মোহনীয় পার্কি সৈকত

রেজাউল মাসুদ
Published : 26 Dec 2014, 01:40 PM
Updated : 26 Dec 2014, 01:40 PM

টিকিটের জন্য সর্বত্র হাহাকার,চট্টগ্রাম থেকে আউটগোয়িং দূরপাল্লার বাস, রেল কিংবা বিমানের কোন গন্তব্যেরই টিকেট মিলছেনা কয়েকদিন যাবৎ।ইনকামিং যাত্রার ক্ষেত্রেও একই অবস্হা।গতকাল অডিট অফিসার ওয়াদুদ ভাইয়ের বড় বোন ঢাকায় যাবে কোথ্থাও কোন টিকেট না পেয়ে অগ্যতা আমার শরনাপন্ন হন,আমাদের রেফারেন্সে যদি একটা টিকেট ম্যানেজ করা যায় !চিটাগাং বিটিআই চীফ মাহমুদ ভাই বান্দরবান যাবে ফ্যামিলীসহ ,কোন হোটেল রিসোর্ট এমনকি গেস্ট হাউজেও সীট না পেয়ে পুলিশ নিয়ন্ত্রিত রিসোর্টে কোন ভাবে একদিনের জন্য রুম পাওয়া যায় কিনা বান্দরবানের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ব্যাচমেট অনির্বানকে অনুরোধ করলে ও জানায় কক্সবাজার রাঙামাটি খাগড়াছড়ি এমনকি আমাদের চিটাগাঙেও নাকি ডিসেম্বর একত্রিশ তারিখ পর্যন্ত হোটেলগুলোর সব রুম বুকিং হয়ে আছে।

ডিসেম্বরে বিদ্যালয়ের বার্ষিক পরীক্ষা শেষে পারিবার নিয়ে সবাই বেরিয়ে পড়ছে। এর সাথে যোগ হয়েছে ২০১৪ সালে বর্ষবিদায় ও ২০১৫ সালের বর্ষবরণ উদযাপন। বৃহস্পতিবার বড়দিনের ছুটি এবং পরবর্তী দুদিন সরকারি ছুটি মিলিয়ে তিনদিনের ছুটি কাটাতে সবাই ভ্রমণে যাচ্ছেন।তাছাড়া গত বছরের শুরু থেকে টানা অবরোধ-হরতাল আর রাজনৈতিক অস্থিরতার পর এ বছর বাঁধ ভাঙা জোয়ারের মত মানুষ ঘর থেকে ছুটে যাচ্ছে যে যার মত,এ সব কারণে পর্যটন মওসুম এখন জমজমাট আর বেশখানিকটা বিড়ম্বনাও বটে।

অনেকদিন পার্কি বীচে যাইনা, যাবে নাকি ও দিকটায়।পপির কথা শুনে লাবিবা তো লাফ দিয়ে উঠে,বড়দিনের ছুটির আবেশটা নগরীর কর্ণফুলী থানা এলাকার মনোরম সমুদ্র সৈকত পার্কিতে কাটালে তো ভালই হয়,যেই ভাবা সেই কাজ,সবকিছু গুছিয়ে পৌনে তিনটায় যাত্রা করি দামপাড়ার বাসা থেকে।

কর্ণফুলীর মোহনা পৃথিবীর সুন্দরতম মোহনার একটি । মোহনার ঠিক উত্তর পাশে হলো পতেঙ্গা সি বিচ আর দক্ষিণ পাশ হলো আনোয়ারা উপজেলার মধ্যস্থলে বঙ্গোপসাগরের উপকূল ঘেঁষে গড়ে উঠা "পার্কির চর" নামে খ্যাত দৃষ্টি নন্দন এই পার্কি বীচ।চট্টগ্রাম শহর থেকে এই বীচের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিঃমিঃ। যেতে সময় লাগে ১ ঘন্টা।

