মেধামূল্যহীন দেশের কোটা চাই

মওদুদ রহমান
Published : 14 May 2012, 11:18 AM
Updated : 14 May 2012, 11:18 AM

সাবেক উপদেষ্টা বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ড. আকবর আলি খান এবং সাবেক সচিব কাজী রকিবুদ্দিন আহমাদ ২০০৮ সালের মার্চ মাসে ''কোটা সিস্টেম ফর সিভিল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট : এন এক্সপ্লোরেটার'' শীর্ষক একটি গবেষণাকর্ম সম্পাদন করেন। ওই গবেষণায় বলা হয়েছে, মেধার ভিত্তিতে মাত্র শতকরা ৪৫ জনকে নিয়োগ সংবিধানসম্মত নয় এবং ব্যতিক্রমী নিয়োগ (শতকরা ৫৫ ভাগ) কখনও সাধারণ নিয়োগের (শতকরা ৪৫ লাভ) চেয়ে বেশি হতে পারে না।

গবেষণাপত্রটির অংশটুকু এখানে উল্লেখ করাতে কি আমি স্বাধীনতা বিরোধী হয়ে গেলাম?
এই সত্যটি তুলে ধরাতে কি আমি রাজাকার হয়ে গেলাম?

হতেই পারি। কেননা এমন একটা দেশে আমি বাস করি যেখানে, 'আমি আওয়ামীলীগ না'- বললেই বুঝায় আমি যুদ্ধাপরাধী। আর 'আমি বিএনপি না'- বললেই বুঝায় আমি বাকশালী।

ব্যক্তিসত্তা হিসেবে এটা আমার দুর্ভাগ্য, সামাজিক সত্তা হিসেবে কলংকজনক আর জাতিগত সত্তা হিসেবে ভয়ংকর।

এদেশে মেধার চর্চা হয় না, কিন্তু মেধার রাজনীতি হয়। মেধার উতকর্ষ সাধনে উতসাহ না দিলেও কোটা নামক 'ক্ষেত্র বিশেষে অনৈতিক' সিড়ি বেয়ে অযোগ্যরা যোগ্যদের ডিংগিয়ে যায়।

তবে কি আমি কোটা বিরোধী? তবে কি আমি মুক্তিযোদ্ধাদের ছাড় দিতে সংকোচ বোধ করছি?
অবশ্যই না।

মুক্তিযোদ্ধারা দেশের সূর্যসন্তান। তাদের অতুলনীয় ত্যাগ আর অপরিসীম সাহসিকতার কারণেই আজ আমরা স্বাধীন দেশে বাস করছি। কোটা বা সকল ক্ষেত্রে বিশেষ সুবিধা তারা অবশ্যই পাবেন। আর এই কোটা ব্যবস্থায় যুদ্ধ পরবতী বাংলাদেশে সরকারী বা আধা সরকারী প্রতিষ্ঠান, পুলিশ, সেনা-বাহিনী সহ রাজনৈতিক ও সামাজিক ক্ষেত্রে তারা প্রতিষ্ঠা পেয়েছেন। কিন্তু তাদের সন্তানরা কেন যোগ্যতার পরীক্ষায় নামার আগে কোটা নামক বিশেষ বর্মটি পড়ে নেন- তা অজানা।

বিসিএস পরীক্ষা বাংলাদেশে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা। এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণরাই দেশ পরিচালনায় সবচেয়ে গূরুত্বপূর্ণ পদে আসীন হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নির্বাচিত প্রতিটি সরকার এদের দিয়েই দেশ পরিচালনা করেন। কিন্তু ভাবতেই অবাক লাগে, বর্তমানে এখানে ৫৫% কোটা। সরকারের অদক্ষতার অন্যতম কারণ হচ্ছে এই কোটা বা সংরক্ষিত আসন। প্রতি বছর এই ৫৫% আসনের অধিকাংশ পূরণ হয় কোটি কোটি টাকা ঘুষ লেনদেন নতুবা ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা সার্টিফিকেট বেচাকেনার মাধ্যমে।

কোন মহল থেকে এর প্রতিবাদ জানানো হয় না। কেননা আপনি মুক্তিযোদ্ধা সন্তানের কোটা বাতিলের কথা বললে একটি প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রী মহল আপনাকে বলবে রাজাকার। আপনি মহিলা কোটার বিরুদ্ধে কথা বললে আপনাকে বলবে নারী-বিদ্বেষী। আপনি উপজাতি কোটার বিরুদ্ধে কথা বললে আপনাকে বলবে বর্ণবাদী।

কিন্তু এসব সুবিধাভোগী মন্দলোকেরা কখনো প্রতিটি স্কুল-কলেজে-বিশ্ববিদ্যালয়ে মুক্তিযোদ্ধা সন্তানদের পর্যাপ্ত আসন সংরক্ষণের জন্য কোন আন্দোলন করেননি। যদি করত তবে 'কোটা' নামক বিশেষ ব্যবস্থায় চাকরীর বাজারে প্রকৃত যোগ্যদের তাদের সাথে টেক্কা দিতে হতো না। বরং মুক্তিযোদ্ধার সন্তানেরা যোগ্যতম হিসেবেই গড়ে উঠত।

