ওই সময় চিঠিপত্রে নিজের মনের কথা স্বাচ্ছন্দ্যসমেত বলতে পারায় সেই মুক্ত লেখনীর ছাপ তাঁর কবিতাতেও পড়েছিল– ডা. রুথকে লেখা চিঠিপত্রে সিলভিয়া তাঁর মনের সব কথা খুলে বলতে বলতেই নিজের সবচেয়ে 'মজবুত ও বিস্ফোরক' কবিতাগুলো (বেশিরভাগ এরিয়েল কাব্যগ্রন্থে সংকলিত) একের পর এক লিখে ফেলেছিলেন।
এদিকে টেড হিউসের দ্বিতীয়া স্ত্রী ক্যারল হিউস এক বিবৃতিতে পুরো ঘটনাটিকেই অস্বীকার করেছেন। প্রশ্ন তুলেছেন হঠাৎ এই চিঠিপত্রের সামনে আসা নিয়েও। টেডকে যাঁরা ভালোমতো চিনতেন, তাঁদের জন্য এরকম সংবাদ উদ্ভট ও 'শকিং' ছাড়া আর কিছু নয় বলেও তাঁর অভিমত। ক্যারল ওই বিৃবতিতে আরো বলেছেন, মনোচিকিৎসক ও রোগীর মধ্যেকার পত্রালাপ নিঃসন্দেহে সবচেয়ে গোপনীয় বস্তুগুলোর একটি। উপরন্তু এই ক্ষেত্রে অভিযোগগুলো এসেছে এমন এক ব্যক্তির থেকে যিনি কিনা দাম্পত্য সম্পর্ক থেকে বিচ্ছিন্নতার কারণে গভীর মনোবেদনায় ভুগছিলেন।
তবে বিবৃতি দিয়ে বা মামলা ঠুকে সিলভিয়া প্লাথের বিশ্বজোড়া ভক্তপাঠকদের আগ্রহকে কি দমিয়ে রাখা যাবে? এখন তাই অপেক্ষা, মামলার বেড়াজাল ভেঙে কবে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয় এই বিস্ফোরক পত্রগুচ্ছ। তবে কেউ কেউ মনে করছেন, এই পত্রগুচ্ছ আইনি জটিলতার কারণে কোনোদিনই আর আলোর মুখ দেখবে না। তবুও, আশা করতে দোষ কোথায়!

সূত্র : গার্ডিয়ান, ইন্ডিপেন্ডেন্ট।