মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রে ইতিহাস বিকৃতি নয়

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 9 March 2014, 06:48 PM
Updated : 9 March 2014, 06:48 PM

অপর্ণা সেন পরিচালিত সিনেমা 'গয়নার বাক্স' বহুজনের কাছে দুর্দান্ত লাগলেও সিনেমার শেষাংশে যেরূপে মুক্তিযুদ্ধ উপস্থাপিত হয়েছে তা সবার কাছে বাঁধো বাঁধে ঠেকেছে। 'গয়নার বাক্স' কোনোভাবে উতরে গেলেও সাম্প্রতিককালে হিন্দি ছবি 'গুন্ডে' নিয়ে উঠেছে কড়া প্রতিবাদ। উঠেছে সিনেমাটির কিছু বিশেষ অংশ, যা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে ভুলভাবে চিত্রায়িত করেছে, তা পরিমার্জনার দাবি, অন্যথায় নির্মাতাদের ক্ষমা প্রার্থনাপূর্বক সিনেমাটি নিষিদ্ধের দাবি। 'গুন্ডে' সিনেমা নির্মাতার ব্যানার থেকে ফেসবুকে দুঃখ প্রকাশ করা হলেও সিনেমাটির বিভ্রান্তিকর অংশ পরিমার্জনা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো বক্তব্য আসেনি। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাঠানো হয়েছে। সুতরাং এখন আনুষ্ঠানিক জবাব প্রাপ্তি বাঞ্ছনীয়। প্রত্যুত্তর কবে পাওয়া যেতে পারে তা নির্ভর করে বর্তমান সরকারের তৎপরতার ওপর।

বিষয়টা এমন নয় যে, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় না থাকলে গণমাধ্যমে ১৯৭১ অনুচ্চারিত থেকেছে, তবে বঙ্গবন্ধু, জয়বাংলা আর 'মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি'_ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এই ত্রয়ী স্মারকচিহ্ন ১৯৭৫-পরবর্তীতে মহাফেজখানার অন্ধপ্রকোষ্ঠে নিক্ষিপ্ত ছিল। ১৯৭১কে নানা মোড়কে উপস্থাপনের রাজনৈতিক অপচেষ্টায় ইতিহাস বহু হাতে বিকৃত হয়েছে। '৭৫-পরবর্তী প্রজন্ম তৎকালীন সরকারি বাক্স বিটিভির নিয়ম রক্ষার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক নাটক আর অপরাপর অনুষ্ঠান থেকে জেনেছে 'হানাদার' বাহিনী এদেশ আক্রমণ করেছিল। প্রতি বছর গৎবাঁধা নাটকে খাকি পোশাকের হানাদার বাহিনী, তরুণ অথবা গৃহপুরুষকে ধরে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য, আর একটা ধর্ষণ দৃশ্য_ ছকে বাঁধা ফ্রেমে এই ছিল ১৯৭১। জানানো হয়নি হানাদার বাহিনী আসলে কারা। সুস্পষ্ট করে জানতে দেওয়া হয়নি ১৯৭১-এ পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে হত্যাযজ্ঞ চলেছিল। ক্ষমতার পালাবদলে স্কুলের পাঠ্যপুস্তকে ১৯৭১ বদলেছিল বার কয়েক। চেতনার বীজহীন ছিল প্রজন্ম। নিজভূমে আপন অর্জনের ইতিহাস জানা থেকে ধাপে ধাপে কয়েক প্রজন্মকে সফলভাবে বঞ্চিত করাতেই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার অনুচ্চারিত রয়েছিল বছরের পর বছর।

