দশটি কবিতা

রাজু আলাউদ্দিন
Published : 7 May 2010, 00:21 AM
Updated : 7 May 2010, 00:21 AM

জ্বরের ঋতুতে

তখন আমাদের ঋতুবদলের দিন। খোলসত্যাগের কাল। সুস্পষ্ট কোনো সর্বনাশের ভেতর ঢুকে পড়তে চেয়েছিলাম আমরা দুজন। তার আগেই তোমার জ্বর এল। ধসনামানো জ্বর। তুমি থার্মোমিটারের পারদস্তম্ভ খিমচে ধরে ধরে উঠে যাচ্ছ সরসর করে একশো পাঁচ ছয় সাত আট… ডিগ্রির পর ডিগ্রি পেরিয়ে… সর্বোচ্চ ডিগ্রিধারী তাপের সহগ হয়ে উৎরে উঠছ তরতরিয়ে সেইখানে, যেখানে আর কোনো ডিগ্রি নাই, তাপাঙ্ক নাই… তাপের চূড়ান্ত লাস্যমাত্রায় উঠে ঠাস করে ফারেনহাইট ফাটিয়ে বেরিয়ে আসছে থার্মোমিটারের ফুটন্তঘন বীর্যতরল।

তীব্র, ধসনামানো জ্বরেও নারীরা ধসে না। কেবল তাদের কিছুটা কদাকার দেখায়, কিছুটা করালী, কিছুটা পিশাচীর মতো।
যত রূপসী তত কদাকার…

একসময় মাথাফাটা থার্মোমিটারকে ব্রুমস্টিক বানিয়ে তাতে চ'ড়ে উধাও উড়ালে অস্পষ্ট অঘটনের দিকে হারিয়ে যাচ্ছ হে তুমি প্রিয়তরা পিশাচী আমার।

জীবনে প্রথম মুখোমুখি এরকম সরাসরি স্পষ্ট বিপর্যাস…
মিটারের জ্বালাখোঁড়ল থেকে ঝরছে তখনো টগবগ-করে-ফোটা ফোঁটা-ফোঁটা রেতঃনির্যাস।

পিপীলিকা

চিনি-ভ্রমে লবণের স্বাদ নিতে গিয়ে
যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল পিপীলিকাদের,
তাতে, হায়, তারা বয়ে নিয়ে যায়
নিজের দেহের চেয়ে বহুগুণ ভারি বোঝা
পথে ও কুপথে—
নতমুখে, বিষাদ-মেজাজে
রাতদিন, নিদ্রাহীন, সমস্ত জীবন…

প্রতিমা

বৃষ্টি কম-কম লাগছে এবার।
প্রতিমার হাত-পা-মুখ অবয়ব সবই তো গড়া হলো নিখুঁত।
কিন্তু প্রাণ আরোপ করা যাচ্ছে না কিছুতেই।

যা কিছু দেখেছ কিংবা যা শুনেছ, একদম ভুলে যাও সব—
কিছুই ঘটেনি যেন দ্যাখোনি কিছুই
মেঘের আড়ালে ইন্দ্রজিৎ দ্যাখো দৃশ্যের অন্তরালে জন্ম হচ্ছে ঘটনার
মৎস্যধর্মের কাছে পরাজিত হচ্ছে শৈবাল-স্বভাব।
প্রতিমার গভীরতম প্রদেশে প্রাণ, প্রাণের প্রতিম।

সেতু

কোন-বা জাতির জাতক তুমি
কোন-বা প্রাণের প্রাণী!
আঁধারতমা আলোকরূপেই
তোমায় আমি জানি।

কোন-বা জলের জলজ আহা
কোন ঝরনায় বাস,
কোন অম্লজানের হাওয়ায়
নিচ্ছ তুমি শ্বাস?

কোন ঘটনার অনুঘটক
কোন জারণের জারক,
কোন উল্কার গতি তুমি
কোন কৃত্যের কারক?

ভাব-উচাটন পুরুষ হলে
প্রকৃতিস্থ হও।
কিংবা যদি হও প্রকৃতি,
পুরুষরত রও।

কোন ধর্মের ধর্মী ওহে
কোন-বা রূপের রূপী,
রূপ থেকে রূপ-রূপান্তরে
ফিরছ চুপিচুপি।

জন্মান্তর ঘুরে আসি
তোমায় দেখার ছলে,
কোন রূপে ফের আকার পেলে?
কোন মন্ত্রবলে?

