আমাদের অতীত অর্থনীতি দাঁড়িয়েছিল কৃষি নির্ভরশীলতায়। আমাদের বর্তমান অর্থনীতি বেগবান হয়েছে পোষাকশিল্পে। আমাদের আগামির অর্থনীতি গড়বে প্রযুক্তি। পাশাপাশি পর্যটন এখন অর্থনীতির সম্ভাব্য স্তম্ভ। একটি দেশের অর্থনীতি চালনায় চারটি মূল সূত্র অভাবনীয় ভূমিকা রাখে – প্রাকৃতিক সম্পদ, মানব সম্পদ, মূলধন এবং বাণিজ্য। এর মধ্যে প্রাকৃতিক সম্পদের ভূমিকা জনজীবনে তথা স্থানীয় অর্থনীতিকে বেগবান করতে সক্ষম।
ভৌগলিক কারণে স্থান ভেদে যে প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য গড়ে ওঠে, তা স্থানীয় সভ্যতা গড়তে সহায়ক। যে নীল নদ এক প্রকার মিথের মর্যাদা নিয়ে বহমান, তা মিশরিয় সভ্যতার কারিগর। চার হাজার মাইলের চেয়েও দীর্ঘ নীল নদ, পৃথিবীর দীর্ঘতম নদীতট, মিশরিয়দের জন্য আশির্বাদস্বরূপ। নদীর উর্বর পলিমাটি জোগাতো শষ্য। এমনকি দুই হাজার খ্রিষ্টাব্দ পূর্বে কৃষি প্রকৌশল প্রায়োগিক জ্ঞানও গড়ে উঠেছিল নীল নদ নির্ভর বাসিন্দাদের। যেমন, নদী থেকে নালা কেটে কৃষি সেচ ব্যবস্থাকরণ, সেচযন্ত্র তৈরী। নীল নদ হতে আহরিত মৎসও ছিল জীবন ও জীবিকা নির্বাহের যোগান। নীল নদের অবস্থানগত কারণে নদী ভিত্তিক যোগাযোগ ছিল সুবিধাজনক। ফলে গতিপ্রাপ্ত হয়েছিল বাণিজ্যিক লেনদেন। আজও নীল নদ মিশরীয়দের আশি ভাগ পানি চাহিদা মেটায়।
মিশরের গড়ে ওঠা নীল নদ ভিত্তিক। আমাদের বাংলাদেশও নদী মাতৃক। বাংলার ইতিহাস খননে যে সব চমকপ্রদ তথ্য প্রকাশিত হয়, তারমধ্যে রয়েছে আড়াই থেকে চার হাজার বছর পুরনো গঙ্গাঋদ্ধি সভ্যতা। পরাক্রমশালী এই রাষ্ট্রটি অন্যতম বাণিজ্যকেন্দ্র হয়ে উঠেছিল নদী প্রবাহের কারণেই। নরসিংদীর উয়ারী ও বটেশ্বর গ্রাম দুটোর সাথে গঙ্গাঋদ্ধির সম্পর্ক এখন অন্যতম গবেষণা। নরসিংদীর এ গ্রাম দু'টি যে প্রাচীন বাংলার গুরুত্বপূর্ণ নগরী ছিল এ বিষয়ে ইতিহাসবিদেরা বারবারই বলছেন। আর এই ইতিহাসে কয়রা নদী, পুরনো ব্রহ্মপুত্র নদ ও আড়িয়াল খাঁ নদী নির্ভর বাণিজ্যের ভূমিকা রয়েছে।
বর্তমানে যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতিকরণের প্রয়োজনীয়তায় দেশের নদীপথগুলোতে নির্মিত ব্রিজ যাতায়াতের সময় সংক্ষিপ্ত করেছে। তথাপি প্রাকৃতিক উৎপাদন ও জলবায়ু সুরক্ষায় নদীর ভূমিকা অনস্বীকার্য। নদীমাতৃক দেশ হওয়ার কারণেই বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ হিসেবে পরিচিত। এখানে সেচ ও উৎপাদন খরচ এতকাল কম রাখা সম্ভব হয়েছিল নদী নির্ভরতার কারণেই। কিন্তু কালক্রমে নদী ভিত্তিক জীবনযাপন কঠিন হয়ে উঠেছে। দেশের অর্থনীতির সূচকে কৃষি ভিত্তিক আয় পূর্বের তুলনায় পড়তির দিকে। ২০২১ সালের মধ্যে মধ্যম আয়ের দেশ হতে চলা বাংলাদেশে কৃষিখাতে ক্রমাগত কমে আসছে বিনিয়োগ। খাদ্যশস্যের ম্ল্যূ বাড়ছে। যার প্রভাব দেখা যায় কাঁচাবাজারে। এই মূল্যস্ফীতির প্রভাব পড়ে জনজীবনেও। শুধু তাই নয়, আশংকা হলো, বৈশ্বিক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতার সদস্য হয়ে উঠবে বাংলাদেশও।
রাজনৈতিক বৈরীতার মধ্যেও সরকার দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে তৎপর। নির্মাণ কারখানা স্থাপন, আউটসোর্সিং বান্ধব প্রযুক্তিখাত, পর্যটন বাণিজ্য উৎসাহিতকরণ – সবই আগামির অর্থনীতিকে মজবুত করার নিমিত্তে। এত সব আধুনিক বিনিয়োগ খাতের আড়ালে হারাতে বসেছে প্রাকৃতিক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা তথা নদী অর্থনীতি।
নতুন নতুন বিনিয়োগখাত অবশ্যই স্বাগত এবং আবশ্যকও। তবে স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ বান্ধব অর্থনীতিকে শক্তিশালী করলে কাঁচামাল, নির্মাণ ও উৎপাদন খরচ তুলনামূলক কম হয়। তাই কৃষি অর্থনীতিকে চাঙ্গা করাটা জরুরি। এজন্য কৃষির প্রাণ প্রদায়ক হিসেবে নদীতে বিনিয়োগ নিয়ে ভাবতে হবে সরকারকে। বস্তুত ভাবনা নয়, দেশের অর্থনীতির স্রোতকে গতিশীল রাখতে নদীতে বিনিয়োগ হোক রাষ্ট্রীয় আহবান। বিনিয়োগ হতে পারে সরকারি ও বেসরকারি। নদীর দূষণরোধে বিনিয়োগ, নদীর নাব্যতা রক্ষায় বিনিয়োগ রক্ষা করবে নদীকে ও প্রকৃতিকে। নদীতে বিনিয়োগে উৎসাহিত হবে নদী ভিত্তিক কৃষি ও সেচ ব্যবস্থাপনা, মৎস উৎপাদন, নৌকা-লঞ্চ পারাপার বাণিজ্য। নদীর রক্ষনাবেক্ষণ ও সৌন্দর্য বর্ধণে বিনিয়োগ পর্যটনকে দেবে ভিন্ন মাত্রা।
বাংলাদেশের মানচিত্রে অংকিত বিভাগগুলো মূলত নদী সংলগ্ন ও বেষ্টিত। নদীর প্রবাহ বৈশিষ্টেই এখানকার মাটি, কৃষি, মৎস, উৎপাদন, জনজীবন বৈশিষ্টময়। বিনিয়োগের মাধ্যমে আঞ্চলিক উৎপাদনকে নদীর সাথে সম্পর্কযুক্ত করতে হবে পুনরায়। তাতেই স্থানীয় অর্থনীতিতে আসবে সমৃদ্ধি।
**নদী নিয়ে অপরাপর ভাবনা-চিন্তা**