ভাষা আন্দোলনের সময় নিয়ে রফিকুল ইসলামের সাক্ষাৎকার শেষ কিস্তি

বেবী মওদুদ
Published : 28 Feb 2011, 09:22 AM
Updated : 28 Feb 2011, 09:22 AM


২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২: ১৪৪ ধারার মধ্যে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে জমায়েত
ছবি: রফিকুল ইসলাম

সাক্ষাৎকার নিয়েছেন: বেবী মওদুদ

বেবী মওদুদ: মানে এইভাবে যে গুলি চালিয়ে ছাত্রদের হত্যা করবে এটা তো ভাবার বিষয় ছিল না।

রফিকুল ইসলাম: এটা কল্পনার অতীত ছিল এবং কোন রকম সতর্কীকরণ না, কিছু না। গুলিটা করছিল ওরা মেডিকেল কলেজের হোস্টেলের যে  মোড়টা, ওখান থেকে। তার কারণ হচ্ছে যে অপরাহ্ণে বাজেট অধিবেশন বসার কথা জগন্নাথ হল মিলনায়তনে। তখন ঐ যে এমএলএ-রা একজন একজন করে যাচ্ছিলেন ওদের ধরে নিয়ে এসে আমরা মেডিকেল কলেজের ভেতরে গুলিতে-লাঠিতে-টিয়ার গ্যাসে শত শত ছাত্র জনতা আহত এবং লাশ হয়ে পড়ে রয়েছে,  এগুলো আমরা ওদের দেখাচ্ছিলাম। ওরা আবার ওখানে গিয়ে মাওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মনোরঞ্জন ধর, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন ওদের গিয়ে বললেন। নুরুল আমীন কিন্তু প্রথমে ছিল না ওখানে। পরে সে যখন আসে অ্যাসেম্বলীতে, সে কিন্তু স্বীকার করে নাই যে গুলি চলেছে। অদ্ভুত ব্যাপার—­­­জগন্নাথ হল থেকে কিন্তু দেখা যায় যেখানে গুলি চলেছে এবং ওরা বলেছে, আপনি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চলুন, গিয়ে দেখুন ওখানে কি দৃশ্য-মানে এখানে একটা রণাঙ্গণ। কিন্তু নুরুল আমীন যেতে রাজি হয় নাই।

এইভাবে ২১ শে ফেব্রুয়ারি গেল। পরদিন ২২শে ফেব্রুয়ারি এলো। তবে ২১শে ফেব্রুয়ারি রাত্রেই সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে মাইক্রোফোন লাগিয়ে বক্তৃতা ও কর্মসূচী দিতে লাগলো জনতার উদ্দেশ্যে। মজাটা হচ্ছে, গুলি চলার পর পরই আমাদের নেতা যারা ছিল তারা আত্মগোপন করলেন। তখন ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বটা গ্রহণ করলো সলিমুল্লাহ হলের অ্যাথলেটিক ক্লাবের সব খেলোয়াড়রা। অ্যাথলেটিক ক্লাবের যে সেক্রেটারি ছিল তার নাম আসাদুল আমিন আসাদ। তিনি খুব ভালো ছাত্র ছিলেন। ফিজিক্স অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস এমএসসি'র ছাত্র ছিলেন এবং টেনিস ব্লু পেয়েছিলেন। তার নেতৃত্বে ঐ মুসলিম হল থেকে অ্যাথলেটিক ক্লাবে যারা সদস্য ছিল, তারা নেতৃত্ব দিল। ওদিকে ওরা আর এদিকে মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা। অর্থাৎ এই ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বটা প্রথম থেকেই ছাত্র সমাজের কাছে ছিল।

বেবী মওদুদ:: ফজলুল হক হলে ছিল, সেখান থেকে এস এম হলে চলে গেল।

রফিকুল ইসলাম: ফজলুল হক হলে ছিল ১৯৪৮সালে। ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি সকাল বেলা বিশাল গায়েবী জানাজা হলো। সেখানে শেরে বাংলা এসেছিলেন, আমার মনে আছে। ওখান থেকে আমরা যখন কার্জন হলের সামনে গেছি তখন আবার গুলি।

বেবী মওদুদ: ঐ দিন?

