জংলা রাজবাড়ি, শুষ্ক নদী আর নড়বড়ে সেতুর রাণীশংকৈল

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 18 Nov 2016, 12:23 PM
Updated : 18 Nov 2016, 12:23 PM

ঠাকুরগাঁও জেলার বিভিন্ন উপজেলাগুলি কালের সাক্ষীর মত ঐহিত্য আর প্রকৃতিকে ধারণ করে আছে। প্রকৃতিই যতটুকু পারছে রোদেবৃষ্টিতে ধরে রাখছে, মানুষের যত্নের ছাপ কম। এদিকে সড়কের অবস্থা ভাল। বলা চলে ঢাকার চেয়েও ভাল। ঢাকার মত অধিক সংখ্যক ভাড়ি যানবাহন চলেনা, তাই কিছু মেঠোপথ ছাড়া ঝাঁকিহীনভাবেই ঠাকুরগাঁওয়ের মসৃণ পিচের সড়কে যান্ত্রিক বাহনে চড়ে দু'চোখ ভরে দেখা যায় ধানি জমি, আখের ক্ষেত, কুচুরিপানা ভাসা হাওর, বেঁকে চলা নদী এবং আরো দূরে এপাড়-ওপাড়ের  সীমানা।

রাণীশংকৈল ঠাকুরগাঁওয়ের উপজেলা। উপজেলার নামে রাণীর প্রাধান্যতা থাকলেও বৃটিশ কালে গঠিত মালদুয়ার স্টেটের জমিদার ছিলেন টংকনাথ চৌধুরী। পরবর্তীতে তিনি রাজা উপাধি প্রাপ্ত হন। তাঁর সুন্দরী স্ত্রী জয়রমা শঙ্করী দেবী  ছিলেন রাণী শংকরী দেবী।  রাণী শংকরী দেবী থেকেই মালদুয়ার স্টেট হয়ে ওঠে 'রাণীশংকৈল'।

টংকনাথের বাসভবনকে কেউ রাণীশংকৈল জমিদারবাড়ি আবার কেউ রাজবাড়ি নামে চেনে। কুলিক নদী সংলগ্ন রাজবাড়িটি আজো রাজা টংকনাথ চৌধুরী নামকে মুখে মুখে উচ্চারিত করলেও রাণী শংকরী দেবীর কথা রাণীশংকৈল ভ্রমণকারীদের অনেকের জানা হয়না। তাই শুষ্ক কুলিক নদীর কাদা-পানিতে পা মেখেও অনেকে হয়ত জানেননা এ নদীতে নাকি এক কালে রাণী শংকরী দেবী স্নান করতেন! কুলিক নদীর শুকনো রূপে ভরা নদীর স্রোত যেমন এখন অলিক গল্প, তেমনি রাণীশংকৈলে বিস্মৃত হওয়ার প্রান্তে রাজা টংকনাথ চৌধুরীর রাজবাড়ি।

প্রধান সড়ক ছেড়ে কুলিক নদী সংলগ্ন ভেতরের পথ ধরে এগুলো গ্রামের মাঝে আবিষ্কৃত হবে পরিত্যাক্ত রাজবাড়ি। জংলা রাজবাড়ি নিয়ে শোনা যাবে সাবধান বাণী -ওদিকে সাপ আছে! মূল রাজবাড়ির কাছাকাছি আরো কিছু ইটের ঘর দেখা যাবে ভগ্ন দশায়। সাপের ভয় হার মানবে পুরনো রাজবাড়ির বাতাসে ভেসে আসা অদৃশ্য হাতছানিতে। মোহগ্রস্ত পদযুগল নিয়ে রাজবাড়ির বারান্দায় উঠতেই নাকে আসবে বোটকা গন্ধ। পুরনো ইট অনেক খানে চমক দেখালেও অধিকাংশ দেয়াল শ্যাওলা জমে কালচে। দেয়াল ফুঁড়ে জন্মানো জংলা ঘাস-গাছ যেন রাজবাড়িকে কব্জা করতে ছেয়ে যাচ্ছে। রাজবাড়ির মাঝখানে চারকোনা জমিতেও পুরো রাজবাড়ির মতই  জঙ্গলা গাছে পূর্ণ। চারকোণা জমিটি হয়ত বাগান ছিল অথবা উঠান। এর চারদিক ঘিরেই দোতলা বাজবাড়ি। ৩৬০ কোণে ঘুরতে ঘুরতে মনে হবে কী গমগমেই না ছিল এখানটা এক কালে। গম্বুজ নকশার খিড়কি আর দুয়ার দেখতে দেখতে মনে হবে কী আলিশানই না ছিল এই রাজবাড়ি!

বাস্তবতা হচ্ছে এখন রাজবাড়ি পরিচর্যাহীন ইটের ভুতুড়ে বাড়ি। যা সাপের আখড়া। সাপ হয়ত খোলস ছাড়তে জংলা ঘরের কোণকেই বেছে নেয়। তারপরও কিছু দেয়ালে আঁকিবুকি দেখো বোঝা যায়, অনেকের প্রকৃতির ডাক সারবার প্রিয় স্থান এই রাজবাড়ি। অনেকের মলত্যাগের জায়গা। এতকিছুর মাঝেও একজন যুবককে, স্থানীয়ই হবে, ভেতরের বারান্দায় বসে ধূমপানে মগ্ন দেখা যাচ্ছিল। শুধুই ধূমপান? নাকি এই রাজবাড়ি গাঁজা খাওয়ারও কেন্দ্র হয়ে উঠেছে?

