বর্তমান যন্ত্রটিতে বিদ্রোহী স্ফ্রুলিঙ্গ দেখা যাচ্ছে মাঝে মাঝে। রন্ধনশালায় পাঁচনে সম্ভাব্য 'ব্লুন্ডার' ঘটার পূর্বেই একটা ব্লেন্ডার মেশিন অনিবার্য হয়ে উঠেছে। বাণিজ্য মেলা যেহেতু শুরু হয়েই গিয়েছে, ভাবলাম এটাই বিকিকিনি করার উপযুক্ত স্থান ও সময়। সুতরাং শুক্রবারে মধ্যবেলা থেকে এই যাচ্ছি-এই উঠছি-এই যাবো প্রকারের আলসেমি করতে করতে পৌণে তিনটে নাগাদ শুভযাত্রা করেই ফেললাম।
যারা মিরপুর-আগারগাও মূল সড়ক দিয়ে বাণিজ্য মেলায় যাবেন, তারা শুরুতেই জ্যামের মুখোমুখি হবেন এবং বেশ কিছুটা হেঁটে মেলার প্রধান ফটকের সামনে পৌঁছবেন। সিএনজিওয়ালা আসা-যাওয়ার সমস্যাটা জানতেন বিধায় তিনি বাহনটিকে ওদিক দিয়ে না এনে পেছনের দিক থেকে আনেন। একটা বড় গেইট দেখেও যখন সিএনজিওয়ালা না থেকে এগুচ্ছেন, বললাম, এই গেইট না? তিনি বললেন, এটা দিয়েও বোধহয় ঢোকা যায়, কিন্তু আপনে এলাকার মানুষ, হাঁটবেন ক্যান? আপনেরে আসল গেইটের কাছে পর্যন্ত নিয়া আসলাম তাই। আমরা তো জানি, গাড়ি এইখানে কেমনে আসা-যাওয়া করে। সামনে দিয়া আসলে খামাখা হাইট্টা আসতে হইতো!
আমার তখন এলাকার মানুষ হওয়ার বিরাট ভাব জেগে উঠলো। সিএনজিওয়ালাকে থ্যাংকু দিয়ে নামলাম। মুখোমুখি হলাম চিরচেনা বিরাট-বিশাল সেই ফটকের। টিকেট কাটতে হবে, তা অবশ্য ভুলিনি। দেখলাম অনেকগুলো টিকেট কাউন্টার। লাইন দীর্ঘ নয়। যাওয়া মাত্রই টিকেট পাওয়া গেল। কেন যেন ধারণা ছিল, টিকেট ১৫ টাকা। কিন্তু টিকেট আসলে ৩০ টাকা করে।
লাইন ধরে, নিরাপত্তাবাহিনীর প্রহরার মধ্য দিয়ে ছুটির দিনে মেলার দর্শনার্থীরা একে একে ঢুকছেন। আমি লাইন ধরার বিষয়টা একটু গুলিয়ে ফেললেও নিরাপত্তাকর্মীদের একজন সহযোগীতা করে প্রবেশ সহজ করে দিলেন।
মেলার ভেতরে আন্তর্জাতিক আবহ স্পষ্ট হোক বা না হোক, বাইরে বিভিন্ন দেশের পতাকা উড়ে উড়ে বলছে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলা।
ফেসবুকে অন্যরকম বিজ্ঞানবাক্স পেইজটা দেখেছিলাম। আগ্রহটা ছিল। মেলায় ঢুকে একদিক থেকে এগুতেই চোখে পড়লো স্টলটা। ভিড় বেশ স্টলে। বিভিন্ন রকম বাক্সে একসেট সরঞ্জামাদি। বয়সভেদে বিভিন্ন সেট বা বাক্স। দামটা একটু বেশি। যেমন কোনো বাক্ম ৮০০ টাকার বেশি। কোনো বাক্স ১০০০ টাকার মত। বাক্সে ডিভিডি রয়েছে, মুদ্রিত সহায়িকাও রয়েছে কোনটা কীভাবে ব্যবহার করতে হয় জানাতে। স্কুলের বাচ্চাদের বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত করতে, উপহার দিতে এরকম বিজ্ঞানবাক্স একটি অনন্য উদ্যোগ। আমাদের এখানে শিশুতোষ উপকরণের অভাব রয়েছে। বিনিয়োগ কম। সেখানে বাণিজ্য মেলায় এমন একটি স্টল খুব ইতিবাচক।
প্রতিবছর এই অফারটা থাকে মূলত হোম অ্যাপ্লায়েন্সের স্টলগুলোতে। ওভেন, ইলেকট্রিক চুলা এ ধরনের জিনিসের জন্য লোভনীয় অফার লেখা থাকে – ১টি কিনলে ১০টি আইটেম ফ্রি! ফ্রি এর লোভে ভিড় ভালই হয় এসব স্টলে।
মুরগীর খাঁচাগুলোর এমন ছোট সংস্করণে অলংকার ঝুলিয়ে রাখার বিষয়টি দৃষ্টি কাড়লো এবার।
মাসাককালি, বেবি ডল এসব পোশাক নিয়ে অনেক হৈ চৈ এবং সমালোচনা ছিল। কিন্তু মাত্র ১৩০০ টাকায় মোদি ফ্যাশন মনে হয় এখনো অনেকের দৃষ্টি অগোচরে রয়ে গেছে।
পুনরায় ঠাণ্ডা-জ্বর বাধানো এড়াতে চাইলাম, নইলে কুলফির লোভ সামলানো মুশকিল। এলসন ফুড এবারই কুলফি প্রডাক্ট নিয়ে এসেছে বাণিজ্য মেলায়।
আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় সব ধরণের বাণিজ্য পণ্য থাকাটাই এর সার্বজনীনতাকে প্রকাশ করে। সুতরাং ভাগ্যের রত্ন নিয়ে যে বাণিজ্য, তা কেন বাদ যাবে?
