যুদ্ধাহতের ভাষ্য: ৩৬ ‘‘ওরা হত্যা করেছিল মানবতা আর গণতন্ত্র’’

সালেক খোকনসালেক খোকন
Published : 4 August 2011, 06:34 AM
Updated : 18 August 2015, 02:43 PM

''সাংবাদিকদের সাক্ষাতকার দিয়েছি অনেক। তা ছাপাও হয়েছে। সেই সাক্ষাতকার পড়ে অনেকেই যুদ্ধকালীন সময়ের ঘটনা বানিয়ে নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করে। এ পন্থায় কয়েকজন অমুক্তিযোদ্ধাও মুক্তিযোদ্ধা হয়েছে। এখন তাই কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছি।''

মুঠোফোনে এমনটাই বললেন যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা। মুক্তিযুদ্ধে অসাধারণ সাহস আর বীরত্বের জন্য তিনি বাংলাদেশের তৃতীয় সর্বোচ্চ উপাধি 'বীর বিক্রম' ও একই সঙ্গে চতুর্থ সর্বোচ্চ 'বীর প্রতীক' সম্মাননা পেয়েছেন।

আমরা ধৈর্যহারা হই না। দিন দুয়েক পরে আবার তাঁর সঙ্গে কথা চলে। এবার তিনি মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বলতে রাজি হলেন। আমরাও তখন হাজির হই ঢাকার কলেজ গেটের স্বাধীনতা টাওয়ারে। এখানেই সরকার থেকে প্রাপ্ত একটি ফ্ল্যাটে বসবাস করছেন গোলাম মোস্তফা।

ঢাকার দোহার উপজেলার ঝনকি গ্রামের সন্তান তিনি। তাঁর বাবার নাম ফালু শেখ ও মা আমেনা আসিয়া। ১৯৬৯ সালে তিনি যোগ দেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। আর্মি নং- ৩৯৩৯০০৬। কর্মরত ছিলেন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। অতঃপর ১৯৭১ সালে তিনি প্রথমে ল্যান্স কর্পোরাল ও পরে কর্পোরাল হন।

সে সময় ব্যারাকের ভেতরের বৈষম্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

''পাকিস্তানিদের কাছে আমরা ছিলাম বাঙাল। ওরা আমাদের নানাভাবে উপহাস করত। আমরা খেতাম ভাত, ওরা খেত রুটি। এ নিয়ে ওরা হাসাহাসি করত। কথায় কথায় বলত, 'মুজিব কা বাচ্চা'। প্রতিবাদ করলে উল্টো আমাদেরই শাস্তি পেতে হত।''

গোলাম মোস্তফার কাছে বঙ্গবন্ধু হলেন 'বাংলার অলি'। সময়টা ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ। ব্যারাক থেকে তিনি গোপনে চলে যান রেসকোর্স ময়দানে। খুব কাছ থেকে শোনেন মুজিবের ঐতিহাসিক ভাষণটি। বঙ্গবন্ধুর ওই ভাষণ আজও তাঁর মনে গেথে আছে। এটিই তাঁর কাছে স্বাধীনতার স্পষ্ট ঘোষণা। তাঁর ভাষায়:

''বঙ্গবন্ধু বললেন, 'আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি… তোমাদের যার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবিলা… এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম… এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।' এর চেয়ে বড় ঘোষণা আর কী হতে পারে! 'জয় বাংলা' স্লোগান হল মুক্তিযোদ্ধাদের স্লোগান। একাত্তরে এই স্লোগানই আমাদের সাহস বাড়িয়ে দিত শত গুণ।''

২৫ মার্চ, ১৯৭১। ঢাকার বুকে নামে পাকিস্তানি হায়েনারা। গ্রেফতার করা হয় শেখ মুজিবকে। রক্তাক্ত গণহত্যা চালানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও জগন্নাথ হলে। এভাবে সারাদেশে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। সেনাবাহিনীর বাঙালি যোদ্ধারাও জোটবদ্ধ হন। জয়দেবপুর থেকে বেড়িয়ে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট তখন অবস্থান নেয় ভৈরবে। এ রেজিমেন্টের অধীনে গোলাম মোস্তফা যুদ্ধ করেন ৩ নং সেক্টরে। সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর জেনারেল কে এম সফিউল্লাহ। সে সময় প্রায় ১০০ সৈন্য নিয়ে গঠিত হত এক একটি কোম্পানি।

সাব-সেক্টরসহ আলফা কোম্পানির কমান্ডার ছিলেন আবু সালে মোহাম্মদ নাছিম বীর বিক্রম (সাবেক সেনাপ্রধান)। গোলাম মোস্তফা ছিলেন ওই আলফা কোম্পানির একটি সেকশনের কমান্ডার।

কোথায় কোথায় অপারেশন করেছেন?