রফিকুল ইসলাম: ঐ দিন, মানে ২২ তারিখে।  এবং গুলি চললো। তখন সবাই দু'ভাগ হয়ে গেল। আমরা কার্জন হলের দেয়াল টপকে ফজলুল হক হলের ভিতর দিয়ে চলে গেলাম। আমি, হাসান আজিজুর রহমান, গাফফার চৌধুরী,  কয়েকজন আমার বাসায় চলে গেলাম। এই ২২ তারিখে আর একটা অংশ নওয়াবপুরের দিকে গিয়ে  'সংবাদ' পত্রিকা অফিসে আগুন দিল, 'মনিং নিউজ' অফিসে আগুন দিল।

বেবী মওদুদ: সংবাদ তখন মুসলীম লীগের পত্রিকা ছিল।

রফিকুল ইসলাম: মুসলীম লীগের পত্রিকা এবং নুরুল আমিনের পত্রিকা ছিল। সারা দিন ধরে এইসব চললো। পুরানো ঢাকায় তখন কিন্তু আর্মি নামিয়ে দিয়েছে। ঢাকা শহরের ঢাকাইয়াদের সঙ্গে পুলিশ, ইপিআর এইভাবে সারাদিন মারামারি চললো।।

বেবী মওদুদ: তখন কি মানুষ দোকান পাট বন্ধ করে  রাস্তায় নেমে গেছে?

রফিকুল ইসলাম: সব মানুষ নেমে গেছে। এই ঢাকাবাসী যারা '৪৮ সালে আমাদেরকে পিটিয়েছে। '৫২সালে তাঁরা হাড্ডাহাড্ডি লড়াই করেছে এবং হাইকোর্টের কর্মচারী সফিউর রহমান, তিনি কিন্তু ঐ নওয়াবপুরে গুলিবিদ্ধ হন এবং হাসপাতালে মারা যান। ঐ দিনই, মানে ২২ তারিখ রাত্রে। কাজেই ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ রফিকউদ্দিনের লাশ গুম, বরকতের লাশ পাওয়া গেছে, কবর আছে। ২২ তারিখে সফিউর রহমানের লাশটা পাওয়া গেছে আর কারো লাশ পাওয়া যায় নাই। একজন রিক্সাওলা মারা গিয়েছিলেন, আবদুল আউয়াল। তঁার লাশ পাওয়া যায় নাই।

বেবী মওদুদ: জব্বার—

রফিকুল ইসলাম: ওরা কেউ ঐ দিন বা কেউ পর দিন হাসপাতালে মারা গেছেন।

বেবী মওদুদ: সালাউদ্দিন নামে কেউ মারা গিয়েছিল?

রফিকুল ইসলাম: না, সালাউদ্দিন নামে কেউ মারা যায় নাই। রফিক উদ্দিন নামে মারা গেছে, ঐ নামটা ভুলে আজাদ পত্রিকায় ভুলে সালাউদ্দিন নামে ছাপা হয়েছে। আজাদ পত্রিকা একটা টেলিগ্রাম ইস্যু বের করেছিল।  এইসব ঘটনা  চলে তোমার ২২ তারিখ-২৩ তারিখ; দুই দিনই ঢাকা শহরে লড়াই চলে।

বেবী মওদুদ: এ আন্দোলনটা কি তারপরে ঢাকার বাইরেও ছড়িয়ে যায়?

রফিকুল ইসলাম: একেবারে বিদ্যুৎ গতিতে, প্রায় সারা বাংলাদেশে। বেতার বন্ধ হয়ে যায়, রেলওয়ে বন্ধ হয়ে যায়।  সে একটা অদ্ভুত ব্যাপার। পাকিস্তান হলো মাত্র কয়দিন হলো, তার মধ্যে এই ঘটনা! তারপর যেটা হলো—তোমার ২৩ তারিখ, রাতারাতি মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা দশ ফুটেরও উঁচু একটা  শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ তৈরী করে ফেলে। পরদিন সকাল বেলা থেকে ওটা বাঙালির তীর্থক্ষেত্র হয়ে গেলো। শত শত  লোক আসছে, ফুল দিচ্ছে। একজন মা একটা বাচ্চা মেয়েকে ধরে ওখানে এলেন। তার হাতে ফুল ছিল না, তখন এত ফুল পাওয়া যেত না। তিনি তার গলার হার খুলে দিয়ে দিলেন। এইভাবে চললো পুরো ২৪, ২৫, ২৬—তিন দিন এবং এই তিন দিনে কিন্তু তোমার এই যে আন্দোলন এবং আন্দোলনের শেষে শহীদের স্মৃতিতে এসে ওখানে শ্রদ্ধাজ্ঞাপন—এটা চললো। এই দৃশ্য দেখা আমাদের জন্য একটা অভুতপূর্ব ব্যাপার ছিল। আমাদের শহীদ মিনার বা শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ ও তাদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন এই ধরনের রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। আর এটা রাজনৈতিক আনুষ্ঠানিকতার চেয়ে বেশী ছিল অন্তরের আবেগ।  যাঁরা আমাদের ভাষার জন্য প্রাণ দিয়েছে এবং যেখানে প্রথম বাঙালির রক্ত পড়েছে—ঠিক সেইখানে শহীদ মিনারটা তোলা হয়েছিল। এখন শহীদ মিনারটা যেখানে তার একটু পাশে।