কোন মেঘেদের বিজলি তুমি
কোন-সে কুলের কেতু,
কেমন করে তুলব গড়ে
যোগাযোগের সেতু?

তীর্থ

নারদ, পণ্ডিতশ্রেষ্ঠ, মানুষকে খুবসে বোঝাচ্ছেন—
(মানুষেরা মনোযোগ দিচ্ছে কিনা তা বোঝা যাচ্ছে না)

"এ ভঙ্গুর দেহ, কেহ কহে তীর্থ, কেহ-বা মন্দির
কেহ কহে কূটনকশা, চক্রছক, অশুভ সন্ধির।
তীর্থজুড়ে এত রূপ ও অরূপ, ধূপ-ধূনি-মন্ত্র
শলাকা, অলাতচক্র, বহুতল কুঠুরি ও রন্ধ্র।
মন্দিরের তলা দিয়ে নদী বয় তরঙ্গসংকুল
শীঘ্রস্রোতা, দুকূল-ছাপানো, বাঁকা, কুমিরবহুল
ক্ষণেই সরল বটে সেই নদী ক্ষণেই বঙ্কিম
পাড় ভাঙে, ফেনা জাগে, হাঁস ডাকে হরেক কিসিম।
বুদ্বুদের থেকে বহু উৎপন্ন বুদ্বুদ, রকমারি,
বিম্ব থেকে আরো বিম্ব, বহুবিম্বধারী।

দেহ-এত মেদ মেধা আয়োজন, রঙ রতি অঘটন, গতি ও রহস্য!
দেহ-তা-সে বপু হোক তনু হোক, পুড়লে তো বাপু সেই দেড় কেজি ভস্ম!"

সর্ব-অঙ্গে অমৃতকথন শুনে পণ্ডিতশ্রেষ্ঠের
ঝিমুনিস্বভাব জাগে মানবের ও-তনুতীর্থের।

অভ্যুদয়

সহসাই টলে ওঠে স্থিতি
শেষ হয়ে আসে সুদীর্ঘ তিতিক্ষাকাল।
স্থিতিভঙ্গ থেকে সাম্যবিভ্রাট—
তা থেকে আচমকা অভ্যুত্থান।

এক বিপুল অণ্ডের ফুলক্রামে ভর দিয়ে লিভারের মতো
দেখতে-দেখতে দাঁড়িয়ে যায় নিদ্রামগ্ন অনন্তলিঙ্গম্
এতে যে যান্ত্রিক সুবিধা হয় তাতে বাড়তি বেগ আসে অভ্যুত্থানে, উদ্গীরণে।

ওই যে ধাবিত মহালিঙ্গ…
উচিত বেগেরও অধিক অবিশ্বাস্য বেগে
ধেয়ে গিয়ে বিঁধে যাচ্ছে ব্রহ্মঘূর্ণির ঠিক কেন্দ্র বরাবর…

বনবিড়াল

বনবিড়াল ফিরে গেছে বনে, ফেলে রেখে গেছে তার হাসি।
সে-হাসি বন্যবৈড়াল, সেই হাসি অতিবৈড়ালিক।
তাকেই মুখোশ করে লাগিয়ে নিয়েছে মুখে গৃহস্থ মানুষ—
সেজেছে রহস্যহাসি, বনেছে সুকান্ত সদানন্দ বণিক।
বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে তালে-তালে। হাটে-হাটে, নগরে-বন্দরে,
মুখরিত মিথ্যালোকে, রহস্যবৈড়ালে…

এখন বনবিড়াল ঘোরে বনে-বনে—হাসিরিক্ত, বিরসবদন…

লীলা

রামশরণ ব্যাধ গিয়েছিল শিকার করতে, প্রহ্লাদপুরের জঙ্গলে। শিকার মিলেছে প্রচুর। শিয়াল, শজারু, শকুন, গোধিকা, গন্ধগোকুল, ফেজান্ট, কাছিম…। মেলেনি কেবল কাক আর বক; ওদেরকে তো আগেই ভস্ম করে দিয়েছে তপস্বী। দুপুরের দিকে পশুপাখিগুলিকে কেটেকুটে মাংসের ভাগা দিয়ে বসেছে ব্যাধ, পাকুড় গাছের নিচে। সাতমিশালি মাংস, বিক্রি হচ্ছে খুব…। শব হয়ে শুয়ে আছে শিব। কালী লীলা করছে তার বক্ষের ওপর, যেভাবে প্রকৃতি লীলা করে পুরুষের ওপর; জীব, পরমের। বালিতে মেশানো চিনি, নিত্য-র সাথে অনিত্য যেমন। এসো পিঁপড়া দলে-দলে, সিরিজে-সিরিজে, বালি রেখে চিনি বেছে খাও…।