তিনি বলেন:

''এপ্রিল মাসে আমরা ঢাকায় ঢোকার চেষ্টা করি। নরসিংদী পর্যন্ত এসে আবার পিছু হটি। অতঃপর ব্রাক্ষণবাড়িয়া, আশুগঞ্জ হয়ে মাধবপুরে গিয়ে ডিফেন্স নিই। আমাদের কাছে ছিল স্টেনগান, থ্রি ইঞ্চ মর্টার, হেভি মেশিনগান প্রভৃতি। কিন্তু পাকিস্তানিদের কাছে ছিল আর্টিলারি, ফোর ইঞ্চ মর্টার, কামান ও ট্যাংক। ফলে আমরা সেখানেও টিকতে পারিনি। পরে ভারতের তেলিয়াপাড়া হয়ে চাকলামারা বাজারের পাশে পঞ্চভুটি পাহাড়ের কাছে অবস্থান নিই আমরা। সেখান থেকে মনতলা, নওয়াপাড়া, তেলিয়াপাড়া, গোপালপুর, মাধবপুর, ধর্মগড় প্রভৃতি এলাকায় আক্রমণ করে আবার ফিরে আসতাম।''

৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার চান্দুরায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে মারাত্মকভাবে আহত হন মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা। পাকিস্তানিদের ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে তাঁর দুই হাত, পেট ও দুই পা ঝাঁজরা হয়ে যায়। পরে তাঁর ডান পাটি হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। অন্য পায়ে জখমের চিহ্ন এখনও স্পষ্ট। দুই পায়ের অসহ্য ব্যথায় তিনি ঠিক থাকতে পারেন না। বর্তমানে হুইল চেয়ারই তাঁর নিত্য সঙ্গী।

কী ঘটেছিল একাত্তরের ওই দিনটিতে? প্রশ্ন শুনে এই বীর মুক্তিযোদ্ধা খানিকটা নিরব হয়ে যান। অতঃপর বলতে থাকেন রক্তাক্ত সে দিনের আদ্যোপান্ত।

তাঁর ভাষায়:

''আমি তখন সেভেন প্লাটুনের কমান্ডে। মাধবপুরের চান্দুরা ডাকবাংলোর কাছে আমরা অবস্থান নিই। উদ্দেশ্য শাহবাজপুর ব্রিজ ও আশপাশের এলাকায় আক্রমণ করা। সেখানে ছিল পাকিস্তানি সেনাদের শক্তিশালী ঘাঁটি।

বেলা তখন সোয়া চারটা। আমরা ডাকবাংলো থেকে সিএমভির রাস্তা দিয়ে চান্দনা ব্রিজের পাশে অবস্থান নিই। হঠাৎ গুলির শব্দ। তাকিয়ে দেখি ব্রিজের ওপর পাকিস্তানি সৈন্য ভর্তি ট্রাক ও পেছনে একটি আর্মির জিপ। তারা আমাদের দিকে তাক করে গুলি চালায়। আমি তখন দ্রুত ব্রিজের ওপরে উঠে পড়ি। 'জয় বাংলা' স্লোগান তুলেই গুলিতেই গুলির প্রত্যুত্তর দেই। ফলে ছিটকে পরে পাকিস্তানিদের ট্রাকটি। ট্রাক থেকে নেমে সেনারা অবস্থান নেয় ব্রিজের পাশের বাঙ্কারে।

তুমুল গোলাগুলি চলছিল। ব্রিজের পাশ থেকে এক পাকিস্তানি সৈন্য এলএমজি চালাচ্ছিল। তার কারণে আমরা এগোতে পারছিলাম না। আমাদের এলএমজি ম্যান ছিল ফজলু। তার কাছ থেকে এলএমজিটা নিয়ে আমি আবার সোজা উঠে যাই ব্রিজের ওপর। ওই পাকিস্তানির দিকে তাক করে গুলি চালাই। কিন্তু তার আগেই তার ব্রাশে ফায়ারের গুলি আমার পেট, হাত ও পা দুটি ঝাঁজরা করে দেয়।

