বাংলাদেশের কন্যা

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 13 March 2015, 01:21 PM
Updated : 13 March 2015, 01:21 PM

১.
ভারতে ধর্ষণ পরিসংখ্যান দেখে অনেক বাংলাদেশি বলেন, আমাদের দেশ অনেক ভাল আছে। যারা মনে করেন, নারীর নিরাপত্তা অর্থ ঘরের চৌহোদ্দির ভেতরে আপাদমস্তক মুড়ে থাকা, তারা উন্নত বিশ্বের নারী ধর্ষণের পরিসংখ্যান দেখান এবং দ্বিরুক্তি করেন, মুসলিম দেশের নারীরা ভাল আছে। আমাদের দেশে নারীরা ভাল আছেন বলতে কী বোঝায়? ভারতে নারীদের ধর্ষণচিত্রে অনিয়ন্ত্রণই বা কেন?

সৌদির মত মুসলিম প্রধান দেশে আমাদের দেশের নারীরা গৃহকর্মী হিসেবে অবস্থান করে অধিকাংশ ক্ষেত্রে নির্যাতনের শিকার হন। কিন্তু কট্টর সৌদিতে নারীর একলা চলাচলে যে বিধিনিষেধ আছে, তা পেরিয়ে আইন পর্যন্ত দ্বারস্থ হওয়া দুঃসাধ্যকর। আর ধর্ষিতার সামাজিক অবমূল্যায়ন আমাদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সমাজে বড় দুভোর্গের। সুতরাং ধর্ষিতা নারী ও পরিবার ঘটনা লুকিয়ে রাখে। তাহলে অজানা ঘটনার পরিসংখ্যান কী করে লিপিবদ্ধ হবে?

উন্নত বিশ্বে ধর্ষণের সংজ্ঞায়ন আরও বড় পরিসরে। উপরন্তু, সেখানে নারী যথেষ্ট স্বাবলম্বী এবং ধর্ষিতা নারী সমাজে কোনঠাসা অবস্থানে থাকে না বিধায়, ধর্ষণ, যৌন হয়রানির মত অভিজ্ঞতায় নারী দমিত না হয়ে আইন মোতাবেক মামলার পদক্ষেপ নিতে পারেন। এমনকি কর্মক্ষেত্রে মানসিকভাবে যৌন হয়রানির মত সূক্ষ অভিজ্ঞতাগুলোও জরিপকালে উপাত্ত হিসেবে পাওয়া সম্ভব হয়।

বাংলাদেশে নারীদের নিরাপদ রাখার সমাজসিদ্ধ পন্থা হচ্ছে সান্ধ্য আইন, গৃহী জীবন। ভারতে নারীর প্রতি যতই বৈষম্য থাকুক, এও সত্য যে, ভারতের নারীরা প্রগতিশীল, আত্মনির্ভরশীল। যেহেতু এ দু'টো বিশেষণ তাদের বহির্মুখী করে, তাই তারা নারীলিপ্সু পুরুষদের নজরে আসেন সহজে। আমাদের দেশে নারীদের স্বাবলম্বী হয়ে ওঠার চিত্র পার্শ্ববর্তী দেশের মত নয়। অনেক সামাজিক-পারিবারিক বিধিনিষেধ মেনে তবেই চাকরি আর বাইরে যাতায়াত করেন আমাদের নারীরা। নারীরা চ্যালেঞ্জিং চাকরি বাছতেও অনাগ্রহী থাকেন সংসার, পরিবার আর সমাজকে খুশি করতে।

নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক ধ্যানধারনার সমাজে, নারী যৎসামান্য স্বাধীনতা বেশি ভোগ করতে শুরু করলেই, তাকে মুখোমুখি হতে হবে অনাকাঙ্খিত অভিজ্ঞতার। তখন আর ভারতের পরিসংখ্যান দেখে বাংলাদেশের পুরুষতন্ত্র নির্ভর সমাজ নিয়ে আত্মতুষ্টির সুযোগ থাকবে না।