নগরের যান্ত্রিক কোলাহল গাড়ীর কালো ধোঁয়া যানযট এড়িয়ে কোতয়ালী হয়ে আমরা যেতে থাকি।পথে কর্ণফুলী নদীর উপর প্রমোদতরীর আদলে নির্মিত নতুন ঝুলন্ত ব্রীজের উপর গাড়ী পৌছতেই আমরা নেমে পড়ি,কর্ণফুলী ব্রীজে বহুবার এসেছি কিন্ত এত সুন্দর বিকালের মোহনীয় রূপের কর্ণফুলী ব্রীজ আগে তো এভাবে ভাবিনি,ব্রীজে নেমে কিছুক্ষন উপভোগ করি প্রাকৃতিক আর মনুষ্য সৃষ্টির অপার সৌন্দর্য।পথে কোরিয়ান ইপিজেডও দেখে যাওয়ার কথাও রয়েছে আমাদের,ওসি কর্ণফুলী সেমত সব ব্যবস্হা করে রাখে,বছর তিনেক আগে এসেছিলাম, ইপিজেড়ের ভিতরটা অনেক সুন্দর করে ফেলেছে ইয়াং ওয়ান গ্রুপ,পৃথিবীর সবচেয়ে বৃহৎ জুতার ফ্যাক্টরী হচ্ছে এখানে,পুরো ইপিজেড ঘুরে ব্যাম্বু হাউজে আমরা কিছুক্ষন রেস্ট নিয়ে চট্টগ্রাম সার কারখানা ও কাফকো দেখতে দেখতে পার্কী বীচের কাছাকাছি চলে আসি।

ঢুকার পথে সরু রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, সবুজ প্রান্তর আর অনেক মাছের ঘের দেখে মনটাই ভাল হয়ে যায়। বীচে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের মতোই অসংখ্য ঝাউ গাছের মনোমুগ্ধকর ঝাউবন রয়েছে।পার্কি সমুদ্র সৈকতটা শরীর-মন জুড়ানোর মতই বেশ চমৎকার, বালুচরে সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে ঝাউবন ও সাগরের জলকেলির মত মনমুগ্ধকর দৃশ্য যে কারোরই ভালো লাগবে।জানতে পারলাম ১৯৯১ সালের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের পর পার্কি এলাকার বেড়ি বাঁধ রক্ষার লক্ষ্যে স্থানীয় জনগণ এবং বন বিভাগ এখানে হাজার হাজার ঝাউগাছ রোপণ করে। ঝাউগাছগুলো ধীরে ধীরে বড় হয়ে উঠলে এলাকাটি আকর্ষণীয় হয়ে উঠে।

আমাদের গাড়ি একদম মূল বিচে চলে আসে।পার্কি বিচ যেন অবিকল কক্সবাজার সি বিচ, পার্থক্য শুধু এটুকুই এখানে বিভিন্ন দেশের নানা পতাকাবাহী সারি সারি জাহাজের অপেক্ষামান নোঙর করা অকৃত্রিম দৃশ্য রয়েছে যা কক্সবাজারে কখনোই দেখা যাবে ন্। এখানের ঢেউগুলো গ্রামের অবোঝ বালিকার মত শান্ত আর স্হির।দিগন্ত বিস্তৃত সমুদ্র সৈকত ধরে হেঁটে চলেছি আমরা, লাবিবার কি যে ছুটাছুটি নাগর দোলায় উঠবে,মজার খেলা রিং থ্রো খেলবে,ঘোড়ায় উঠবে,মটর সাইকেলে চড়বে,অনেকদিন পর ওর প্রাণ খোলা আনন্দ দেখে আমাদেরও বেশ লাগছে ।আমরা সম্মুখ পাণে হেটে যাচ্ছি শুধু, উপরে হাল্কা সাদা মেঘের লুকোচুরি খেলার ফাঁক দিয়ে সুবিশাল নীলাকাশ আর শীতের সূর্যের ঝলকানীর মিষ্টি আবেশ। এক পাশে সাগরের নীল ঘোলাটে জল তীরে এসে ফেনায়িত ঢেউ হয়ে আলতো করে ছুঁয়ে দিচ্ছে আমাদের পদ যুগল।একটু স্হিত হতে বসার জন্য বড় ছাতা সহ হেলানো ইজি চেয়ার ঠান্ডা বাতাসে দারুন আবেশে আমরা শরীর এলিয়ে দিই।সূর্য মামার সাগর গহ্বরে ঢুকে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছে ততক্ষনে, মনে হচ্ছিল এত সুন্দর অকৃত্রিম মনোরম দৃ্শ্য পৃথিবীতে বোধহয় দ্বিতীয়টি আর নেই।