যদিও রাজাকাররা রাজাকারই আছে, অনেক মুক্তিযোদ্ধা আদর্শচ্যুত হয়েছেন ৪৩ বছরে। আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি-সমাজব্যবস্থা-জীবনযাপনের সঙ্গে চেতনার সমন্বয়হীনতা প্রতিভাত হয় যখন বাচ্চু রাজাকার আমজনতাকে ধর্মের নামে বশ করতে সমর্থ হন। শর্মিলা বসু নিরপেক্ষ গবেষণার নামে শহীদ পরিসংখ্যান নিয়ে অ্যান্টিথিসিস প্রকাশ করলে আইনগত প্রক্রিয়া ভিন্ন কেবল সমালোচনাতে সীমাবদ্ধ থাকায় আমাদের জাতিগত চেতনার রাষ্ট্রীয় ভিতটা নড়বড়ে ঠেকে। চেতনা কেবল হৃদয়ে ধারণ করে বসে থাকার বস্তু নয়।

চলচ্চিত্র, নাটক, সঙ্গীত, কবিতা, উপন্যাস, গবেষণা নিবন্ধ ২০১৪তেও '৭১কে বাস্তব করে তোলে। এসব মাধ্যমেই '৭১কে কেন্দ্র করে প্রচুর সৃষ্টি আছে। তবু অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে আরও প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ পটভূমিকে ঘিরে ডিজিটাল ফরম্যাটে দ্বিভাষিক চলচ্চিত্র নির্মাণ জরুরি। আমরা কি মওলানা ভাসানীকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে পারি না? সালাম-বরকত-রফিক-জব্বারকে নিয়ে? শহীদ রুমীকে নিয়ে? সাতজন বীরশ্রেষ্ঠকে নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ কি দুরূহ? জাহানারা ইমামের 'একাত্তরের দিনগুলি'র চলচ্চিত্রায়ন হতে পারে না? ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধের নায়কদের নিয়ে চলচ্চিত্র এসব বীরের জন্য হবে অনন্য শ্রদ্ধা। আর শিশু-কিশোর-তরুণ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসকে জানার খোরাক। '৭১ নিয়ে প্রচুর গ্রন্থ আছে। এই ঐতিহাসিক গ্রন্থগুলোর ইংরেজি সংস্করণ প্রয়োজন। মুক্তিযুদ্ধ-গবেষণায় রাষ্ট্রীয় বাজেটে সুস্পষ্ট করে অর্থায়ন ঘোষণা থাকা উচিত। বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোকে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম বাড়াতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে সাহিত্য, নিবন্ধ তুলে দিতে হবে বিদেশি রাষ্ট্রের বিশিষ্টজনের হাতে।

আমাদের নিজ সীমারেখায় '৭১-এর ইতিহাস নিয়ে যখন বহুমাত্রিক অসচেতনতা, তখন অপরাপর দেশে আমাদের ইতিহাস নিয়ে বিভ্রান্তি ঘটলে দায়ভার কাকে দেওয়া যায়? সাদা চোখে ধরে নেওয়া যেতে পারে, অনেক ভারতীয়ই '৭১-এ বাংলাদেশ জন্মের ইতিহাস পূর্ণাঙ্গরূপে জানে না। অপর্ণা সেন, যশরাজ ফিল্মস প্রতিষ্ঠান কোনো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে বড় ফ্রেমে বিভ্রান্তি নির্মাণ করছেন না বলে ধরে নিচ্ছি। আর তাই ১৯৭১ কেন্দ্রিক গোটা পাঁচ ইংরেজি গ্রন্থ, ইংরেজি সাবটাইটেলে কিছু প্রামাণ্যচিত্র আর সিনেমা পেঁৗছে দেওয়া হোক 'গুন্ডে' সিনেমার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান যশরাজ ফিল্মস কর্তৃপক্ষের হাতে। এই সিনেমার সঙ্গে অনেক বাঙালি শিল্পী জড়িত আছেন। '৭১-এর দলিল পেঁৗছে যাক সিনেমার কশাকুশলীদের হাতে। দলিল পেঁৗছে যাক অপর্ণা সেনের হাতেও। দলিলগুলো তাদের ১৯৭১কে জানতে শেখাবে নিশ্চিত।