রাষ্ট্রের-সরকারের-রাজনীতিবিদদের ধর্ম আর আপামরের ধর্ম

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 11 August 2012, 08:03 PM
Updated : 11 August 2012, 08:03 PM

***
হিন্দু (সম্ভবত) সহকর্মী তারুনাকে অফিস ম্যাসেঞ্জারে জানালাম, মেইল-ম্যাসেঞ্জার রিমোটলি এক্সেস করছি। আজ অফিস নেই। হলিডে। তারুনা জিগেষ করল, আজ কিসের হলিডে তোমাদের? কোন ফেস্টিভ্যাল? আমিও পাল্টা অবাক হয়ে বললাম, আজ না কৃষ্ণের জন্মদিন? আমাদের এখানে বলে জন্মাষ্টমী… তোমরা কী বল এই দিনটাকে? সহকর্মী এবার একটু অবাক আর আন্তরিক ভাবেই বলল, তোমাদের ওখানেও এটা পালন হয়, জানা ছিল না! তারুনার এই জবাবটা ইতিবাচক। আমি নিজের মধ্যে একটা অসাম্প্রদায়িক তৃপ্তি অনুভব করি! আমার ভাল লাগে নিজেকে এমন একটি রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে নিজকে ভেবে!

***
এতদিন কোরআন গ্রন্থের অনুবাদ/তেলাওয়াত নিয়ে অনেক ইংরেজি সফটওয়্যার/সাইট এর কথা শুনেছি। বাংলাও ছিল মনে হয়। এবার একেবারে আনুষ্ঠানিকভাবে বড়সর মিডিয়া কর্পোরেট হাউজের প্রচার সহযোগিতায় কোরআন তেলাওয়াত/তরজমা বিষয়ক সাইটের উদ্বোধন হল [লিংক] ধর্ম মন্ত্রাণালয় থেকে। চ্যানেলের রাতের খবরে দেখছিলাম। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধনী বক্তৃতায় তার ব্যক্তিগত ধর্মীয় অনুভূতি ব্যক্ত করেন। আশা প্রকাশ করেন, এই সাইটের মাধ্যমে আরো বেশি মানুষ এই ধর্মে আকৃষ্ট হবে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এও জানান, এই ধর্মেই জীবনাদর্শ সম্পূর্ণরূপে বর্ণিত আছে। যতদূর মনে হল, "আর কোন ধর্মে নেই" – এমন একটি কথা বলতে গিয়েও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেষ পর্যন্ত বলেন, "অন্য কোন ধর্মে আছে কিনা আমার জানা নেই"। আমরা কি তাহলে মুসলিম জনগোষ্ঠীতে উম্মত "সংখ্যা বাড়ানোর" লক্ষ্যে কাজ করছি, তাও আবার রাষ্ট্রিয়-সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায়? তাহলে কি বন্ধু-পরিচিতের তালিকায় যত হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান রয়েছে তাদের সরাসরি অথবা কৌশলে আমার ধর্মে আকৃষ্ট করাই আমার ব্রত হবে এই রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেবে?

***
ব্যরিস্টার নাজমূল হুদা নতুন দল গঠন নিয়ে এটিএন নিউজ চ্যানেলের এক সাক্ষাৎকারে নিজের মুসলমান হওয়াকে যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে বয়ান করছিলেন। ১৯৪৭ এর ধর্ম ভিত্তিক দেশ বিভাগের কথা জানালেন, যেটা ১৯৭১ এ এসে আর বলবৎ থাকেনি সেটাও বললেও। তারপর জানালেন, বাঙালিত্ব ও মুসলিমত্বকে সাম্যে আনতে হবে। অধিক মুসলিম হতে গিয়ে তিনি বাঙালিত্ব হারাতে চান না। অধিক বাঙালি হতে গিয়ে অমুসলিম হতে চান না! ব্যরিস্টার নাজমুল হুদার বক্তব্যের প্রথম অংশে ধর্মমতের প্রতি স্বাধীনতা রক্ষিত হয়েছে বলে মনে হলেও দ্বিতীয় পর্যায়ে এসে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের নিয়ে তার 'অমুসলিম' উচ্চারণ স্পষ্টত উন্নাসিকতার পর্যায়ে পরে।

