নারী কেন আত্মরক্ষক নয় হে রাষ্ট্র?

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 29 March 2016, 07:57 PM
Updated : 29 March 2016, 07:57 PM

তনুর ধর্ষকের বিচারের দাবিদারদের মধ্যে একজন আশীফ এন্তাজ রবি। সম্প্রতি তিনি  স্বর্ণরঙা চুড়ি পরিহিত তার হাতের ছবি ফেসবুকে প্রকাশ করে ধর্ষকের বিচারের দাবি নিয়ে উপস্থিত হয়েছেন। পরিচিতি অনেকেই সেই স্ট্যাটাসে লাইক দিয়েছেন বিধায় তার সেই বিশেষ আবেদনময়ী স্ট্যাটাসটি নজরে এলো। ততক্ষণে তিনি প্রায় ৩ হাজার লাইকপ্রাপ্ত হয়েছেন। তার স্ট্যাটাস শেয়ার হয়ে গেছে ততক্ষণে ১৩৫ বারেরও বেশি। আশীফ এন্তাজ রবি তার স্ট্যাটাসে একটি বিশেষ হ্যাশট্যাগও দিয়েছেন এবং তা হচ্ছে #আসুনচুড়িপরি। তিনি নিশ্চয়ই প্রত্যাশা করছেন এখন এই ছবি ভাইরাল হবে। ফেসবুকের দিকে চুড়িপরা হাতের ছবি দিয়ে ধর্ষকের বিচার প্রত্যাশা করবে সবাই। আশীফ এন্তাজ রবি অবশ্য পরবর্তীতে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে চেয়েছেন। ছেলেরা চুড়ি পড়ে না, তাই চুড়ি পড়লে নারীকে কী কী প্রকারে রক্ষা করা যায় তা নিয়ে কালজয়ী আলোচনার সূচনা হবে, এমন উদ্ভট প্রত্যাশা ফেসবুকে ছড়িয়ে দিতে পেরেছেন তিনি। আর বলিহারি যে, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে লাইক দিয়ে সামাজিক দায়িত্বটা সারছেন।
এ ধরনের ঠুনকো এবং উদ্ভট যুক্তি হয়তো ফেসবুকে অসংখ্য ফলোয়ারের ভরসাতেই দেওয়া সম্ভব হয়। হাতে চুড়ি পরার উপমা যুগে যুগে তাচ্ছিল্য প্রকাশেই ব্যবহৃত হয়েছে। পৌরষ্যকে অপমান করতে, দুর্বল পুরুষকে হেয় করতে হাতে চুড়ি পড়তে বলা হতো। পুরুষকে হাতে চুড়ি পড়তে বললে তার পৌরষ্যে লাগে। কারণ চুড়ি নারীর হাতে শোভা পায়। চুড়িপড়া নারী সমাজে শো-পিসের মতো। চুড়িপড়া নারী যুদ্ধের তালোয়ার চালাতে পারে না, সমাজ এমন বার্তা শিখিয়েছে যুগের পর যুগ। আশীফ এন্তাজ রবি পুরুষকে চুড়ি পরতে আহ্বান জানিয়ে যে আলোচনার সূত্রপাত করতে চান, তা আসলে সেই পশ্চাদপদ সামাজিক ধারণার প্রতিচ্ছবি। সমাজের এই দৈন্যতার কারণেই নারীরা সমাজে নিরাপদ হতে পারেনি। আত্মমর্যাদায় দাঁড়াতে পারেনি।
চার লাখ নারী নির্যাতনের জন্য পাকবাহিনী আর তাদের দোসরদের ক্ষমাহীন শাস্তি চাওয়ার কণ্ঠস্বর লজ্জিত হয়, যখন নিজভূমে একাত্তর পরবর্তীতেও নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা যায় না। একেক পরিসংখ্যানে নারী নির্যাতনের একেক হিসাব। সেটাও পূর্ণাঙ্গ চিত্র না। কারণ বিষয়টি পুলিশ বা হাসপাতাল পর্যন্ত গিয়ে সামাজিক হয়রানিকে আরও বাড়াবে।
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির পরিসংখ্যান বলছে, ২০১১ সালে ৬২০ জন, ২০১২ সালে ৮৩৬ জন, ২০১৩ সালে ৭১৯ জন নারী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্যমতে, ২০১৪ সালের প্রথম ছয় মাসে ৪৩১টি ধর্ষণের ঘটনা চিহ্নিত হয়েছে এবং এর মধ্যে ৮২টি ছিল গণধর্ষণ অপরাধ। প্রতিবছরের ধর্ষণ চিত্রের পরিসংখ্যান থেকে স্পষ্ট যে ধর্ষণের ঘটনা বাড়ছে। কোনও কোনও সূত্রমতে  পুলিশি খাতায় ২০১৪ সালে ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ৪৬৪২টি এবং ২০১৩ সালে ধর্ষণ মামলার সংখ্যা ছিল ৪৫৩৮টি।