ছবির বাইরেও মেলায় আরো বেশ কিছু স্টল ঘুরে ফিরে ভালো লেগেছে। পাটপণ্যের স্টলে রপ্তানিযোগ্য বিভিন্ন পণ্য ছিল। দাম খুব কম না, আবার কোনো কোনোটার অনেক বেশিও না। হ্যান্ডব্যাগের প্রতি আমার দুর্দমনীয় আকর্ষণ। পাটের/চটের তৈরীর মেয়ের হ্যান্ডব্যাগগুলো দারুণ লেগেছিল। পাপোশ বা কিছু ফ্লোরম্যাটও বিক্রি হচ্ছিল সস্তায়। সব অবশ্য পাটের নয়, কিছু ছিল গেঞ্জি কাপড়ের টুকরো দিয়ে তৈরী, ২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছিল।
মেলায় জিনিসপত্রের দাম খুব একটা কম ছিল বলে মনে হয়নি। যদিও কিছু কিছু দোকান দেখাচ্ছিল, তারা ১০০ টাকা করে কম রাখছে মেলা উপলক্ষ্যে। তবে কম রাখুক আর নাই রাখুন, মেলায় দামাদামি করার সুযোগ কম দিচ্ছে বিক্রেতারা। দু'টো শীতের রেশমী-পশমি শালে মাত্র ১০০ টাকা কম!
ভেজিটেবল কাটার নিয়ে কিছু স্টল বরাবরের মতই মজাদার। একটানা মাইকিং চলে এবং দ্রুত হাতে চলে গাজর, বাঁধাকপি কাটাকাটি। ইরানি মশলা নিয়ে বসেছিল একটি দোকান। ৩০০ টাকায় এক জার ইরানি জিরা। হাতে ঘষে ঘসে সবার নাকের কাছে নিয়ে জিরার সুঘ্রাণে ক্রেতা আকৃষ্ট করছে বিক্রেতা। আরো আছে! ইরানি দারুচিনি ১০০ টাকা। ইরানি এলাচি ২০০ টাকা!
প্রতিবার মেলায় বিরিয়ানির স্টলে খাবারের দাম অতিরিক্ত রাখা নিয়ে বিরক্তি প্রকাশ করেন দর্শনার্থীরা। হাজী বিরিয়ানির স্টল এবার রয়েছে মেলায়। এছাড়াও আরো বেশি কিছু স্টল।
নাবিস্কো প্যাভিলিয়নে গিয়ে নস্টালজিক হয়ে যাই নাবিস্কোর গোলাপী রঙের বিস্কুটের প্যাকেট দেখে। মেলা ছাড়া এমনিতে দোকানে চোকে পড়ে না। দাম জিগেষ করলাম। দোকানি বলল ১০ টাকা। এই গোলাপী রঙের প্যাকেট অনেককেই নস্টালজিক করবে। সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ১০ টাকায় এক প্যাকেট বিস্কুট পাওয়া যায় শুনে আপ্লুত হয়ে পাঁচ প্যাকেট কিনে ফেললাম। পোস্টটা লিখতে লিখতে একটা প্যাকেট সাবাড়ও।
তবে বাণিজ্য মেলা নিয়ে আর সামান্য একটু বলতেই হয়। সকল মেলা জমলো কিনা সেটা নিয়ে বরাবর পত্রিকার খবর হয়। টিভি সংবাদেও দেখানো হয় মেলা কতটুকু জমলো। কিন্তু একটি বানিজ্য মেলা আসলে কীভাবে জমে? অপরদিকে এই মেলাটি আসলে কতটুকু আন্তর্জাতিক তাও তো মেপে দেখা জরুরি। ইরানি মেলামাইন-মশলা-বোরকা, ভারতীয় শাল, পাকিস্তানি ওড়না, হংকংয়ের ইমিটেশন গহনা থাকলেই কি মেলা আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠে? কেবল দর্শনার্থীদের কাছে বেচাবিক্রিতেই কি একটি বাণিজ্যমেলার জমে ওঠা বিচার করা যায়?
বাণিজ্যমেলার অবকাঠামো এবং বাণিজ্যিক দিক নিয়ে একটি সুষ্ঠু পরিকল্পনা এই মেলার আন্তর্জাতিক হয়ে ওঠাকে সুনিশ্চিত করতে প্রকৃত অর্থে।
পুনশ্চঃ ব্লেন্ডার মেশিন মেলা থেকে কেনা হয়নি শেষ পর্যন্ত।