গত প্রায় ২০ বছর ধরে রাষ্ট্রীয় সর্বোচ্চ আসনে নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত হয়ে থাকার পরও নারীশিক্ষার প্রসার ঘটছে না। বাল্য বিবাহ, বহু বিবাহ, যৌতুকপ্রথা সমাজ থেকে দূর করতে না পারার ব্যর্থতা ঢাকার চেষ্টা করা হয় মহিলা কোটার মাধ্যমে।

এই সংরক্ষিত আসনে অনিয়ম আর দূর্নীতির সুযোগ নিয়ে নিয়োগ পাওয়া অযোগ্যদের নিয়ে প্রসাশন চলছে বলেই দেশের পররাষ্ট্রনীতি, স্বরাষ্ট্রনীতি আর অর্থনীতির এই বেহাল অবস্থা। এই দুর্বল কাঠামোর কারণেই টেংরাটিলা দূর্ঘটনার ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া যায় না। যমুনা সেতুর ফাটলের দায়ে বিদেশী কোম্পানীকে অভিযুক্ত করা যায় না। গংগা'র পানির ন্যায্য হিস্যা পাওয়া যায় না। সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয় না। বঙ্গোপসাগরের প্রকৃত সীমানা অধিকারটুকু পাওয়া যায় না।

সমাজের পিছিয়ে পড়া অনগ্রসর কোন শ্রেণীকে মূল স্রোতে নিয়ে আসার জন্য 'কোটা'র মাধ্যমে সাময়িক প্রণোদনা দেয়া যেতে পারে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ ব্যবস্থা রয়েছে। সুবিধা পাওয়া সেই বিশেষ শ্রেণীর সক্ষমতা অর্জনের সাথে সাথে এই সুবিধা কমিয়ে আনা হয় এবং ধীরে ধীরে তা বিলুপ্ত হয়ে যায়। কিন্তু এদেশে এটি একটি চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত হয়ে গেছে। সন্তানাদির পর তা নাতি-নাতনীদের দিকে ধাবিত হবার উপক্রম হয়েছে।

সংবিধানের ২৯(৩) অনুচ্ছেদ নাগরিকদের 'অনগ্রসর অংশের' জন্য চাকরিতে বিশেষ কোটা প্রদান অনুমোদন করেছে। কিন্তু সংবিধান 'অনগ্রসর অঞ্চলের' জন্য কোনো কোটাকে অনুমোদন করে না। কিন্তু বিসিএস ক্যাডার সার্ভিসসহ প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর নন-ক্যাডার চাকরিতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য ৩০ শতাংশ কোটা রেখে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর এখনও যদি বলা হয় মুক্তিযোদ্ধারা সমাজের 'অনগ্রসর অংশ' তবে জাতি হিসেবে এরচেয়ে দীনতার পরিচায়ক আর কিছুই হতে পারে না। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গত ২০ বছর ধরে নারী প্রধানমন্ত্রী পেয়েও যদি সকল ক্ষেত্রে নারীর অধীকার নিশ্চিত না করার দোহাই দিয়ে ১০ শতাংশ মহিলা কোটা থাকে তবে বলতে হয়, অকমর্ণ্য জাতি হিসেবে আমাদের জূড়ি পৃথিবীতে খুজে পাওয়া অসম্ভব। তাই প্রশ্ন জাগে,

তবে কি স্বাধীনতার পরবর্তী সময়ের সরকারগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের মূল্যায়নে ব্যর্থ হয়েছে?

কেউ কি তাদের সন্তানদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে না দিয়ে ঘরে আটকে রেখেছে?

আমাদের দু' নেত্রী নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে কি শুধুই লোক দেখানো কথা বলেন?

উপজাতিদের ভাগ্য উন্নয়নের কথা বলে ৫ শতাংশ কোটার আড়ালে প্রকৃত সমস্যা জিইয়ে রেখে কি সরকার কোন দুরভীসন্ধীতে লিপ্ত?

যদি তাই হয় তবে বিগত এই ব্যর্থতা আর চক্রান্তগুলোর বিচার হোক। আর ভবিষ্যতে সীমিত সময়ের জন্য সত্যিকারের ''অনগ্রসর অংশের'' জন্য যৌক্তিকভাবে কোটা নির্ধারণ করে উপযুক্ত ব্যবস্থার মাধ্যমে সমতা বিধান করে ধীরে ধীরে কোটা ব্যবস্থা বিলুপ্ত করা হোক।

আর যদি নির্বাচনী ইশতেহারে নিত্য-নতুন কোটার পান্টাপাল্টি ঘোষণা দিয়ে ক্ষমতার দৌড়ে লিপ্ত থাকতেই হয় তবে তৃতীয় বিশ্বের গরীব রাষ্ট্র হিসেবে 'কোটা মার্কা' যুক্ত অভিনব সুবিধা পাবার জন্য বিশ্ব নেতাদের কাছে আবেদন করা হোক। সেই সুবিধা পেলে হয়তো আমরা ১০০ ডলার ব্যারেলের তেল ১০ ডলারে কিনতে পারব। কিংবা বিদেশ থেকে ফ্রীতে খাদ্য আমদানী করতে পারব।

আহহহহ! কোটা সুবিধার সেই অনাগত দিনগুলোর কথা ভাবতেই চোখ চকচক করছে।

কোটার স্বাদ বুঝি এমনি,,,,,,, শুধুই জীবে জল আনে।