প্রকৃত সংখ্যাটা যদিও বেশি হবে। তবে ধরা যাক, স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশে আজ পর্যন্ত প্রতিবছর ১০০০ জন ধর্ষিত হয়েছে। তাহলে গণিতের হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশে ৪৫ বছরে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৪৫ হাজার নারী। এজন্যই কি দেশ স্বাধীন হয়েছিল?

ধর্ষক পরিমলের বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন গড়ে উঠেছিল। সেই পরিমলকে একবার টিভি খবরে এক ঝলক দেখলাম। শরীর-স্বাস্থ্য আর পোশাকে পরিপাটি পরিমলকে দেখে মনে হলো- হাজতে পরিমল ভালোই আছেন। এমন 'দৃষ্টান্তমূলক' সাজাই কি আমরা চাই ধর্ষকের জন্য?

কিছু প্রচার-প্রচারণা থাকায় এখন পুলিশি রেকর্ড মেলে ধর্ষণ অভিযোগের। কিন্তু অধিকাংশ মামলাই পুলিশি দ্বায়িত্বহীনতায় আসামিদের পক্ষে চলে যায় বলে অভিযোগ রয়েছে। মিডিয়া ব্রেকিংনিউজ প্রতিযোগিতার আর সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং জগতের টক অব দ্য টাউন হয়ে ওঠার দৌড়ে অনেক ধর্ষণ ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিবাদ-সমাবেশ আর কলাম লেখার জোয়ার জাগে সময় সময়। উত্তেজনা স্তিমিত হতে হতে আরেক নারী ধর্ষিত হন। এভাবে আন্দোলন-সমাবেশ রুটিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবছরই নারী ধর্ষণের প্রতিবাদে শহীদ মিনার থেকে দেশজুড়ে প্রজ্বলিত মোম হাতে নারীর নিরাপত্তার শপথ করা হয়। কিন্তু তাতে নারীর জগত খুব আলোকিত হয় না। আর তাই শপথের মোম শিখা নিভে যেতেই আরেকটি ধর্ষণ ঘটনা।

অনেকে আবার সামাজিক যোগযোগ মাধ্যমগুলোতে নারীকে ছুরি, লাল মরিচ সঙ্গে রাখতে বলেন। এগুলো আসলে কীভাবে কার্যকরি হতে পারে নারীর জন্য? যে নারীকে সমাজ মানসিকভাবে দুর্বল করে গড়ে তোলে, সেই নারীকি সঙ্গে থাকা ছুরি দিয়ে আক্রমণকারীকে ভয় দেখাতে পারে? অনেকে শেখাচ্ছেন- ধর্ষকের গোপনাঙ্গ বরারব লাথি চালাতে। আমাদের সমাজের নারীরা যেখানে চৌকাট পা মাড়াতে সংকোচ বোধ করে, সেখানে কী করে ধর্ষকের গোপনাঙ্গ বরাবর পা চালাতে পারবে? নারীর যদি সেই মানসিক শক্তিমত্তা থাকতো তাহলে এতদিন কেবল ধর্ষিত নারীর হয়ে প্রতিবাদ সমাবেশ হতো না, বরং ধর্ষণে উদ্যত ধর্ষককে শায়েস্তা করে পুলিশে ধরিয়ে দেওয়া নারীকে বীরোচিত সম্মাননা দেওয়ার সমাবেশ হতো।

আর সমাজকেই নারীর নিরাপত্তা দিতে হবে নাকি! সমাজ মানে পুরুষ। সমাজ মানে রাষ্ট্র। সমাজ মানে আইন। প্রতিটি ক্ষেত্র ইতিমধ্যে ব্যর্থ এবং নিজ নিজ বিশ্বাসযোগ্যতাও হারিয়েছে। পশ্চাদপদ ধারণামুক্ত নয় তথাকথিত প্রগতিশীল সমাজও। তারাও যারা তনুর হয়ে ধর্ষকের শাস্তির জন্য জমিয়ে আন্দোলন করছে। কাছে থেকে দেখলে জানা যাবে এদের অনেকেই স্ত্রী-বাচক গালির তুবড়ি ছোটাতে পারেন। মুখে-মুখে নারীকে নিত্য অসম্মানের  বস্তুতে পরিণত করা হয় যেখানে, সেখানে নারীর জন্য সম্মান খোঁজা অরণ্যে রোদন। নারী অবমাননাকারী হেফাজতের আল্লামা শফীর বিরুদ্ধে কোনও নারী অধিকার সংগঠন থেকে মামলা হয়নি, এ বিষয়টিও ভুলে গেলে চলবে না।

