রুবেলের বিশ্বকাপ ক্রিকেট সাফল্য এবং হ্যাপীর মামলা না চালানোর ঘোষণায় মামলাটি যে কার্যত অকার্যকর হয়ে গেল, তা বোধগম্য ছিল। হ্যাপী-রুবেল ঘটনায় এ পর্যন্ত দু'টো বিস্তারিত কলাম লেখার সুযোগ ঘটেছিল বাংলা ট্রিবিউনে। তৃতীয় লেখাটির আবশ্যকতা যে ঘটবে, তার প্রস্তুতি ছিল না। লক্ষ্য করলাম, রুবেল-হ্যাপী মামলাটিকে অনেকে 'সস্তা' তুল্য করে 'জনগুরুত্বপূর্ণ' খাতে সময় ব্যয় করতে আগ্রহী থাকেন। অথচ বিভিন্ন ডাইমেনশন থেকে মামলাটি একটি চমৎকার কেস স্টাডি।
শঙ্কাটা 'রুবেল-হ্যাপী: বিসিবির শৃঙ্খলা ও ক্রিকেটভক্ত মনস্তত্ত্ব' কলামেই ব্যক্ত করেছিলাম। রুবেলকে রক্ষার্থে তার শুভাকাঙ্ক্ষী রূপে রয়েছে প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। রুবেল বিশ্বকাপ শেষে ফিরে এলে তাকে মামলা থেকে সম্মানে রেহাই দেওয়া হবে তাও অনুমেয় ছিল। সুতরাং পুলিশ যখন পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন চার্জশিট প্রস্তুত করে মামলাটি খারিজের পথ করে দেয়, তখন নারীর জন্য তৈরি আইনের অসাড়তা প্রমাণিত হয়। মজার ঘটনা ছিল, রুবেলের জন্য পুলিশের এক প্রকার 'চারিত্রিক সনদ' হাতে এগিয়ে আসাকে রুবেলে ভক্তরা গর্বের সঙ্গে দেখেছেন। বলতে চেয়েছেন, হ্যাপীর অভিযোগ বানোয়াট ছিল। পুনরায় অঙুলি নির্দেশ করেছেন হ্যাপীর চরিত্রের প্রতি।
খুবই সম্প্রতি আইনজীবীদের ত্রুটির কারণে বিভিন্ন মামলায় ন্যায়বিচারের প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য করেছেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা। তিনি মামলায় আইনজীবীদের 'কেস স্টাডি' করে আদালত প্রাঙ্গনে উপস্থিত হতে বলেন। তিনি এও বলেন, আইনজীবীদের অনুপস্থিতিতে অসংখ্য মামলা ঝুলে থাকে বছরের পর বছর। এভাবে মামলাগুলো অকার্যকর হতে থাকে। একই ধরনের অভিযোগ বহুবার উত্থাপিত হয়েছে পুলিশ প্রশাসনের প্রতিও। পুলিশি অভিযোগপত্রের দুর্বলতার কারণে মামলা পরিচালনা চ্যালেঞ্জিং হয়ে ওঠার দৃষ্টান্তও রয়েছে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক।
আইনগতভাবে নারী অভিযোগকারীর জন্য রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী থাকার কথা। কিন্তু সম্ভবত হ্যাপীর অজ্ঞতা অথবা রুবেলের মতো জাতীয় বীরের পক্ষে থাকতে রাষ্ট্রের আগ্রহী হওয়ার কারণে হ্যাপীর পক্ষে কোনও রাষ্ট্রীয় আইনজীবী নেই। উপরন্তু পুলিশ এই অভিযোগকে খারিজ করতে ব্যতিব্যস্ত। ফেসবুক ঘোষণার মাধ্যমে হ্যাপীর আইনজীবী কুমার দেবুল দে'র মামলা থেকে নিজেকে গুটিয়ে নেওয়াটা ছিল পুলিশকে এই চার্জশিট তৈরির সুযোগ গড়ে দেওয়ার একটি ধাপ।
বিভিন্ন পত্রিকা উল্লেখ করেছে 'অভিযোগের প্রমাণ না পাওয়ায়' পুলিশ মামলাটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেছে। 'রুবেল-হ্যাপী যৌন প্রতারণা মামলা: ধর্ষণ, মিডিয়া, আইন ও বিসিবি' কলামটিতে বিস্তারিতভাবেই লিখেছিলাম যে, প্রতারণামূলকভাবে শারীরিক সম্পর্ক গড়াকে বাংলাদেশ আইনে সুনির্দিষ্টভাবে ধর্ষণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। লক্ষণীয়, যেহেতু প্রতারণা বা ছলচাতুরির মধ্য দিয়ে সম্মতি আদায়, তাই এমন শারীরিক সম্পর্কস্থাপনে নির্যাতনমূলক ধর্ষণের আলামতগুলো সাধারণত অনুপস্থিতই থাকবে ।
পুলিশি প্রতিবেদনে বক্তব্যে বলা হয়েছে– প্রাপ্তবয়স্ক নারী হিসেবে বিবাহবহির্ভূতভাবে শারীরিক সম্পর্কে জড়িত হলে যা হয়েছে তা হ্যাপীর সম্মতিতেই হয়েছে এবং তা ধর্ষণের সংজ্ঞায় পড়ে না। এই 'জ্ঞান' রাখা পুলিশ 'ম্যারিটাল রেপ'কেও কি কখনও 'ধর্ষণ' হিসেবে ভাবার ক্ষমতা রাখে? প্রশাসন ও আইন নিয়ে যারা কাজ করেন, তাদের মানবিক, নাগরিক, ব্যক্তি, নারী অধিকার নিয়ে এই যখন জ্ঞানপাঠ, তখন আসলে একজন ভিকটিম কোনোভাবে তার অধিকার আদায়ের কল্পনাও করতে পারেন কি?
নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন-২০০০ (২০০৩ এর সংশোধনীসহ) এর ৯(১ ) ধারা অথবা বাংলাদেশ দণ্ডবিধির ৩৭৫ নং ধারাগুলো খুব স্পষ্ট করে 'প্রতারণামূলকভাবে সম্মতি' আদায় করে যৌনসম্পর্ক স্থাপনকে 'ধর্ষণ' আখ্যায়িত করেছে। এই আইনি ধারা থেকেই বোঝা যায়, এখানে জোরপূর্বক, নির্যাতকপূর্বক কোনও আলামত নিতান্তই অপ্রয়োজনীয়।
খুব লক্ষণীয় যে, ধর্ষণ মানেই ধস্তাধস্তি এমন একটি 'ভ্রান্ত' মনস্তত্ত্বকে পুঁজি করে পুলিশ একটি রুবেল-বান্ধব চার্জশিট গুছিয়েছে। ডা. নুজহাত আন্দালিব স্বাক্ষরিত ডিএনএ রিপোর্টে লেখা ছিল 'ভিকটিম হ্যাজ নট ফাউন্ড রিসেন্টলি ফোর্সফুলি সেক্সুয়াল ইন্টারকোর্স'। প্রগতিশীল গণমাধ্যমগুলোও একই মনস্তত্ত্বকে অক্ষুণ্ণ রাখতে চায় বলে হ্যাপীর ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট প্রকাশের পর থেকে পত্রিকায় রুবেল-বান্ধব শিরোনাম দেখা গেছে, 'হ্যাপীকে জোর করেননি রুবেল'। সেই সকল মিডিয়া ও পুলিশকে প্রশ্ন, যেখানে প্রতারণার মাধ্যমে শারীরিক সম্পর্কের সম্মতি আদায় হচ্ছে সেখানে জোর করার প্রয়োজনীয়তা কেন পড়বে? যেখানে জোর করাই অপ্রয়োজনীয় সেখানে জোরাজুরির আলামত পাওয়া যায়নি এমন পুলিশি বক্তব্যে পুরুষতন্ত্রের সামাজিক ও আইনগত জয়জয়কার প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এমন বক্তব্য আগামীতে অন্য যে কোনও নারী ভিকটিমকে আইনের আশ্রয় নিতে কোনভাবেই আগ্রহী করবে না। ফলে প্রতারণার মাধ্যমে ধর্ষণ সংক্রান্ত আইনটি নারীর অজানা ও সর্বোপরি অকার্যকর থেকে যাবে।
রুবেলের নিজেকে নির্দোষ প্রমাণের অধিকার অবশ্যই আছে। কিন্তু মামলটিকে স্বাভাবিক গতিতে পরিচালিত হতে দেওয়ার মাধ্যমে রুবেল যখন তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ থেকে মুক্ত হতে পারবেন, সেটাই হবে তার জন্য সম্মানজনক। বিভিন্ন জায়গায় রুবেলের ভাষ্য ছিল, হ্যাপী তাকে ব্ল্যাকমেইল করছে, যদি তাই হয়, তাহলে রুবেল কেন এখনও হ্যাপীর বিরুদ্ধে ব্ল্যাকমেইল করার মামলা আদালতে উপস্থাপন করছেন না? একই সাথে রুবেলের সাথে যদি হ্যাপীর কোনও ধরনের সম্পর্ক না থেকে থাকে, তবে সামাজিক হয়রানির আইনগত অভিযোগ কেন আনতে পারছেন না রুবেল?