বেবী মওদুদ: এরপর তো স্যার শহীদ মিনার বার বার তারা ভেঙ্গেছে?

রফিকুল ইসলাম: ঐ ২৬ তারিখ রাতে আর্মি পাঠিয়ে শহীদ মিনার গুঁড়ো করে দিয়ে শহীদ মিনারের ইট-বালি-সুরকি, সমস্ত কিছু উঠিয়ে ট্রাকে করে নিয়ে চলে যায়। তখন আমরা কি করলাম একটা কালো কাপড় দিয়ে জায়গাটা ঘেরাও করলাম। একটা জিনিস ওরা নেয় নি বা ওদের চোখে পড়ে নাই। সেটা হলো মেডিকেল কলেজের ব্যারাকের (সেই ব্যারাকগুলো এখন নাই) বেড়ার মধ্যে একটা পোস্টার ছিল, তাতে শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা ছিল 'বীরের এ রক্তস্রোত, মাতার এ অশ্রুধারা, এর যত মূল্য সে কি ধরার ধূলায় হবে হারা?'। ঐ টার নিচে আমরা কালো কাপড় দিয়ে ঘিরে একটা প্রতীকী শহীদ মিনার তৈরী করলাম। তুমি বিশ্বাস করো যে আমাদের ৫৩, ৫৪, ৫৫, ৫৬ এই চার বছর অর্থাৎ এই শহীদ মিনার তৈরী না হওয়া পর্যন্ত ঐটাই আমাদের শহীদ মিনার ছিল এবং ঐ শহীদ মিনার ভাঙ্গার পর আলাউদ্দিন আল আজাদ কবিতা লিখলেন–'স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার …….'।

বেবী মওদুদ: ঐ সময়, মানে '৫৩ থেকে তো আপনারা এইখানে মিছিল করে শহীদদের মাজার—বরকতের—জিয়ারত করতেন?


একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩: পুরান ঢাকা কলেজ প্রাঙ্গনে ইডেন কলেজের বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীদের স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ
ছবি: রফিকুল ইসলাম

রফিকুল ইসলাম: '৫৩ থেকে আমার শহীদদের মাজারে গিয়ে ছবি তোলা আছে। তখন কবর বাধাই হয় নাই। কবরে গিয়ে ফুল দেয়া, কালো ব্যাচ পরে খালি পায়ে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে কালো পতাকা উত্তোলন করা, সমস্ত ভবনে কালো পতাকা উত্তোলন করা এবং সন্ধ্যায় অনুষ্ঠান করা হতো। '৫৩সালে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা আর ইডেন কলেজের ছাত্রীরা পুরানো ঢাকা কলেজের প্রাঙ্গণে এক শহীদ মিনার বানালো। আর সেটা ঢাকা কলেজের প্রিন্সিপাল শামসুজ্জামান চৌধুরী এবং ইডেন কলেজের প্রিন্সিপাল মিসেস ফজিলাতুনেসা দোহা আর ঢাকা কলেজের অধ্যাপক আহাসান আহমেদ আসক পুলিশ নিয়ে এসে ভেঙ্গে দিল। সন্ধ্যায় ব্রিটেনিয়া সিনেমা হলে ঢাকা কলেজের ছেলেরা শহীদ দিবসের প্রথম সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করলো, আতিকুল ইসলামের নেতৃত্বে। আতিকুল আমার প্রয়াত ভাই, রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী ছিল। সেখানে প্রথম আবদুল লতিফের সুরে আবদুল লতিফের নেতৃত্বে আবদুল গাফফার চৌধুরী'র লেখা 'আমার ভাইয়ের রক্ত রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি' গানটা তাঁরা গাইলো। ফলে ওরা দশজন বহিষ্কার হয়ে গেলে কলেজ থেকে। আর আমার ভাইতো চলে গেল, সাত দিনের ভিতরে  দেশ ছেড়ে চলে গেল। তা না হলে গ্রেপ্তার হয়ে যেত। যাই হোক আসাদুল আমিন তো মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেললো। ওকেও  বর্ডার পার করে দেওয়া হলো। কোলকাতায় কয়েক বছর চিকিৎসার পর সুস্থ হয়ে দেশে এসেছে। মানে এমন একটা পরিস্থিতি ছিল।