বেগম রোকেয়ার নারী স্বাধীনতা দর্শন এবং নারী দিবসের মাহাত্ম- না নারী বুঝতে পেরেছে, না সমাজ, না রাষ্ট্র বুঝতে পেরেছে। যদি বুঝতে সক্ষম হতো তবে নারীর প্রথম রক্ষাকারী হিসেবে দাঁড়াতো নারীই। ধর্ষককে ঠেকাতে পারতো আক্রান্ত নারীই। আত্মরক্ষক হয়ে ওঠার মন্ত্র কি শেখাতে পেরেছে রাষ্ট্র নারীকে? সামাজিক সচেতনতা একটি দীর্ঘমেয়াদী এবং উন্মুক্ত পদ্ধতি। তাই সরকারকে কিছু কাঠামো তৈরি করে দিতে হয়। এতে করে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত হয়। আমরা একটা অরক্ষিত সমাজে নারীকে নারী স্বাধীনতা শেখাই নারীকে প্রস্তুত হতে না দিয়েই।

পাঁচ-ছয় বছর আগেও পত্রিকায় নারী সুরক্ষার কথা লিখেছি। এখনও একই কথা লিখে চলাটা বেদনাদায়ক। তাতে অসহায়ত্ব চেপে ধরে পরিস্থিতির সামগ্রিক উন্নতি উপলব্ধি না করতে পেরে। বিস্ময়টা বহু বছর আগেও ছিল, এখনও আছে। নারীকে রাষ্ট্র কেন স্বাবলম্বী হতে শেখায় না? কেবল অর্থনৈতিক স্বাবলম্বী নয়, মানসিক স্বাবলম্বী এবং আত্মরক্ষার্থে শারীরিকভাবে সামর্থবান হয়ে ওঠা নারীর জন্য আবশ্যক। ফেসবুকে অনেকে কারাতের টিপস দেয়, এসব আসলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের সামাজিক দায়বদ্ধতার ফ্যান্টাসি চর্চা। যতক্ষণ ঘটনা তাজা থাকে, ততক্ষণই এসব।

বস্তুত নারীকে সামগ্রিকভাবে আত্মরক্ষার কলাকৌশলগুলো কাঠামোগতভাবে শিক্ষা দেওয়া দরকার। পারিবারিকভাবে নারীকে কারাতে-জুডো শিক্ষা দেওয়ার আহ্বান জানানো যেতে পারে। কিন্তু তাতে সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা কখনওই সম্ভব হবে না। বরং সরকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোর পাঠ্যসূচিতে শরীরচর্চা আবশ্যিক করে তাতে নারীর জন্য আত্মরক্ষামূলক কৌশল শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করে দিতে পারে অবিলম্বে।

বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু স্কুলে, কলেজে ও বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন কারাতে শিক্ষার সুযোগ রয়েছে। এগুলো অধিকাংশই ব্যক্তিগত উদ্যোগ। ফলে সীমিত অংশগ্রহণ এবং সীমিত প্রচার। এ কারণেই রাষ্ট্রীয়ভাবে নারী শিক্ষার্থীদের জন্য যেকোনও পর্যায়ের শিক্ষা মাধ্যমে আত্মরক্ষামূলক শরীরচর্চা কোর্স চালু করা জরুরি। রাষ্ট্রীয়ভাবে এ পরিকল্পনার বাস্তবায়নের সুবিধা হলো এতে সকল নারী শিক্ষার্থীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে, পরিবারের মর্জির নির্ভরতা কেটে যাবে এবং সামগ্রিকভাবে সচেতনতা গড়ে উঠবে।

মোম জ্বালিয়ে সমাবেশ করে নারীকে আসলে রক্ষা করার যাচ্ছে না, এ সত্য মেনে নিতে হবে। প্রতিবাদ সমাবেশ থেকে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে অপরাধীর বিচার করার দৃষ্টান্তও খুব যথাযথ নয়। তার অর্থ আইন পরিচালনাকারীরা আন্তরিক নন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত। নারীকে রক্ষায় মোমবাতি প্রজ্বলনের চেয়ে নারীকে আত্মরক্ষায় স্বাবলম্বীরূপে গড়তে সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ না হলে নারীর সঙ্গে ক্রমাগত হয়ে চলা এই অপরাধের দায় বরাবরই রাষ্ট্রকে নিতে হবে।