প্রথমে টের পাইনি। সারা শরীরে রক্ত দেখে পাশ থেকে আদম আলী চিৎকার দিয়ে বলে ওঠে, 'স্যার গো, স্যার, আপনার পেটে গুলি লাগছে।' আমি তখন বাম পাশে উপুড় হয়ে পড়ে যাই। আমার হাত-পা চলছিল না। ভেবেছি মরে যাব। মনে মনে বলতে থাকি, 'লা ইলাহা.. ইল্লাল্লাহু…'।

মাত্র আধ ঘণ্টার ওই অপারেশনে শহীদ হন হাবিলদার রফিক ও সিপাহী নজরুল। আমি ছাড়াও আহত হন ১৭-১৮ জন। প্রথমে আগরতলা হাসাপাতালে এবং পরে ধর্মদহ, গৌহাটি ও লখনৌ ট্রমা হাসপাতালে চিকিৎসা চলে আমার। বেঁচে গেলেও ডান পাটি হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। এখন হুইল চেয়ারই আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু।''

সেনাবাহিনীতে থাকা মুক্তিযোদ্ধারা তাদের চাকরি পূর্ণ করেই অবসর নিতে পারবেন এমন নির্দেশনা দিয়ে স্বাধীনতার পর সরকারিভাবে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করা হয়। যুদ্ধের পর গোলাম মোস্তফা তাই থেকে যান সেনাবহিনীতেই। কিন্তু পঁচাত্তরের পর সবকিছু বদলে যেতে থাকে। ওই নির্দেশনাটিও তখন বাতিল হয়ে যায়। ফলে অনেকের মতো গোলাম মোস্তফাকেও ১৯৭৭ সালে সেনাবাহিনী থেকে অবসর দেওয়া হয়।

তাঁর মতে, সেনাবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধারা অনেকটাই অবহেলিত। একাত্তরের ২৬ মার্চ থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাথমিকভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জোয়ানরাই। অথচ সেই সেনাবাহিনী থেকে অবসর নেওয়া মুক্তিযোদ্ধারা পান না মুক্তিযোদ্ধা ভাতা। তাদের দেওয়া হয় শুধুই তাদের চাকরির অবসরভাতা। অথচ সরকারি অন্য বিভাগের কর্মকর্তা ও কর্মচারিদের ক্ষেত্রে এ নিয়ম নেই। এ প্রসঙ্গে তিনি দুঃখ করে বলেন:

''আমি নিজে ইন্সট্রাক্টর ছিলাম। ট্রেনিং করিয়েছি প্রায় ২৫০ মুক্তিযোদ্ধাকে। সেনাবহিনীর লোকেরাই মুক্তিযোদ্ধা তৈরি করেছে। অথচ স্বাধীন দেশে তারা মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাবে না এটা তো ঠিক নয়।''

কথা ওঠে আল বদর, আল শামস ও রাজাকারদের বিচার নিয়ে। তিনি বলেন:

''বঙ্গবন্ধু তো ওদের বিচার শুরু করেছিলেন। তাঁর সময়ের আইন ছিল বলেই বর্তমানে বিচার করা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু ১৫ আগস্ট ১৯৭৫ তারিখে জাতির জনককে হত্যার পর সব কিছু পাল্টে যেতে থাকে। জিয়া এসে দালাল আইন বাতিল করে বিচারটা বন্ধ করে দেন। যুদ্ধাপরাধীরা তখন নাগরিকত্ব পায়। পায় রাজনীতি করার বৈধতাও। দেশ তখন পাকিস্তান স্টাইলে ফিরে যায়। যারা স্বাধীনতার বিরোধীতা করেছিল তারাই বনে যায় মন্ত্রী।''

জিয়াউর রহমান তো একজন মুক্তিযোদ্ধাও ছিলেন, কিন্তু তিনি কেন এমনটা করলেন?