২.
সমস্যা হল, যখন বোঝাই যাচ্ছে, ঘর থেকে বের হওয়া মানেই যৌন হয়রানি, ইভটিজিং, ধর্ষণ, তাহলে নারীর লক্ষণ রেখা পার হওয়া জরুরী কেন! সমাজ, পরিবার, হয়ত প্রশাসনের লোকেরাও ঠিক এভাবে বলবে নারীকে। ব্যতিক্রম মনে হলো সাধারণ পরিবারের জ্যোতির বাবা-মাকে। ভারতের জ্যোতি সিং বাসে নির্মমভাবে গণধর্ষণের শিকার হয়েছিলেন ২০১২ সালে। ১৩ দিন মৃত্যুর সাথে যুদ্ধ করে পুরুষতান্ত্রিক সমাজকে প্রশ্নবিদ্ধ করে মারা গিয়েছিলেন। মেয়েটির পরিচয় ধর্ষিতা হওয়ার কথা ছিল না। জ্যোতি একজন মেডিকেল শিক্ষার্থী ছিলেন। স্বাবলম্বী নারী ছিলেন। পড়ার খরচ জোগাতে তিনি কলসেন্টারে নৈশকালীন চাকরিও করতেন।

'ইনডিয়া'স ডটার' প্রামাণ্যচিত্রটির প্রচার ভারত সরকার বন্ধ করে দিতে চাইলেও, জ্যোতির বাবা-মা চান এই প্রামাণ্যচিত্রটি সকলে দেখুক। জ্যোতির বাবা-মাকে দেখে উচ্চশিক্ষিত মনে হয় না, আর্থিকভাবে তেমন স্বচ্ছলও মনে হয় না। অথচ তারা যে যৌক্তিক ঔদার্য, সমর্থন দেখিয়েছেন জ্যোতির প্রতি, তা মূলত কন্যা সন্তানকে দৃঢ়মনোবলের অধিকারীরূপে গড়তে সক্ষম। মৃত কন্যার শোক সামলে তারা দৃঢ়তার সাথে প্রশ্ন রেখেছেন সমাজের কাছে, মেয়েদের দোষই খোঁজা হয় কেন? তারা প্রশ্ন রেখেছেন, রাত ন'টায় কেন একজন মেয়ে চলাফেলা করার স্বাধীনতা পাবে না?

'কেন' এর একটা পুরুষতান্ত্রিক উত্তর পাওয়া যায় ধর্ষক পক্ষের ওকালতি করা এম.এল. শর্মার কাছে। প্রামাণ্যচিত্রে তার বক্তব্য কাব্যিকভাবেই করেছেন তিনি। নারীকে তুলনা করেছেন ফুলের সাথে, যে ফুল কোমল। যে ফুল নালায় পড়লে নষ্ট হয়, উপাসনালয়ে দিলে পূজ্য হয়।

"A girl is just like a flower. It gives a good looking, very softness, performance, pleasant…That flower always needs protection. If you put that flower in a gutter, it is spoil. If you put it in the temple, it is worshiped." 
-M.L. Sharma, the defense lawyer for the rapists.

যুগের পর যুগ ধরে পুরুষ কবিরাও তো এভাবে নারীকে কোমল ফুল, আরাধ্যদেবী বানিয়ে নারীর শক্তিমত্তাকে তাদের মনোজগত থেকে বিচ্ছিন্ন করেছেন কৌশলে। নারী মূলত এমন কবিতাতেই ভুলে যায় নিজের প্রকৃত সত্ত্বাকে। ব্যতিক্রম ছিলেন, বিদ্রোহী কবি নজরুল। তিনি নারীকে কোমল আর দেবী রূপে না দেখে তাকে চণ্ডিকারূপে জাগাতে চেয়েছিলেন। গৃহবাসী নয়, নারীকে রণাঙ্গনের রণরঙ্গীনি করে তুলেছিলেন নজরুল। নজরুলের নারীতেই প্রকৃত মুক্তির জ্যোতি উদ্ভাসিত ছিল। তথাপি বিশ্বব্যাপী নারীরা কমই বুঝেছে আপন শক্তিমত্তা। কারণ, সমাজ শৈশব থেকেই নারীকে আত্মনির্ভরশীল গড়ার চেয়ে 'পুরুষনির্ভরশীল' করে গড়ে তোলে।