***
রাষ্ট্র কিংবা সরকার ও রাজনীতিবিদদের ধর্ম সংক্রান্ত অনুভূতি প্রকাশের সময় লক্ষ্য রাখা উচিৎ সংখ্যা গরিষ্ঠ মুসলিমের দেশে অন্যান্য ধর্মাবলম্বীরাও বাস করে। এই জনগোষ্ঠী হোক না সংখ্যা গরিষ্ঠ ধর্মের তুলনায় অপ্রতুল, তবু তাদেরও দেশের কাজে বহুমাত্রিক ভূমিকা আছে। ভূমিকা ছিল। ভূমিকা ছিল আত্মত্যাগেও। রাষ্ট্রের ভুলে গেলে চলবে না ধর্মের কারণে পাক বাহিনীর হাতে কত রকমের নির্মমতার স্বীকার হতে হয়েছিল এইসব 'অমুসলিমদের'। রাজনীতিবিদেরা কী করে ভুলে যান, তাদের ভোটার তালিকায় তথাকথিত 'অমুসলিম' রাও আছে। এদের কাছেও ভোটভিক্ষা চাইতে হয়। রাষ্ট্রের ভুলে গেলে চলবে না আমাদের জাতীয় সংগীত রচয়িতা একজন 'অমুসলিম'!

ব্যক্তিগতভাবে রাষ্ট্র পরিচালনাকারীরা যে ধর্মেই বিশ্বাসী আর যে ধর্মেই অবিশ্বাসী হোন না কেন, রাষ্ট্র/সরকার কোন বিশেষ ধর্মের প্রতি কখনই পক্ষপাতিত্ব দেখাতে পারেন না কোন আনুষ্ঠানিক বক্তব্যে। রাষ্ট্র কোন একটি বিশেষ ধর্মের অনুসারী সংখ্যা বাড়াতে কোন ধরনের ঘোষনা ও পৃষ্ঠপোষকতাও করতে পারে না। বরং রাষ্ট্র তার সকল নাগরিককে এই নিশ্চয়তা দেবে তাদের প্রত্যেকের ধর্মের স্বাধীন ও নিরাপদ চর্চার। রাজনৈতিক নেতারা যখন বিশেষ কোন ধর্মকেই প্রাধান্য দেন, তখন 'সংখ্যালঘু' ধর্মগোষ্ঠির জন্য তা কতটা স্বস্তিদায়ক হতে পারে?

***
যেখানে সংখ্যা লঘু শব্দটির ব্যবহার নিয়েও আপত্তি ওঠে, সেখানে কথায় কথায় "অমুসলিম" শব্দটির ব্যবহার বিনা বাক্যব্যয়ে বর্জিত হওয়া ‍উচিৎ। এভাবে কারো ধর্মমতের উপর পরোক্ষভাবে চাপ সৃষ্টি করা হয়, প্রভাব বিস্তার করা হয়। কাউকে 'অমুসলিম' সম্বোধন করা তো সেই ব্যক্তির ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করার সামিল। অন্যথা "অ-হিন্দু", "অ-খ্রিষ্টান", "অ-বৌদ্ধ" শব্দের প্রচলন হওয়া উচিৎ। তাদেরও অধিকার রয়েছে মুসলিমদের এভাবে সম্বোধনের।

***
প্রয়োজনে আমাদের ধর্ম মন্ত্রনালয়ের ‍উচিৎ এমন একটি ধর্মীয় সাইট করা, যেখানে একই সাথে কোরআন-বাইবেল-ত্রিপিটক-গীতা ধর্মগ্রন্থগুলো থাকবে। বিটিভি যুগে বিকেলে অধিবেশন শুরুতে কোনদিন গীতা পাঠ ছিল, কোনদিন ত্রিপিটক, কোনদিন ছিল বাইবেল বাণী। কোরআন-নামায শিক্ষাও ছিল প্রতিদিন ও সাপ্তাহিকভাবে। মূল যে ধর্মীয় শিক্ষা ছিল তা হল, সকল ধর্মের একটি সাম্য উপস্থাপনের চেষ্টা, নিয়মিতভাবে। এখন বহু চ্যানেল হয়েছে, কিন্তু বিটিভির সেই চর্চায় যে অসাম্প্রদায়িক, ধর্মীয় সাম্যের শিক্ষা ছিল, তা আজকের চ্যানেলগুলোতে দৃশ্যত অদৃশ্য!

***
আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র ১০০% মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রসীমা গড়ার অঙ্গীকারাবদ্ধ নয়। এই রাষ্ট্রে আযানের ধ্বনি শোনা যাবে, মন্দিরে ঘণ্টাও শোনা যাবে, গির্জায় প্রার্থনাও হবে। এর ব্যতয় যেন না হয় – কথায় আর কাজে। আপামর নাগরিকের ধর্মীয় মতকে দায়িত্বের সাথে রক্ষা করতে হবে রাষ্ট্র-সরকার আর রাজনীতিবিদদেরই।