গোলাম মোস্তফা সরাসরি বলেন:

''ক্ষমতা ও অর্থের লোভে। শহীদ ও যুদ্ধাহতদের রক্তে রঞ্জিত স্বাধীন দেশের পতাকা জিয়া তুলে দিয়েছিলেন রাজাকারদের গাড়িতে। এ দায় থেকে তিনি বা তার দল কখনও বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমি একাত্তরের জিয়াউর রহমানকে স্যালুট করি। কিন্তু পঁচাত্তরের পরের জিয়াউর রহমান আমার কাছে শুধুই একজন ঘৃণিত খুনি, মুক্তিযোদ্ধা হত্যাকারী।''

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর সেনাবাহিনীর ভেতরে হত্যাকাণ্ডের বর্ণণা করেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। তাঁর ভাষায়,

''আমি তখন যশোর ক্যান্টনমেন্টে, প্লাটুন হাবিলদার ছিলাম। বঙ্গবন্ধুর হত্যার খবর শুনেই রায়হান ও সুবেদার জনাব আলীসহ বেশ কয়েকজন ঢাকার দিকে আসার প্রস্তুতি নিই। কিন্তু ব্যারাক থেকেই আমাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। অপেক্ষায় থাকি প্রতিবাদের। কয়েকজন নেতার সঙ্গে যোগাযোগও হয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সারা দেশে আওয়ামী লীগের বড় বড় লিডারাও তখন টু শব্দটি করেনি।

আমরা তখন ভয়ে তটস্থ ছিলাম। পাকিস্তান-ফেরত সেনারা আমাদের অন্য চোখে দেখত। মাঝে মধ্যেই মুক্তিযোদ্ধা অফিসাররা হারিয়ে যেত। কেউ কেউ বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফিরে আসত না। কোথায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে তাদের কেউ জানত না। অনেক মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে নির্মমভাবে হত্যাও করা হয়েছে। তাদের পরিবার পরিজনদের কথা কি আমরা মনে রেখেছি? ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট থেকে ১৯৭৭ সালের নভেম্বর পর্যন্ত সেনাবাহিনীতে যেসব অফিসার ও সেনাকে হত্যা করা হয়েছে তারও বিচারও হওয়া উচিত।''

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড নিয়ে মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা অকপটে তুলে ধরেন নিজের মতামতটি। তিনি বলেন:

''তাঁর ডাকেই তো মুক্তিযুদ্ধ করেছি। একাত্তরে পাকিস্তানি সেনারাও তাঁকে হত্যা করতে পারেনি। কিন্তু স্বাধীন দেশে সেনাবাহিনীর কিছু কুলাঙ্গার তাঁকে নির্মমভাবে সপরিবারে হত্যা করে। নয় মাসে স্বাধীনতার জন্য আমরা যেমন বীরের জাতি, তেমনি বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে বিশ্বের কাছে আমরা প্রমাণ করেছি আমরা নিমকহারাম জাতিও। বঙ্গবন্ধু মানুষের মন থেকে কখনও হারাবেন না। শুধু বঙ্গবন্ধুকে নয়, ওরা হত্যা করেছিল মানবতা আর গণতন্ত্রও।''

দেরিতে হলেও সব বাধাকে উপেক্ষা করে স্বাধীন এই দেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হচ্ছে। স্বাধীন দেশের বাতাস হয়ে উঠেছে পবিত্র। মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা মনে করেন এর পেছনে যে ব্যক্তিটি শক্ত হাতে দেশে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করেছেন তিনি বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা। রাজাকারদের বিচার নিশ্চিত করে ও দুর্নীতিবাজদের দেশ থেকে উৎখাত করে একদিন তিনি বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলবেন, এমনটাই বিশ্বাস এই বীর মুক্তিযোদ্ধার।

মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রসঙ্গে তিনি বলেন:

''১৯৭২এ একটি নির্দেশনা ছিল যারা সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন শুধু তারাই থানা কমান্ডার হতে পারবেন। কিন্তু পরবর্তীতে এ নিয়মও বাতিল হয়ে যায়। ফলে রাজনৈতিক প্রভাবে কিছু অমুক্তিযোদ্ধা থানা কমান্ডার হওয়ায় তাদের হাত ধরেই অমুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকাররা তালিকায় আসে।''

তাঁর মতে, তালিকা করার উপযুক্ত সময় ছিল ১৯৭২-৭৩। ১৯৭৩এ খেতাবপ্রাপ্তদের গেজেট প্রকাশিত হয়। চাইলে তখনই সম্ভব ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রকাশ করা।''

লোভে পড়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাই আজ তাদের সম্মানটুকু রক্ষা করতে পারছেন না বলে মনে করেন মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মোস্তফা। তিনি বলেন–

''মুক্তিযোদ্ধারা দুর্নীতিগ্রস্ত ও স্বার্থপরায়ণ হলে জাতির জন্য তা হবে অপমানের। তাই সেটিরও কঠোর বিচার হওয়া উচিত। কারণ আইন সবার জন্যই সমান।''