আর সে কারণেই ধর্ষকদলের একজন, মুকেশ সিং মৃত্যুদণ্ড মাথায় নিয়েও অন্যায়কর্মে উপলব্ধিহীন থেকে বলতে পারে, নারী কেন রাতে চলাফেরা করবে? ধর্ষক মুকেশ বলতে চেয়েছে, ভাল মেয়েরা সমাজে এভাবে চলে না। খারাপ মেয়েরাই রাতে বাইরে চলে এবং এ কারণে ধর্ষিত হওয়াটাই তাদের প্রাপ্য। মুকেশের দৃষ্টিতে সমাজে ২০% মেয়েরা ভালভাবে চলাফেরা করে, অর্থাৎ সমাজের ৮০% নারীরা খারাপ। পরিসংখ্যানটা যদিও আসামি ভারতের সমাজব্যবস্থার প্রেক্ষিতে বলেছে, তবে একই মানসিকতা বহন করে আমাদের ঘুঁণে ধরা সমাজও।

"Housework and housekeeping is for girls, not roaming in discos and bars at night doing wrong things, wearing wrong clothes. About 20% of girls are good."
-Mukesh Singh, one of five convicted of the rape

৩.
ভারতের এক আসামি যখন বোঝাতে চায় সমাজের ৮০% নারীই খারাপ, তখন আল্লামা শাহ আহমদ শফী সাহেবের মুখচ্ছবি মনে পড়ে যায়। যখন আইনজীবী এম.এল. শর্মা নারীকে কোমল ফুল হয়ে থাকতে বলেন, তখনও আল্লামা শফি সাহেবের চেহারা মোবারক মনে পড়ে যায়।

ঘটনাচক্রে, কোনও কোনও পরিসংখ্যান মোতাবেক, এদেশের গামেন্টস শিল্প প্রতিষ্ঠায় ৮০% নারী শ্রমিকের অবদান রয়েছে। আল্লামা শফি সাহেব তাদের (এবং চাকুরীজীবী নারীদের) তেঁতুলতুল্য ঘোষণা দিলেন। আল্লামা শফি সাহেব রসিয়ে রসিয়ে বলেছিলেন, 'রাতবিরাতে জেনা' করে এসব নারীরা ঘরে ফেরে। জেনার টাকায় সংসার চলে বলে আজকাল কোনও সংসারেই বরকত থাকে না।

ভারতের সমাজের ৮০% নারী খারাপ, আর আমাদের ৮০% নারী ব্যাভিচারী। বিবিসি যেমন 'ইন্ডিয়া'স ডটার' করেছে, তেমন করে আরেকটি প্রামাণ্যচিত্র বানানো উচিৎ 'বাংলাদেশের কন্যা' নিয়ে। যেখানে দেখানো দরকার, আমাদের সমাজে ধর্ষক মনস্তত্ব লালনকারীদের চেহারা। দেখানো দরকার আল্লামা শফি সাহেবের সেই ওয়াজ। দেখানো দরকার এরকম প্রত্যন্ত অঞ্চলের ওয়াজগুলোতে নারীকে নিয়ে কতটা কদর্য বয়ান দেন ধর্ম ব্যবসায়ীরা। এও দেখানো দরকার, নারী সমিতি ঢাকার দেয়ালে দেয়ালে পোস্টার ছাপিয়ে নিরাপত্তা বেষ্টনির মধ্যে একটা সমাবেশে গলা বড় করে সরকারকে ব্যবস্থা নিতে হবে জানিয়ে কীভাবে নিজেদের দায় শেষ করে এবং আল্লামা শফি সাহেব মুক্ত থাকেন।

যে পাকিস্তানে ব্লাসফেসি আইন আছে, যে পাকিস্তানে অনার কিলিং হয়, যে পাকিস্তানে মৌলবাদের আস্তানা, সেই পাকিস্তানে কিন্তু সুশীল সমাজ একটি মামলা করেছিল লাল মসজিদের খতিব মাওলানা আবদুল আজিজের বিরুদ্ধে, যিনি প্রকারান্তরে পেশোয়ার স্কুলে জঙ্গি হামলার সমর্থন করেছিলেন। তাহলে আমাদের সুশীল সমাজ, নারী সমিতি আল্লামা শফি সাহেবের বিরুদ্ধে একটা আইনগত মামলা দায়ের করতে এগিয়ে এলেন না কেন আজ পর্যন্ত?