শান্তিনগরে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একটা সভা ওরা করার চেষ্টা করেছিল মার্চের প্রথম দিকে। কি করে পুলিশ খবর পেয়ে ওদের সবাইকে ধরে নিয় গেল। আর নারায়ণগঞ্জে একটা ঘটনা ঘটেছিল সেটা উল্লেখ করতে হয়। নারায়ণগঞ্জ মর্গান স্কুলের হেডমিস্ট্রেস ছিলেন মমতাজ বেগম। তিনি ভাষা আন্দোলনের কর্মী ছিলেন। তাকে পুলিশ যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে, তখন চাষাড়া রেলগেটে গাছ ফেলে জনতা বাধা দেয় এবং সেখানে সারা দিন জনতা আর পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ চলে। মমতাজ বেগম'কে ওরা দেড় বছর জেলে আটকে রেখেছিল। নুরুল আমিন আর একটা শয়তানি করেছিল, নারায়ণগঞ্জে নিজেরা গুলি চালিয়ে এক পুলিশকে মেরে, একটা আনসারকে আহত করে সেটার দোষ ভাষা আন্দোলনকারীদের উপরে দিয়ে ওদের ঢাকায় এনে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করে। ওদের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেয়। নারায়ণগঞ্জে নাকি ভারতের পক্ষে  স্লোগান দেয় এবং এরা  ভারতের অনুচর এটা প্রমাণ করার জন্য একটা পুলিশকে ওরা মেরে ফেললো। নারায়ণগঞ্জের এই দু'টি ঘটনা—মমতাজ বেগমকে গ্রেফতার নিয়ে যে প্রতিবাদ আর পুলিশ হত্যা এটা বলতেই হবে।

বেবী মওদুদ: ওরা দেখাতে চেয়েছে ভারতীয়রা এসে এটা করেছে?

রফিকুল ইসলাম: হ্যাঁ

বেবী মওদুদ: এটা তো স্যার ওদের প্রেসনোটেও ছিল?

রফিকুল ইসলাম: প্রেসনোটে ছিল। তারপর তোমার মর্নিং নিউজেও তো একথাই লিখছিল যে কোলকাতা থেকে মেয়েরা এসে এখানে এসব করেছে। সব মিথ্যা প্রচারণা। এটা যে একটা স্বত:স্ফূর্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন এবং আমরা যারা এই আন্দোলনে তখন ছিলাম, আমরা ফার্স্ট ইয়ারে পড়ছি। তখন কোন ছাত্র প্রতিষ্ঠান ছিল না। ছিল শুধু সংস্কৃতি সংসদ। প্রথম ভাষা আন্দোলনের পরে ছাত্রলীগ গঠিত হয়। দ্বিতীয় ভাষা আন্দোলন, '৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর ছাত্র ইউনিয়ন হয়। সংস্কৃতি সংসদে আমরা মূলত গণনাট্যগণসংগীত করতাম। কিন্তু বাংলা ভাষার আন্দোলনটা ছাত্র সমাজের একটা স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন ছিল। বললাম না যে যখন গুলি চললো, তারপরে নেতৃত্ব দিল মুসলিম হলের অ্যাথলেটিক ক্লাবের সদস্য, মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা।

বেবী আপা: মূল ছাত্ররা তখন আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে?

