মুক্তিযুদ্ধে ‘ভারতীয় এজেন্টদের’ আত্মত্যাগ

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 11 June 2015, 07:53 PM
Updated : 11 June 2015, 07:53 PM

'1971', ২০০৭ সালে মুক্তি পাওয়া একটি হিন্দি চলচ্চিত্র। চোখে পড়ল ২০১৪ সালে, যখন 'গুণ্ডে' নিয়ে বেশ উত্তেজনা চলছিল বাংলাদেশে। '1971'-এর কাহিনী সংক্ষেপে চোখ আটকালো যখন দেখলাম লেখা আছে ১৯৭১ সালের 'ইন্দো-পাক' যুদ্ধে ভারতীয় যুদ্ধবন্দিদের নিয়ে সত্য ঘটনা অবলম্বনে চলচ্চিত্র। অবাক হচ্ছিলাম, এই চলচ্চিত্র নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা কেন চোখে পড়ল না?

'ইন্দো-পাক' যুদ্ধ এবং ১৯৭১– দুটো প্রেক্ষাপটের সহাবস্থানে প্রথমেই মনে হলো, 'গুণ্ডে' অথবা 'গয়নার বাক্স'র মতো পুনরায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসকে কোথাও অবমূল্যায়ন করে দেখানো হলো কি না কোনও ভারতীয় চলচ্চিত্রে? তবে সিনেমাটি শুরু করার পর শেষ দৃশ্য অব্দি '1971' কে দেখার এক বাক্যহীন অনুভূতি জাগল।

প্রিজনার অব ওয়্যার অর্থ্যাৎ যুদ্ধবন্দি ভারতীয় ছয় সেনা অফিসারদের  নিয়ে ছিল '1971' চলচ্চিত্রটির পটভূমি। যারা ১৯৭১-এর পর বন্দি অবস্থায় পাকিস্তানের গোপন জেলে কাটিয়ে দেয় ছয় বছর। এক সময় এই বন্দি ভারতীয় সেনারা বুঝতে পারে তারা  ভারত সীমান্তের ২০০ কি.মি. অদূরেই অবস্থান করছে, তখন তাদের মাতৃভূমিতে ফেরার আকাঙ্ক্ষা উদগ্রীব হয়ে ওঠে। স্বজনরা পাকিস্তানি জেলে জীবন কাটাচ্ছে- কিছু ভারতীয় নারীর এই আর্তিতে রেডক্রস পাকিস্তান জেলগুলো পরিদর্শন করে। যুদ্ধবন্দিদের রাখা হয়েছিল 'সিক্রেট ক্যাম্পে', ফলে কোনও ভারতীয় বন্দি খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়ে মানবাধিকার সংস্থার প্রধান জেল পরিদর্শন সন্তোষজনক এই মর্মে লিখিত স্বাক্ষর দেন। এদিকে লুকিয়ে পত্রিকা সংগ্রহ করে ছয় ভারতীয় সেনা জানতে পারে ভুট্টোকে সরিয়ে জেনারেল জিয়াউল হক সরকার গড়েছে। তারপর ভুট্টো জানান দিয়েছে, ভারতীয় সকল বন্দি সৈন্যকে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে এবং পাকিস্তান জেলে কোনও ভারতীয় বন্দি নেই। রেডক্রস কর্তৃক পাকিস্তান জেল পরিদর্শনে কোনও ভারতীয় বন্দি না মেলাকে জিয়াউল হক পাকিস্তানের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন। এরপরই ছয় ভারতীয় সেনা বন্দিক্যাম্প থেকে পালানোর চেষ্টা করে।

মাতৃভূমি ভারতে ফেরার এই যাত্রায় একে একে মারা পড়তে থাকে, নয়তো সতীর্থের জন্য আত্মোৎসর্গ করে সেনারা। সর্বশেষ দুজনের একজন ভারত সীমান্ত স্পর্শ করলেও পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে মারা পড়ে। পাকিস্তানি সেনাদের উপস্থিত চালাকিতে ভারতীয় সীমান্ত সেনারা মনে করে মৃত সৈন্যটি পাকিস্তানি। পাকিস্তানি সেনারা টেনে হিঁচড়ে পাকিস্তান সীমান্তে নিয়ে যায় মৃত ভারতীয় সৈন্যকে। সতীর্থদের মৃত্যুস্মৃতি নিয়ে বেঁচে থাকা একজনের পুনরায় জায়গা হয় পাকিস্তান জেলে। চলচ্চিত্র এখানে শেষ। তবে শেষ ফেম্রের কিছু কথা শিরদাঁড়ায় শিহরণ জাগিয়ে জানান দেয় আরেক ইতিহাস, যা ভারতের জন্য যন্ত্রণা আর বাংলাদেশিদের অনেকেরই অজানা। কিছু চিঠি, সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, হারানো সৈন্যদের ছবি আর একটি বার্তায় জানানো হয়, পাকিস্তান জেলে এখনও ৫৪ জন যুদ্ধবন্দি রয়েছে।