৪.
নারীকে 'ভাল' হওয়ার দায়বদ্ধতা দিয়ে, অবরোধবাসিনী করে সমাজ কী এটাই বলে না যে পুরুষতন্ত্রমাত্রই ধর্ষকামী? সমাজে পুরুষের ধর্ষণকর্ম একটি প্রতিষ্ঠিত সত্য এবং নারীর নিজেকে রক্ষা করার একটাই পন্থা, গৃহকোণে স্থায়ী ঠিকানা গড়া। নারীকে নিয়ে বিশাল বিশাল সভা হবে নারী দিবসে, অনেক টকশো'তে নারী মুক্তি নিয়ে আলোচনা হবে, সরকারকে সুশীলরা সতর্ক করবেন নারীর নিরাপত্তা প্রদানে, কিন্তু নারীর মুক্তি হবে কীসে? নারীর নিরাপত্তায় কোনও একটা মাস্টার প্ল্যান দিতে পেরেছে কী সুশীল সমাজ? সামাজিক ধ্যানধারনার পরিবর্তন তো দীর্ঘ মেয়াদী পদ্ধতি, আইনি কার্যক্রমে হয়রানির যে চিত্র তাও এক'দু বছরে বদলাবে না। তাহলে কীসে হবে মুক্তি?

নারীর জন্য সকলে এত ভাবছেন, খোদ নারীকে নিজেকে নিয়ে ভাবার উপযুক্ত করে গড়ে তোলা হচ্ছে কী? নাকি নারীকে তার মুক্তির জন্যও কোনও মহাপুরুষের উপর নির্ভর করে থাকতে হবে? বেগম রোকেয়া শিক্ষার কথা বলেছিলেন, শিক্ষার পাশাপাশি তিনি স্বাবলম্বী হতে বলেছিলেন। তিনি চেয়েছিলেন নারী মাত্রই কর্মক্ষম, উপার্জনসক্ষম হোক। বেগম রোকেয়া স্বর্ণালংকারে মোড়ানো নারী দেখতে চাননি। হেঁশেলের চেয়ে রসায়ন পরীক্ষাগারে নারীর মনোযোগ চেয়েছিলেন। বেগম রোকেয়ার মানসপটের সেই নারীকে তবে শিক্ষা দিয়ে মানসিকভাবে বলীয়ান করতে হবে; আর কোমলমতি তকমা ঝেড়ে ফেলতে হবে প্রাণপণে।

তাই সরকারের কাছে আর্জি- প্রতিটি সরকারি-বেসরকারি বিদ্যালয়ে, কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য শরীরচর্চা বিভাগের আওতায় আত্মরক্ষামূলক কৌশলশিক্ষা বাধ্যতামূলক করা হোক। আমরা চীন-জাপানের শিশুদের কথা পড়েছিলাম, ছোটবেলা থেকেই নাকি তাদের অধিকাংশ কারাতে, জুডো, মার্শাল-আর্ট শেখে। এমন চমৎকার একটি শিক্ষণীয় অধ্যায় থেকে আমাদের নারীদের কেন বঞ্চিত রাখা হচ্ছে?

সরকার যেন সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিশেষত নারী শিক্ষার্থীদের জন্য আত্মরক্ষামূলক কৌশল চর্চা অন্তর্ভূক্তি ও বাধ্যতামূলক করে। শিশুশ্রেণি থেকে এই অধ্যায় যুক্ত হলে পরিবার ও শিশুটি সহজভাবে এই চর্চার সাথে অভ্যস্ত হবে। যে কোনও বিপদে কীভাবে নিজেকে, অন্যকে উদ্ধার করতে হয়, এই শিক্ষায় শিক্ষিত না করলে নারীর আর মুক্তি হবে না।

খারাপ নারী অথবা ভাল নারী – এইসব অবমাননাকর কথার জালে নারীকে আবদ্ধ হতে দেওয়া যাবে না। যেমন করে গার্মেন্টসের নারী শ্রমিকেরা আল্লামা শফি সাহেবের তেঁতুলবচনকে উপেক্ষা করে এখনও দেশের অর্থনীতিতে ভূমিকা রেখে যাচ্ছে, তেমন করে অন্ধ সমাজের চোখে এই 'খারাপ' নারীদের আরও আরও আত্মনির্ভরশীল করতে হবে।

***