রফিকুল ইসলাম: হ্যাঁ নেতারা তো আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গেছে। কেউ পালিয়ে গেছে। তবে ভাষা আন্দোলনটা চলেছে কিন্তু '৫২এর গুলি চলার পর থেকে। আগে তো ১১ মার্চে রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়েছে। ১৯৫২ থেকে শুরু করে  '৫৩, '৫৪, '৫৫ পর্যন্ত  ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আমাদের রাষ্ট্রভাষা দিবস রূপে পালন হলো । ২১শে ফেব্রুয়ারি যে একটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ লাভ করলো এটা কিন্তু ঐ '৫৩সাল থেকে। কালো পতাকা উত্তোলন, কালো ব্যাচ পরা, মিছিল করা, খালি পায়ে শোভাযাত্রা করে গিয়ে ফুল দেওয়া, শহীদ মিনার তৈরী করা; কত শহীদ মিনার যে দেশে তৈরী হয়েছে!

বেবী মওদুদ: এখনও স্যার আমি দেখি ঢাকা শহরের অলিগলিতে এরকম ইট ও কঞ্চি দিয়ে শহীদ মিনার বানায়, ফুল দেয়।

রফিকুল ইসলাম: এবং শহীদ মিনারের ব্যাপারটা এখন এমন হয়ে গেছে যে এটা এখন মূর্ত না, বিমূর্ত হয়ে গেছে। যে বিদেশে যাচ্ছে…, লন্ডনে গিয়েও একটা শহীদ মিনার করছে।

বেবী মওদুদ: জাপানেও হয়েছে।

রফিকুল ইসলাম: জাপানে হয়েছে, সিডনিতে হয়েছে—পৃথিবীর কত দেশে হয়েছে।

বেবী মওদুদ: যেখানেই বাঙালি আছে সেখানেই হয়েছে এবং সেখানেই এই দিবসটা পালিত হচ্ছে।

রফিকুল ইসলাম: শিলচরে যে বাংলা ভাষা আন্দোলন হয়েছে তাতে ১৯৬১সালে মারা গেছে মহিলাসহ এগারো জন। করিমগঞ্জে বাংলা ভাষা আন্দোলন হয়েছে ১৯৭২ সালে। সেখানেও মারা গেছে তিন চার জন। তারপরে আবার হয়েছে '৮৬ না '৮৭ সালে ভারতের আসাম অঞ্চলে। এই যে বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তারা উদ্বুদ্ধ হয়ে যে আন্দোলন করছে তার ফলে ওখানে বাংলা ভাষার অস্তিত্ত্ব রক্ষা পেয়েছে। এটা কিন্তু অনেকেই জানে না।

বেবী মওদুদ: স্যার, '৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকার এসে তারপরে…

রফিকুল ইসলাম: ১৯৫৫ সালে কিন্তু আবার বাধা দিয়েছিল ২১শে ফেব্রুয়ারি পালনে। তখন যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে গেছে।

বেবী মওদুদ: যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা যখন ছিল তখন কি তারা কিছু করতে পারে নি।

রফিকুল ইসলাম: এর মধ্যে আমরা একটা সাহিত্য সম্মেলন করেছিলাম '৫৪সালে।  শহীদ দিবসটা ঘোষিত হয়েছে। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীসভা ভেঙ্গে দিল। তারপর যখন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলো, ওরা যখন যুক্তফ্রন্টের সৈনিক ছিল তখনই শহীদ মিনারের ভিত্তি প্রস্থর স্থাপিত হয়। ১৯৫৫ বাংলা একাডেমির অর্ডিন্যান্স জারি হয়। কিন্তু ১৯৫৭ সালে যখন আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে তখন কিন্তু শহীদ মিনার তৈরী শেষ করতে পারে নি, হামিদুর রহমান সাহেবের নকশা অনুসারে এই '৫৭ বা '৫৮ সালে। কিন্তু আইউব খান ক্ষমতায় এসে এদের বের করে দেয়। শহীদ মিনার অসম্পূর্ণ থেকে যায়। কিন্তু হামিদুর রহমানের অরিজিনাল নকশাটি কোনও দিনই হয় নাই। '৬৩ সালে যখন শিক্ষা দিবস নিয়ে শিক্ষা আন্দোলন শুরু হয়, তখন ছাত্রদের শান্ত করার জন্য এই শহীদ মিনারের কাজটা শেষ হয়। ১৯৬৩ সাল থেকে আমরা এই শহীদ মিনারে পালন করেছি। ১৯৬৯-এর গণ আন্দোলনের সময় এই শহীদ মিনার আবার মনে হয় যেন নতুন করে জাগ্রত হলো। কোন একটা লাশ পড়লে এখানে নিয়ে আসা হতো। সেখানে গায়েবী জানাজা হতো, তারপরে আজিমপুর গোরস্থানে নিয়ে যাওয়া হতো। '৬৯-এ যাঁরা…,আসাদ যখন গুলি খায় তাঁকেও এখানে আনা হয়েছে। মানে এটা একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে গেল যে শহীদ হলেই তাঁকে এখানে আনা হতো। যে কোন আন্দোলন, যে কোন সংগ্রামের একটা প্রতীক হয়ে গেল এবং বঙ্গবন্ধু আগরতলা থেকে বেরিয়ে এলেন, আমার মনে আছে ২২ ফেব্রুয়ারি  উনি ছাড়া পেলেন। শহীদ মিনারে আসলেন রাতে। তার পরে '৭০-এর নির্বাচনের আগে যে ২১শে ফেব্রুয়ারিটা হল মশালের আলোতে। বঙ্গবন্ধু একটা মশাল শোভাযাত্রা করেছিলেন। সেই মশালের শোভাযাত্রায় বঙ্গবন্ধু যে শফথ নিলেন যে বাংলার মানুষের সঙ্গে কোন দিন আমরা বিশ্বাসঘাতকতা করবো না । কাজেই এই শহীদ মিনার কতখানি গুরুত্বপূর্ণ, এর প্রতীকী যে ব্যঞ্জনা—এটা শহীদ মিনার থাকুক বা না থাকুক আমাদের কাছে বিশাল আবেগময়। যেমন '৭২সালে শহীদ মিনার ছিল না।