প্রিজনার অব ওয়্যার, ইংরেজিতে সংক্ষেপে বলা হয় POW;  ভারতীয়দের জন্য দগদগে এক ঘা। Indian POW অথবা Missing 54 নিয়ে খুঁজলেই মিলবে অনেক তথ্য। পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিষয়টি এখনও অমীমাংসিত।  বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পাকিস্তানের ৯২ হাজার সৈন্যকে মুক্ত করা হয় এবং পাকিস্তান তাদের ফিরিয়ে নেয়। কোনও কোনও ভারতীয় প্রতিবেদনে দাবি করা হয়,  ভারত সরকারের ব্যর্থতাতেই পাকিস্তান থেকে বন্দি ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি। ২০১৪ সালে ভারতীয় সুপ্রিম কোর্ট ৫৪ বন্দিকে ফিরিয়ে আনতে ভারতের ব্যর্থতায় উষ্মা প্রকাশ করে।  একইসঙ্গে আদালত প্রশ্ন রাখেন, এমন মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে ভারত কেন আন্তর্জাতিক আদালতের শরণাপন্ন হচ্ছে না। এত বছরে ৫৪ বন্দিদের জীবিত থাকা নিয়েও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেন আদালত।

ভারতে এই ৫৪ বন্দির নাম-ছবি-কাহিনি যতবার ব্যক্ত হয়, ততবার ১৯৭১ উচ্চারিত হয়। বাংলাদেশের অসংখ্য পরিবারের মতো, মুক্তিযুদ্ধে এই ভারতীয় ৫৪ জনের পরিবারও স্বজন হারানোর দীর্ঘশ্বাস নিয়ে বেঁচে আছে।   সংখ্যাটা আসলে শুধু ৫৪ নয়। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের হিসেবে ১,৯৮৪ জন  ভারতীয় সৈন্য শহীদ হয়। ভারতীয় কিছু পত্রিকার সূত্রমতে আহত হয় ৯৮৫১ জন ভারতীয় সেনা। বাংলাদেশ ভারতীয় শহীদ সৈন্যদের সম্মান প্রদর্শনে সৌধ নির্মাণ করবে, এমন সংবাদ জাতিগতভাবে স্বাগত জানানোর মতো। তবু গুটিকয়েকের গাত্রদাহ লক্ষ্যণীয়। ১৯৭১ সালে ভারত কেবল বাংলাদেশি শরণার্থীদের আশ্রয়ই দেয়নি, কেবল বাংলাদেশের পক্ষে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণই করেনি, তাদের প্রাণের আত্মত্যাগও মিশে আছে। মিশে আছে সেই সব আত্মত্যাগীর স্বজনদের অশ্রুও। এই সত্য ইতিহাসটি অনুভব করতে ব্যাঘাত ঘটানোর চেষ্টায় থাকে স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ও তাদের মদদদাতাগোষ্ঠী। ভারতবিরোধী রাজনৈতিক ট্রাম্প কার্ড চালানকে সফল করতে এই সহমর্মিতা থেকে বাংলাদেশিদের দূরে রাখাটাই এইসব অশুভ গোষ্ঠীর উদ্দেশ্য। 'সিক্স ইনডিয়ান কিলড বাই রাজাকারস', 'টোয়েন্টি ফাইভ ইন্ডিয়ান এজেন্টস কিলড ইন খুলনা', 'রাজাকারস কিল নাইনটিন ইনডিয়ান এজেন্টস', 'সেভেন ইন্ডিয়ান এজেন্টস কিলড বাই রাজাকারস', 'ফাইভ ইন্ডিয়ান এজেন্টস কিলড বাই রাজাকারস'- ১৯৭১ সালের এই  সংবাদ শিরোনামগুলো কারা ভুলিয়ে দিতে চায়?

