আমার বন্ধু শিব দেবনাথ মুম্বাই-এর ট্যাবলয়েড পত্রিকা মিড-ডে'র ক্রাইম রিপোর্টার। একসময়ের বরিশালের কালু এখন মিড-ডের ক্রাইম রিপোর্ট করে, আমরা বন্ধুরা মাঝেমধ্যে গর্ববোধ করি। কয়েকদিন আগে সে বললো, মুম্বাইয়ের বিভিন্ন ব্রোথেলে বাংলাদেশ থেকে পাচার হয়ে আসা নারীদের নিয়ে তার একটা রিপোর্টের কথা। অসহায় এসব মেয়েদের বিভিন্ন সময় স্থানীয় কিছু এনজিও পুলিশের সহায়তায় উদ্ধার করেছে। যেমন এ বছর এখন পর্যন্ত ১০৩ জন মেয়েকে তারা উদ্ধার করেছে।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন ছিলো তাদের কি দেশে পাঠানো হয়েছে? উত্তরে সে যা বললো তা নিতান্তই পীড়াদায়ক। নানা আইনী জটিলতায় বেশীরভাগ মেয়েদের ফেরা হয় না।
শিব ওর রিপোর্টে একটা মেয়ের কথা বলেছে। যে মেয়েটি তার দূরসর্ম্পকের এক আত্মীয়ের প্ররোচনায় মুম্বাই আসে। তাকে বলা হয় চাকুরী দেয়া হবে। কিন্তু মুম্বাইতে এনে তাকে স্রেফ একটা পতিতালয়ে বিক্রি করে দেয়। সৌভাগ্যবশত তাকে উদ্ধার করে কান্ডভালি রেসকিউ ফাউন্ডেশনে আশ্রয় দেওয়া হয়। তারপরে দুই বছর পেড়িয়ে গেছে, দাপ্তরিক জটিলতায় সে একপ্রকার আশা হারিয়ে ফেলেছে এবং এখন আর সে ফিরতে চায় না।
বাংলাদেশী যেসব মেয়েদের উদ্ধার করা হয় তাদের বেশীরভাগই অল্পবয়স্ক এবং আনা হয়েছে চাকুরী ও বিবাহের লোভ দেখিয়ে। উক্ত এনজিওর প্রেসিডেন্ট ত্রিবেনী আচারিয়া বলেন, কিছু বর্ডার গার্ডদের ঘুস দিয়েও কিছু কিছু মেয়েকে পাচার করা হয়েছে। পাচারকারীরা বাংলাদেশের দরিদ্র পরিবারের মেয়েদের রঙিন স্বপ্নের আশা দেখিয়ে মগজ ধোলাই করে। এমনকি সিনেমার নায়িকা বানাবারও প্রতিশ্রুতি দেয় কেউ কেউ। বান্ধুপ এর কামাথিপুরা এবং সোনাপুর এর মত জায়গায় যেসব ব্রোথেল আছে সেখানে এসব মেয়েদের এনে দশ থেকে বিশ হাজার রুপিতে বিক্রি করা হয়।
মুম্বাইয়ের ব্রোথেলগুলোতে নিয়মতি নজরদারি করে এমন একটা সংস্থা 'রেসকিউ ফাউন্ডেশন'। তারা জানায় বাংলাদেশে ফেরত পাঠানোর পদ্ধতি এত জটিল যে একশটা মেয়ের মধ্যে বছরে মাত্র দশটা মেয়ে দেশে ফিরতে সক্ষম হয়। এনজিও সদস্যরা জানান উদ্ধারকৃত মেয়েদের তালিকা তৈরী করে কেসস্টাডি লিপিবদ্ধ করেন যা ভারতের নারী ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদেন পেলে এগুলো বাংলাদেশের নিদৃষ্ট কিছু এনজিওর কাছে পাঠানো হয় যারা এসব মেয়েদের পরিচয় শনাক্ত করার জন্য তাদের বাড়ীঘরের ঠিকানা যাচাই বাছাই করে। অতপর বাংলাদেশী এনজিও দিল্লীতে বাংলাদেশ হাই কমিশনে রিপোর্ট প্রেরণ করে। হাইকমিশন অনুমোদন দিলে মুম্বাইয়ের এনজিওটি তাদের দেশে পাঠাতে আপত্তি নাই এই মর্মে তথ্য মন্ত্রণালয় থেকে নো অবজেকশন সার্টিফিকেট (এনওসি) সংগ্রহ করে।
উদ্ধারকৃত মেয়েদের কারিগরী শিক্ষা দিচ্ছে একটি এনজিও
সমস্যা হলো বাংলাদেশ হাইকমিশন এবং বাংলাদেশে অবস্থিত এনজিওর মধ্যে যোগাযোগের ব্যবস্থা এত দীর্ঘসূত্রী যে মাসের পর মাস লেগে যায়। মেয়েরা বাড়ী ফিরতে মাসের পর মাস অপেক্ষার প্রহর গুনতে থাকে কিন্তু সরকারের কাছ থেকে কোনো এনওসি মেলে না। কিছু কিছু ক্ষেত্রে উদ্ধারকৃত মেয়েরা অবৈধ ব্রোথেল ও এর দালালদের বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলার অন্যতম সাক্ষি হাওয়ায় পুলিশ তাদের কোর্টে উপস্থাপন করার পূর্ব পর্যন্ত আটকে রাখে। সংশ্লিষ্ট একটা এনজিওর আইন বিষয়ক পরামর্শক কবিতা সাক্সেনা বলেছেন 'কখনও মেয়েরা সরকারের নিকট থেকে দেশে ফেরার সার্টিফিকেট পেয়ে গেলেও পুলিশ তাদের যেতে দেয় না। আর যদি আমরা এনওসি ছাড়া বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেই তাহলে শোকজ নোটিশ খেতে হয়। আবার বাংলাদেশের এনজিও যখন এসব মেয়েদের পরিচয় উদঘাটন করতে ব্যর্থ হয়, এসব মেয়েদের ফেরা পিছিয়ে যায়। কিছু মেয়ে আছে যারা তাদের আসল পরিচয় ও বাড়িঘরের ঠিকানা দেয় না। যদি কোনো মেয়ে মিথ্যা পরিচয় দেয় এবং বাংলাদেশের এনজিও যদি তাদের ঠিকানা খুজে না পায়, মুম্বাই ভিত্তিক এনজিওটির পুরো প্রক্রিয়া নতুন করে শুরু করতে হয়। দীর্ঘদিন অপেক্ষার ফলে মেয়েরা ক্রমশ নিরাশ হয়ে পড়ে এবং দেশে আর ফিরতে চায় না। ফলে সেসমস্ত মেয়েদের কেউ একউ মুম্বাইতে পুনর্বাসিত হয় এবং চাকুরীও পেয়ে থাকে।