২১ ফেব্রুয়ারি ১৯৫৩: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের প্রভাতফেরি
ছবি: রফিকুল ইসলাম

বেবী মওদুদ: তখন তো আমরা ভাঙ্গা শহীদ মিনারেই গিয়েছি।

রফিকুল ইসলাম: আবার '৭৩সালে তৈরী হলো… কাজেই শহীদ মিনারটা এমন একটা অদ্ভুত ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। সবাইকে এখানে আসতেই হয়।

বেবী মওদুদ: এটা আমার মনে হয় স্যার, আজকের প্রজন্মকেও এটা জানতে হবে।

রফিকুল ইসলাম: হ্যা প্রত্যেক বছর যে ২১শে ফ্রেব্রুয়ারিতে বাবা-মা ছেলে-মেয়েদের হাত ধরে নিয়ে যায়,  একটা ফুল দেয়। এটা তো ওদের মধ্যে একটা মন্ত্রের মতো কাজ করে বাকি জীবন। নইলে কোথায় রফিক আর কোথায় সালাম, কানাডায় বসে প্রস্তাব করছে জাতিসংঘের কাছে যে ২১শে ফ্রেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস রূপে ঘোষণা দেওয়া হোক। এটা কি করে বলে তারা!

বেবী মওদুদ: তারা তো না বললেও পারতো…!

রফিকুল ইসলাম: তারা তো এই দেশ ছেড়ে চলে গেছে কানাডায়। কিন্তু তাদের অন্তরে রয়ে গেছে। অন্তরে তাদের একুশ আছে, অন্তরে তাদের একাত্তর আছে। আর ২১ থেকে '৭১ তো একটা রক্তাক্ত ধন তাই না।  আমাদের '৫২, '৬২র শিক্ষা, '৬৬র স্বাধিকার, '৬৯ গণ অভ্যুথান, '৭০ নির্বাচন, '৭১অসহযোগ ও মুক্তিযুদ্ধ, এই যে এত ধারাবাহিকতা  এত দ্রুত ঘটনাগুলো ঘটে গেছে এবং ক্রমশ এটা উত্তরোত্তর এত বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়েছে । সমস্ত দেশ এমনভাবে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সম্পৃক্ত হয়েছে  এবং ২৫শে মার্চ কালো রাত্রিতে পাকিস্তানি সশস্ত্র গণহত্যা শুরু করার পর সমস্ত দেশ  যেভাবে একাত্ম হয়েছে—বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে কোথাও এই ধরনের ঘটনা নেই। আমরা হাজার বছর ধরে বহিরাগতদের দ্বারা  শাসিত হয়েছি, শোষিত হয়েছি, নির্যাতিত হয়েছি, জাতিগত নিপীড়নের শিকার হয়েছি এবং দরিদ্র থেকে দরিদ্রতর হয়েছি এবং বিদেশি ভাষা দ্বারাও আমরা শাসিত হয়েছি। কিন্তু আমরা ফিরে দাঁড়িয়েছি '৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে। তারপরে আর আমরা পেছনে তাকাই নাই। যতক্ষণ পর্যন্ত না এদেশ স্বাধীন হয়েছে। যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংবিধানে তৃতীয় অনুচ্ছেদে এই বাক্যটি সম্পৃক্ত না হয়েছে যে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। খুব সংক্ষিপ্ত কিন্তু অত্যন্ত স্পষ্ট, এর মধ্যে কোন রকম অস্বচ্ছতা নেই।

