অনু দেখা করে গেল

সাদ কামালী
Published : 4 Feb 2019, 04:02 PM
Updated : 4 Feb 2019, 04:02 PM


বাতাস আর বৃষ্টি দেখে মনে হয়না এখনও মাঘ মাস। যদিও বাতাসে শীতের কামড় মনে করিয়ে দেয় মাঘ মাস বুড়িয়ে গেলেও ফুরিয়ে যায় নি। বন্ধ জানালা দরোজার ফাঁক ফোঁকরে বাতাসের গোঙ্গানি মানুষের আর্তনাদের মত, প্রকৃতি কী শোকে দুঃখে প্রলাপ করছে! বড় বিষণ্ণ বড় অস্থির…। মেঘ বৃষ্টি কখনও এমন করুণ করে তোলেনি আগে। যদিও মেঘ বৃষ্টিতে একধরনের রোমান্টিক বিষণ্ণতার অনুভূতির অভিজ্ঞতা সংবেদী বাঙালিদের কাছে নতুন নয়। আজকের উপলব্ধি ভিন্ন,মনের মধ্যে বাতাস-গোঙ্গানির চাপা কষ্ট এড়াতে পারছি না। বসার ঘরে বসে আছি, টেলিভিশন চলছে কিন্তু কান মন অন্য কোথাও! কেন এমন লাগছে, অফিসেও যাওয়া হল না, আজ ১৯ মাঘ, ১ ফেব্রুয়ারি কী বিশেষ কোন দিন! মনে পড়ছে না। হঠা? কলিং বেল, দরোজা খুলতে খুলতে কয়েকবার বেল বাজল, সব এত অস্থির কেন! দরজা খুলে দেখি অনু,বন্ধু অনু হোসেন,হাতে একটা বই- বানানের রবীন্দ্রনাথ। মনটা খুশিতে ভরে গেল। হঠাৎ মনে হোল গতকাল রাতে এই বই আমার বিছানার ওপর ছিল না!

বলি কী ব্যাপার এই সময়ে আপনি, তাড়াতাড়ি বসেন তাওয়েল আনছি। কিন্তু না ও একদম শুকনো, অফিসে যাওয়ার পথে গাড়িতে আসছে হয়ত। কিন্ত ওর শরীর তো খুব খারাপ, অফিস করার কথা নয়। আকাশি রঙের ফুল শার্ট, অফ হোয়াইট ড্রেস প্যান্ট, কালো জুতা, পাতলা চুলেও চিরুনির সেবা বাদ পড়েনি। ছয় ফুটের বেশি লম্বা অনু সব সময় যেন খুব ফরমাল, এমনি আমাদের চিরকালের ফিটফাট অনু। বলি গ্রীন টি করে আনি। অনু বলে না না আমি এখনি উঠব, শুধু বলতে আসছি রবীন্দ্রনাথ কখনও সংস্কৃত শব্দ ব্যবহারের বিরোধিতা করেন নি বরং বানান ও প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মসিদ্ধ হতে বলেছেন, ওই সব শব্দের ক্ষেত্রে সংস্কৃত ব্যাকরণ অনুসরণ করতে নির্দেশ দিয়েছেন। সুযোগে কিছু বলতে গিয়ে দেখি অনু দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে। কথা বন্ধ করে ওর হাতে পানির গেলাস তুলে দেই- আচ্ছা পরে কথা হবে, পানি খেয়ে নেন। অনুর ঠোঁট চোখ ঘিরে মায়াময় হাসি ফোটে। একটা হাত আমার হাতের ওপর রাখে, ঠাণ্ডা হাতের স্পর্শে আমার ভিতরটা কেঁপে যায়। বলে, কাল হাসপাতালে আপনাকে দেখলাম না। তাই বুঝি দেখা করতে এলেন! বানান বিষয়ে আমাদের যে কথা হচ্ছিল…। অনু থেমে যায়, হাঁপিয়ে ওঠাটা আড়াল করতেই থেমে নেয়া। বলি, পরে কথা হবে কর্নেল, এখন নীরবতা,কিন্তু অনু বলবেই, ভুলের ছোট বড় নেই, ভুল ভুলই…, আমি চোখ ফেরাইনা ওর ওপর থেকে, শান্ত ধীর কিন্তু কী গভীর প্রত্যয় ওর কণ্ঠে! নির্ভুল শুদ্ধ পরিচ্ছন্ন এবং সময়নুবরতিতায় অনু অবিচল।
বাতাস বৃষ্টির প্রকোপ আরও বাড়ে, বেডরুমে আমার ফোন বেজে চলছে। বলি, ফোনটা ধরি। অনু খোলা চোখে তাকায়, দৃষ্টিতে কেমন বিহ্বলতা, ফোন বন্ধ হয়ে আবার বাজছে, এবার সত্যিই উঠে বেডরুমে যাই, কে এত ফোন করছে! তখন বাতাসের ঝাঁপটায় বসার ঘরের জানালা খুলে যায়, তবু আগে ফোন ধরি, বিছানার উপর বানানের রবীন্দ্রনাথ বইটি নেই! ফোনের ওপারে সরকার আমিনের শান্ত কণ্ঠ, আজ ভোর পাঁচটা বাইশ মিনিটে আমাদের অনু চির শান্তির ঘরে চলে গেছে… হাত থেকে ফোনটা ফেলে বসার ঘরে ছুটে আসি। ঘরে কেউ নেই, শুধু খোলা জানালা দিয়ে কাঁঠাল বাগানের বাতাস বৃষ্টির ছাঁট আমার ঘর ভিজিয়ে দিচ্ছে.…!