বিষয়টা তথ্যগত বিভ্রান্তি যে, ১৯৭১–কে 'ইন্দো-পাক' যুদ্ধসাল উল্লেখ করছে অনেক ভারতীয় প্রতিবেদন। মূলত ১৯৬৫ সালে প্রায় ১৫ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ 'ইন্দো-পাক' যুদ্ধ নামে পরিচিত। ১৯৭১ সালে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যকার সম্মুখ সমরের দিন গণনাও প্রায় একই ধরা হয়। ১৯৭১-এর ৩ ডিসেম্বর থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ১৩ দিন, 'ইন্দো-পাক' ‍যুদ্ধ চলেছিল বলে ভারতীয়দের অনেকে মনে করে।  বস্তুত ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান ঐতিহাসিক  রাজনৈতিক, সীমান্তবর্তী দ্বন্দ্ব ও যুদ্ধকে  ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতের অংশ নেওয়ার সঙ্গে মিলিয়ে ফেলে ভারতীয়রা। আর তাই,  ভারতীয় চলচ্চিত্র '1971'  বা 'গুণ্ডে' –তে ১৯৭১'কে 'ইন্দো-পাক' যুদ্ধ বলা আসলে কোনও গোপন অভিসন্ধি নয়, বরং ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিভ্রান্তি, যা অনিচ্ছাকৃতও বলা চলে।

অনেক ভারতীয়ই ভাবে, এই 'ইন্দো-পাক' যুদ্ধ থেকে বাংলাদেশের জন্ম। অপেক্ষাকৃত তরুণ প্রজন্মের মধ্যেই ইতিহাসগত এই বিভ্রান্তি কাজ করে। বিশ্বকাপ ক্রিকেটের সময় যে বা যারা একটি স্যাটায়ার ভিডিওচিত্রে দেখাক না যে, ১৯৭১-এ ভারতের কারণে বাংলাদেশের জন্ম, তারা তুলনামূলকভাবে সেই তরুণ প্রজন্মভুক্ত যারা ১৯৭১'কে ইন্দো-পাক ইতিহাসের বাইরে আলাদা করতে পারে না। ১৬ কোটি জনগণের দেশ বাংলাদেশেই যেখানে মুক্তিযুদ্ধে ইতিহাস বিকৃতি ঘটে চলে, সেখানে স্বাধীনতার ৪৪ বছর পর ১২৮ কোটি জনসংখ্যার ভারতে বাংলাদেশের 'সঠিক' ইতিহাস জানা আপাদমস্তক একটা চ্যালেঞ্জই।

'এ নাম্বার অব মিসক্রিয়েন্টস অ্যান্ড ইন্ডিয়ান এজেন্টস ওয়্যার কিলড' অথবা 'দ্য আল-বদর, আল-শামস উইংস অব রাজাকার কিলড ফাইভ  ইন্ডিয়ান  এজেন্টস ইন রাজশাহী, রংপুর অ্যান্ড বগুড়া ডিসট্রিক্ট…' অথবা 'রাজাকারস অ্যান্ড মুজাহিদস অন মানডে ক্র্যাকডাউন হেভিলি অন ইনডিয়ান এজেন্টস ইন যশোর, গোপালগঞ্জ অ্যান্ড চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস কিলিং নাইনটিন অব দেম…' – মুক্তিযুদ্ধকালের এই সংবাদগুলোকে আলাদা করা যায় না আমাদের ইতিহাস থেকে।  আমাদের যেমন ধারণা,  ভারত আমাদের ইতিহাস জানে না, তেমন আমাদেরও জানার ঘাটতি আছে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামাণ্যে এইসব দলিলকে জনসাধারণের জন্য উপস্থাপন করা প্রয়োজন। আর ভারতীয়, বিশেষত ভারতীয় তরুণ প্রজন্মের জন্য ১৯৭১ নিয়ে বাংলাদেশে যত চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে তা ভারতীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোয় প্রদর্শন করার উদ্যোগ নিতে পারে বাংলাদেশ সরকারকে।

যার-যার মাতৃভূমি, তার তার দেশপ্রেমস্থল। যেমন আমরা আমাদের শহীদদের আত্মাহুতিকে সম্মান করি, ভারতীয়রাও তাদের শহীদদের প্রণতি জানায়। ঘটনাবহুল উপমহাদেশীয় রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে দুটো দেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ইতিহাস  সংস্পর্শিত। একের ইতিহাস অন্যকে অবদমিত করার জন্য নয়। ১৯৭১ ঘিরে আমাদের যেমন রয়েছে ৩০ লাখ শহীদের আর ৪ লাখ নির্যাতিতা নারীর মর্মব্যথা, ভারতীয় অসংখ্য পরিবারও ১৯৭১–কে ভুলতে পারে না তাদের মৃত ও হারানো স্বজনদের স্মৃতিকষ্ট বুকে নিয়ে। আর তাই, যেমন করে আমরা ৩০ লাখ শহীদকে স্মরণ করি, ৪ লাখ নির্যাতিত নারীকে উচ্চশিরে সম্মান জানাই, তেমন করে ভারতীয় শহিদদের অবদানকে জানাই শ্রদ্ধার্ঘ্য।

***