বেবী মওদুদ: আজকে তো আমরা ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি নিয়ে আলাপ করলাম। সব শেষে আপনার কাছে আমার একটা প্রশ্ন থাকবে যে—সেই ভাষা আন্দোলনের পর আমরা দেশ স্বাধীন করলাম, তারপর এই যে মাতৃভাষা আন্দোলন যেভাবে হয়েছে, সরকারি বেসরকারী কাজকর্মে এবং আমাদের জীবনের সর্বত্র যে বাংলা ভাষার ব্যবহার কি হয়েছে…?

রফিকুল ইসলাম: না, সেটা হয় নি। যেমন, একটা উদাহরণ দেই। সংবিধানের অবিভাবক কে ? উচ্চতর আদালত, সংবিধানে আছে প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। আমরাতো আশা করবো আমাদের উচ্চতর আদালত এটা কার্যকর করার জন্য কিছু একটা ব্যবস্থা নিবেন।

বেবী মওদুদ: এখন স্যার ব্যাংকের সমস্ত কাজ করার জন্য কম্পিউটার ……

রফিকুল ইসলাম: ব্যাংক ছাড়াও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো ধরো; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বাংলা ভাষা যে পড়ানো হয়—আঞ্চলিক বাংলা। তারপর এই যে বেসরকারী ইংরাজি মাধ্যম স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় আছে, এখন আমার বিশ্ববিদ্যালয় বাংলা বাধ্যতামূলক করেছি। অধিকাংশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার কোন প্রবেশাধিকারই নেই।

বেবী মওদুদ: বাংলা বিষয় রাখতে হবে।

রফিকুল ইসলাম: অধিকাংশতেই নাই। বাংলা বিষয় থাকলে কয়জন ছেলেমেয়ে পড়তে যাবে। যেসব কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাধ্যম ইংরাজী তাদের জন্য তো বাংলা ভাষাটা বাধ্যতামূলক করা উচিত। এখানে চার লেভেলে পরীক্ষা হয়। 'এ' লেভেলে ১০০ মার্ক বাংলা আছে। যেখানে নাই, সরকারের উচিত ব্রিটিশ কাউন্সিলকে বলা যে, তোমরা হয় এ লেভেলে ১০০ মার্ক বাংলা ঢোকাও—আগে কিন্তু এটা ছিল—ক্লাস নাইনে বাংলাদেশে আমরা এলাউ করবো না। সবচেয়ে ক্ষতিকর কাজ হচ্ছে যে ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে সিরিয়ালে যে ভাষা ব্যবহৃত হচ্ছে এগুলো প্রমিত বাংলাও নয়, কোন অঞ্চলের উপ-ভাষাও নয়। চট্টগ্রামের না, ঢাকার না, সিলেটের না—কোনো অঞ্চলের নয়। এটা একটা জগাখিচুড়ি করে বাংলা ভাষাটাকে বিকৃতির চরমে নিয়ে গেছে। আমাদের বাংলা ভাষা এমন একটা সুন্দর ভাষা এবং একটা পরিমার্জিত ভাষা সেটা অমার্জিত অশ্লীল ভাষায় রূপান্তর করার একটা চক্রান্ত ঐ পাকিস্তনি আমলে একবার হয়েছিল। এখন আবার হচ্ছে।

বেবী মওদুদ: স্যার আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে আমরা সেই সময়কার ইতিহাস—যেটা আমাদের তরুণ প্রজন্মের জানা উচিত এবং বার বার আমাদের সেই ইতিহাস জানতে হবে সেই ইতিহাস পড়তে হবে; আপনার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ যে, অনেক কিছু শুনলাম আপনার দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার কথা।

রফিকুল ইসলাম: তোমাকেও ধন্যবাদ যে, আমি কিছু কথা বলার সুযোগ পেয়েছি।