প্রসঙ্গক্রমে তিনি দুঃখের সঙ্গে যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসনের জন্য সরকারিভাবে নির্মিত ঢাকার কলেজ গেটের স্বাধীনতা টাওয়ার-১এর একটি অনিয়মের চিত্র তুলে ধরেন। তাঁর ভাষায়:

''সরকার দুঃস্থ, যুদ্ধাহত ও শহীদ পরিবারের আবাসনের কথা চিন্তা করেই ভবনটি নির্মাণ করেছে। বছর দুয়েক আগে সরকারিভাবে ৭২টি ফ্ল্যাটের মধ্যে ৩১ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ৩১টি ফ্ল্যাট ও দোকানের অনুমোদনও প্রদান করা হয়। কিন্তু এর কিছুদিন পরেই বাকি ৪১টি ফ্ল্যাট কিছু যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধারা দখল করে নেয়। তারা অদ্যাবধি অবস্থান করছেন অনুমোদন ছাড়াই। সরকার তাদের নামাতেও পারছে না। প্রধানমন্ত্রী নিজেও বিষয়টি নিয়ে বিব্রত হচ্ছে। মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে এমনটা তো জাতি আশা করে না। একটি ভবনই যদি সরকার নিয়মতান্ত্রিকভাবে বরাদ্দ দিতে না পারে তাহলে সারা দেশের মুক্তিযোদ্ধাদের আবাসন নিয়ে কীভাবে পরিকল্পনা করবে?''

মুক্তিযোদ্ধাদের রাজনৈতিক দলে বিভক্ত হওয়া প্রসঙ্গে এই সূর্যসন্তান বলেন:

''পঁচাত্তরের পর থেকেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলা শুরু হয়েছে। এখন তো সব রাজনৈতিক দলেরই মুক্তিযোদ্ধা দল রয়েছে। আমি মনে করি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দল একটাই, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ।''

স্বাধীন দেশে ভালোলাগা জানতে চাইলে তিনি বলেন:

''খেলার সময় অন্য দেশে যখন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ে। আমার দেশের একুশে ফেব্রুয়ারি যখন সারা বিশ্বে মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়। তখন গর্বে বুকটা ভরে যায়।''

কষ্টের অনুভূতি কী? প্রশ্ন করতেই গোলাম মোস্তফার মুখটি ম্লান হয়ে যায়। অতঃপর তিনি বলেন:

''যখন দেখি রাজনীতিবিদ ও সরকারি আমলারাও দুর্নীতিতে যুক্ত রয়েছেন। তখন কষ্ট লাগে। এমন দেশ তো চাইনি আমরা। দুর্নীতিবাজ থাকলে দেশটা তো সোনার বাংলা হবে না!''

দেশে নানা সমস্যা থাকলেও যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফার বিশ্বাস ও আস্থা নতুন প্রজন্মের প্রতি। চোখে মুখে আলো ছড়িয়ে তাদের উদ্দেশে তিনি শুধু বললেন:

''আমরা বীরের জাতি। নয় মাসে দেশের স্বাধীনতা এনেছি। সেই স্বাধীন দেশকে এগিয়ে নিবে তোমরাই। দুর্নীতির হাত থেকে দেশকে রক্ষা করে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ার দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে।''

সংক্ষিপ্ত তথ্য

নাম: যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা সার্জেন্ট মোহাম্মদ গোলাম মোস্তফা, বীরবিক্রম ও বীরপ্রতীক।

ছিলেন: সেনাবাহিনীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে। আর্মি নং- ৩৯৩৯০০৬।

যুদ্ধ করেছেন: ৩ নং সেক্টরের আলফা কোম্পানির একটি সেকশনের কমান্ডার হিসেবে।

যুদ্ধাহত: ৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১। বিকেল ৪টা। ব্রাক্ষণবাড়িয়ার চান্দুরায় এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে পাকিস্তানিদের ব্রাশ ফায়ারের গুলিতে তাঁর দুই হাত, পেট ও দুই পা ঝাঁজরা হয়ে যায়। পরে তাঁর ডান পাটি হাঁটুর নিচ থেকে কেটে ফেলতে হয়। বর্তমানে হুইল চেয়ারই তাঁর নিত্য সঙ্গী।

ছবি ও ভিডিও: সালেক খোকন।

সালেক খোকন: লেখক, গবেষক ও প্রাবন্ধিক