গত ৩১ ডিসেম্বর ঢাকার একটি আদালত রুবেল হোসেনের ডিএনএ পরীক্ষার অনুমতি দেওয়ার পর রুবেল ডিএনএ পরীক্ষা সম্পন্ন না করেই বিশ্বকাপ আসরে উড়াল দিয়েছিলেন। হ্যাপী নিজে থেকে ডিএনএ পরীক্ষায় গিয়েছেন এবং হ্যাপী ডিএনএ রিপোর্ট নিয়ে অকথ্য পর্যায়ের প্রতিবেদনও দেখা গেছে বেশকিছু মানহীন পত্রিকাগুলোতে। কিন্তু আদালতের নির্দেশ থাকার পরও রুবেলের ডিএনএ টেস্ট রিপোর্ট কোথায়? রুবেলের ডিএনএ রিপোর্ট ব্যতিরেকে কেন মামলাটির যবনিকাপাত ঘটাতে চায় পুলিশ?
একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে যদি দেখা হয়, তবে দেখা যায়, পুলিশি প্রতিবেদনটি 'ধর্ষণ' স্বীকার না করলেও, সম্পর্কের জন্য নারী শরীরকে দায়ী করে রুবেল ও হ্যাপীর শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টি একভাবে নিশ্চিতই করছে। সেক্ষেত্রে, রুবেল ও হ্যাপীর শারীরিক সম্পর্কের বিষয়টির সত্যতা পুলিশি প্রতিবেদন থেকেই প্রমাণিত হচ্ছে নাকি? কিন্তু রুবেল তো কোনওভাবেই শারীরিক সম্পর্কের কথা স্বীকারে আগ্রহী নন। তাহলে রুবেলের বক্তব্য এবং পুলিশি প্রতিবেদনের বক্তব্য তো মিলছে না! এমনকি পত্রিকায় যখন শিরোনাম যখন হয় 'হ্যাপীকে জোর করেননি রুবেল', এর মাধ্যমেও প্রমাণিত হয় হ্যাপী-রুবেলের শারীরিক সম্পর্কের সম্ভাব্যতা; যেখানে অবশ্যই জোরাজুরি ছিল না, ছিল প্রতারণা করে সম্মতি আদায়। আর যেহেতু, প্রতারণা, সেহেতু আইন একে স্পষ্টতই ধর্ষণ গণ্য করে থাকে।
ভারতের তারকা সালমান খানের একটি দায়িত্বহীন মুহূর্তের খেসারত দিয়েছিল ফুটপাতের এক ব্যক্তি। ১৩ বছর পরে হলেও আদালত তাকে ঠিকই দোষী চিহ্নিত করেছে। সালমান খানের মতো প্রভাবশালি ব্যক্তিত্বও মামলাটিকে অকার্যকর করতে পারেনি কোনভাবেই। সালমান খানের ৫ বছরের হাজতবাস মানে পুরো চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রির বিশাল ক্ষতি। এমনই মহিরূহ সালমান খান। তবুও সাজাপ্রাপ্তির পর তিনি যে স্বল্পমেয়াদি জামিন পেয়েছিলেন, তা নিয়ে সমালোচনা ও পাল্টা পিটিশন পর্যন্ত দায়ের হয়েছে। এটাই হচ্ছে আইনের ইতিবাচক দৃষ্টান্ত। পক্ষান্তরে রুবেলের বিরুদ্ধে হ্যাপীর দায়েরকৃত মামলাটিকে 'বন্ধ' করতে পুলিশের অতিউৎসাহি তৎপরতা এবং পত্রিকাগুলোর রুবেল-বান্ধব শিরোনাম আইন নিয়ে একটি নেতিবাচক দৃষ্টান্ত স্থাপন করছে।
পুলিশের চারিত্রিক সনদপত্র তথা রুবেল-বান্ধব চার্জশিটের ভিত্তিতে নয়, মামলাটি আইনি পদ্ধতিতে এবং ধর্ষণ সংস্ক্রান্ত সকল ধারাগুলোকে ব্যবহার করে পরিচালিত হওয়া উচিৎ। 'ধর্ষণ অর্থ ধস্তাধস্তি' এমন সামাজিক গোঁড়ামিপূর্ণ বার্তা প্রদান নারী অধিকার প্রতিষ্ঠাকে দুষ্কর করে তুলবে। একই সাথে বাড়বে প্রতারণামূলক শারীরিক সম্পর্কের ঘটনা। পুরুষ জানবে, এমন কৃতকর্ম আইনে অপরাধ নয়। ঘটনার শিকার নারী জানবে, আইন নারীর দায় নেবে না। তাই পুলিশ ও আদালতেরও দায় রয়েছে সামাজিক স্তর ভেদে এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষাপটকে বোঝার। পুলিশ ও আদালতেরও দায় রয়েছে আইনি অধিকার নিয়ে নারীকে সচেতন করার। পুলিশ ও আদালতেরও দায় রয়েছে পুরুষতন্ত্রের 'দুষ্টুমি'কে প্রশ্রয় না দেওয়ার।
***
প্রকাশিত: বাংলা ট্রিবিউন, মে ১৮, ২০১৫