ফেরার পথে একটি ঘাসখেকো বাঘের শাবকও সাথে করে এনেছে রামশরণ। জন্মের পরপরই মেষেদের সঙ্গে চলে গিয়েছিল আলাভোলা ব্যাঘ্রশিশু। সে এখন ঘাস খায় বটে, কিন্তু রাগ আছে ঠিকই, ক্ষাত্রতেজ অব্যাহত… ঠাস-ঠাস করে থাপড়ায়, দাবড়ায়, বড়-বড় নিরীহ ভেড়াদের।

হংস

চুপে চুপে পাঁকে নেমে হরদম খাও হে পঙ্কজ
পালকে লাগে না তবু কর্দম একটুও!
ডানা ঝেড়ে পাঁক থেকে উঠে সোজা যাও সরোবরে।
জলের উপরিতলে ভাসো
আধো-জাগা আধেক-নীরব নিদ্রাকুসুমের দেশে ভেসে বেড়াও নির্ভার
তোমার ওপর নাই জগতের ভার, ওরে ভীরু
ওরে সুখী ওহে স্বচ্ছ সাঁতারবিলাস
দুধের জলীয়ভাগ ফেলে শুষে নাও দুগ্ধসার
দ্রবণের থেকে দ্রাব্য-দ্রাবক আলাদা করে নিয়ে তবে করো হে আহার।

রে হংস, পরমহংস ওহে
হংসলীলা যেইদিন করো সংবরণ
পরিহাসরূপে দেখা দেয়
জগতের যত ডিগবাজি ডুবসাঁতার, বিবিধ সন্তরণ…

আবাহনের, নাকি বিসর্জনের?

ছুটন্ত বিমানের আগে আগে উড়ে চলেছে বাজপাখি, বার্তাবহ, ডানায় মেঘবাষ্প, চঞ্চুতে চিরকুট, যেন চিরকালীন গতি ও বার্তা একসঙ্গে মিলেমিশে পেয়েছে ধাবন্ত পাখির রূপ। মেঘের ভেতর থেকে, থেকে থেকে, ডলফিনের লাফ। নিচে থোকা-থোকা নারকেল ধরে আছে গাছে। নারকেলের ভেতরে দুধের বদলে বাষ্পীভূত কোলাহল। নিচে আরণ্য-সমাজ। নিচে শকুনি গৃধিনী, অহি ও নকুল, নিপদ দ্বিপদ শ্বাপদ ও চতুষ্পদ, সাপ ও গোসাপ, গন্ধগোকুল-কুল। তারা দৃষ্টিতে শ্যেন, চাতুর্যে শৃগাল, বুদ্ধিতে বায়স। নলখাগড়ার বনে নলের ভেতর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে আসছে নলজাতক, এদিকে বাঁশবনে কানা হয়ে বসে আছে ডোম, কিছুটা দূর থেকে ভেসে আসছে ডোমনির ঝামট-মারা কণ্ঠ; ডোমনি বলছে, 'মড়ারও আবার কত্তো রঙ্গের ফ্যাশান!' আবার বলছে, 'নাই-ঘরে মরদের খাঁই কত!' ওদিকে সুশীলদের পাড়ায় বাদ্য বেজেই চলেছে… সে-বাদ্য আবাহনের না বিসর্জনের, বোঝা যাচ্ছে না… গাঙচিল আর উড়ুক্কু মাছেরা একনাগাড়ে বিরক্ত করে চলেছে নাবিকদের, উড়ে এসে গোত্তা খাচ্ছে তাদের পিঠে ও মাথায়, জাহাজের গলুই ও পাল বরাবর…

বহুকাল-আগে-মৃত কিছু উপগ্রহ-কৃত্রিম, আনখলিঙ্গ বানোয়াট-ভেসে বেড়াচ্ছে শূন্যমার্গে, নিঃসাড় নির্ভার, মরা তিমিমাছের মতন। পরিশিষ্ট হয়ে পড়ে আছে কারো কারো শুধু হাড়গোড়।

মৃতেরা কথা বলতে পারে না।
বহুকাল পরে তাদের হয়ে কথা বলে তাদের কঙ্কাল।