রাজবাড়ির দোতালায় যাওয়ার সিঁড়ি নেই। নীচের বারান্দা থেকে উপরে তাকালে দোতালায় কেবল বারান্দার কংকাল চোখে পড়ে। এই রাজবাড়ি নেহায়েত পোক্ত গাঁথুনির বলেই এখনো এত এত হেলাফেলার চিহ্ন ধারণকরেও দাঁড়িয়ে আছে। অথচ এই রাজবাড়িতে সংরক্ষণ করে পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা যায় সহজেই। এই রাজবাড়ির মূল অবকাঠামো ঠিক রেখে একে এখনই মেরামত করে রাণীশংকৈলের ইতিহাস জাদুঘরও করা যেতে পারে। সংস্কার করা হলে কেবল জাদুঘর ছাড়াও এখানে ছোটখাট পাঠাগার গড়ে রাণীশংকৈলের উপর যাবতীয় গবেষণা ও অপরাপর গ্রন্থ রাখা যেতে পারে।

রাজবাড়ির সংস্কারের উছিলায় হয়ত প্রশাসনের নজর সংলগ্ন কুলিক নদীতেও পড়তে পারে। কুলিক নদী একমাত্র নদী যা বাংলাদেশ থেকে ভারতে প্রবেশ করেছে। এখন সেই কুলিক নদীর বুকে উঁচু উচু ছনের গাছ। নদী ভরা জল থাকলে অবশ্য তা উপভোগ্য দৃশ্য হতো। কিন্তু কুলিক নদীতে এখন জমির সরু সরু আইল। পানিতে নেমে পড়লে হাঁটু পানিও নেই। কোন কোন অংশে গোড়ালিও ডোবে না। কেবল নামেই নদী কুলিক এখন চাষাবাদী জমি হয়ে উঠছে।  আবাদি জমিকে রক্ষার্থে সেচের জন্য নদী প্রয়োজন, তবে নদীতেই আবাদ শংকার বার্তা দেয়।  কুলিক নদী রক্ষায় জনপ্রতিনিধিরা কি এগিয়ে আসবেন না?

কাচাপাকা পথের পাশে কুলিক নদীতে নামতে একটি ভগ্ন ঘাট রয়েছে। কয়েক ধাপ সিঁড়িও টিকে আছে। বোঝা যায় রাজা টংকনাথের আমলের ঘাট। এই ঘাটকে রাজবাড়ি সংরক্ষণ প্রকল্পের আওতায় মেরামত করে রাখা খুব বেশি খরচ সাপেক্ষ হবে না প্রশাসনের জন্য।

কুলিক নদীর আর গ্রাম সংলগ্ন পথ পাড় হয়ে প্রধান সড়কে উঠলে একটি ছোট সেতু। একে কুলিক নদীর সেতু নামেই চেনে সকলে। সেতুর উপর থেকে দু'পাশে দেখা যায় ‍কুলিক নদী। অবশ্য নদী কম, দেখা যায় কুলিক নদীর বুকে বিস্তৃত আবাদি জমি। দেখা যায় নদীর সাথে জীবনের সম্পৃক্ততা। কেউ কাদাপানিতে মাছ খোঁজার চেষ্টারত। কেউ পানিতে বাঁশ ধুয়ে নিচ্ছে। সেতু থেকে শুষ্ক নদী দেখতে দেখতে হঠাৎ চমকে যেতে হবে ভূমিকম্পের ভয়ে! চোখে বোঝা না গেলেও সেতু দুলছে; উপরে-নীচে।

কুলিক নদীর উপরের সেতুটি দিয়ে স্থানীয়দের চলাচল নিয়মিত। এখান দিয়ে সাইকেল বালক-বালিকারা আসাযাওয়া করে। ব্যাটারি চালিত অটোগুলো যাত্রী আনানেওয়া করে।  ভারী যান স্বল্প সময়ের মধ্যে ঘন ঘন চলাচল না করলেও মাঝারি ট্রাক চলে। যে কোন যানের চলাচলেই দুলে উঠছে সেতু। এই দুলুনি অনুভবে সেতুর স্থায়ীত্ব নিয়ে শংকা জাগে। সেতুটি দ্রুত পরীক্ষা করে দেখা জরুরি। সেতুটি কতটা ভার সহনশীল এবং চলাচলের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ কিনা তা সত্বর নির্ণয় করার আবেদন থাকছে প্রশাসনের কাছে।

প্রধান সড়ক যেহেতু চলাচল উপযোগী, তাই মানুষের পদচারণার সম্ভাবনা বাড়বেই। এই সম্ভাবনা সামাজিকতায়, বাণিজ্যে, যোগাযোগে, ভ্রমণে, প্রকৃতিতে প্রভাব ফেলবে এবং প্রভাব ফেলবে স্থানীয় অর্থনীতিতেও। সম্ভাবনাগুলো যেন উদ্যোগ ও সমন্বয়হীনতায় বিনষ্ট না হয়, তাই জনপ্রতিনিধিদের এগিয়ে আসতে হবে। তড়িৎ হতে হবে প্রশাসনকে। রাণীশংকৈলের মত প্রাকৃতিক ও ঐতিহাসিক সমৃদ্ধ অঞ্চলের এই সংকটগুলো সারিয়ে তুললে প্রান্তিক এই অঞ্চলটি এর ঐতিহ্য নিয়ে আরো বিকশিত হবে।