পুনরুদ্ধৃত হোক ঠাকুরগাঁও চিনিকলের বিস্মৃত স্লোগান আর মলিন ফলক এবং ঠাকুরগাঁও পৌরসভা মেয়রের ’প্রতিশ্রুতি’

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 15 July 2017, 07:12 PM
Updated : 15 July 2017, 07:12 PM

ঠাকুরগাঁও চিনিকলের জন্য বিখ্যাত। এক সময় বিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচিতে জেলা পরিচিতিতে ঠাকুরগাঁও সম্পর্কে উল্লেখযোগ্য হিসেবে এমনটা লেখা থাকতো। মাননীয় শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমুর এক বক্তব্যের সূত্রে জানা যায়, শিল্প মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীন বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের অধীনে মোট ১৫টি চিনিকল রয়েছে। এর বাইরে বেসরকারি ২টি চিনিকলও রয়েছে। ঠাকুরগাঁও চিনিকলকে বাংলাদেশের অন্যতম চিনিকল বলা যায়।  ১৯৫৬ সালে নির্মাণ কাজ শুরু হওয়া, ১৯৫৮ সালে সমাপ্ত হওয় এবং ১৯৫৮-৫৯ সাল থেকে চিনি উৎপাদন করা এই প্রতিষ্ঠানটি সরকারি ভাবে ঠাকুরগাঁওয়ের  বড় বাণিজ্যিক শিল্প হিসেবে পরিচিত।

ঠাকুরগাঁও চিনিকল এর প্রাতিষ্ঠানিক নাম মূলত ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লিমিটেড। এখন পর্যন্ত অসংখ্য জটিলতার মুখোমুখি হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। বহুবার চালু হয়েছে। বহুবার বন্ধ হয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। এমনকি গত কয়েক বছরেও অব্যাহত ছিল এই সংকট। তবে এই প্রতিষ্ঠানটির চেহারা ফেরাতে ২০১৬ সালে একনেকে ৪১১ কোটি ১০ লাখ টাকার অনুমোদন হয়। প্রত্যাশা প্রতিষ্ঠানটিকে লাভজনক করা।

জুলাই ২০১৬। বিচ্ছু বাহিনীর সাথে সুগার মিল প্রাঙ্গনে ঘুরতে গিয়েছিলাম। সুবিশাল প্রাঙ্গন।  দিনটা ছুটির দিন ছিল বলে মানুষের কর্মচাঞ্চল্য কম ছিল। তাছাড়া মূল কারখানা এ সময় বন্ধ থাকে। নভেম্বর-ডিসেম্বর কি জানুয়ারির দিকে কারাখানার কাজ হয়। এর পূর্বে  ঠাকুরগাঁও তো বটেই উত্তরবঙ্গের ভেতর দিয়ে গেলে আখের ক্ষেত চোখে পড়বে ঘন ঘন। সুগার মিল প্রাঙ্গনেও আখ গুচ্ছের সারি দেখলাম। তবে তা গবেষণার অংশ।

মিলের ভেতর বেশ সবুজ। সরু রাস্তা। মাঠ। হাঁটতে-ঘুরতে দারুণ লাগবে। কারখানা ছাড়াও এখানে আবাসিক রয়েছে। রয়েছে কৃষি বিভাগ। প্রশাসনিক ভবন।  প্রশাসনিক ভবনের বেড়ার বাইরে ঘাসের মাঝে পুরনো জং ধরা মেশিন পড়ে থাকতে দেখা গেল। একেবারে হেলায় ফেলে না রেখে, এগুলোকে সামান্য বিবরণ ‍জুড়ে একটু জাদুঘরের মত বা প্রদর্শনীর মত করে রাখলে তা মিলের সৌন্দর্যই বাড়াতো।

প্রশাসনিক ভবনের সামনেই জঙ্গল আর ঘাসের মাঝে প্রায় চোখেই পড়েনা একটা ফলন খুঁজে পেলাম। লম্বা ঘাস ছাড়িয়ে দেখা গেল ওতে কিছু লেখাও রয়েছে। কিছু কিছু অক্ষর একদম মলিন হলেও তা বুঝে নেয়া যায় এবং তিন লাইনের লেখাটা সহজ পাঠ ছিল। আমরা দেখলাম এটি একটি স্লোগান –

বেশী আখ বেশী চিনি
তোমার আমার
সোনার খনি।

স্লোগানটি কবেকার বা ফলকটি কবে কার তা তাৎক্ষণিক জানার সুযোগ হলো না। তবে বোঝা যাচ্ছিল, এই স্লোগান নিশ্চয়ই সুগার মিলটির সুদিন কালের। জং ধরা ফলকটি এও বুঝিয়ে দিচ্ছিল, সুগার মিলটির দুর্দিনের কথা।

প্রবেশের সময় খেয়াল না করলেও কারখানা ভবনের আশেপাশে ঘুরতে গিয়ে নজরে এলো একটি বড় সাইনবোর্ড। আকারে বড় সাইনবোর্ডের স্ট্যান্ডটি পুরনো এবং বাঁকা হয়ে গেছে। মনে হলো একই সাইনবোর্ড লেখার জন্য জন্য একাধিকবার ব্যবহার হয়েছে। কারণ পূর্বের লেখা ঠিকমত না মুছে তার উপর পুনরায় লেখা চোখে পড়ছিল। এই সাইনবোর্ডটি কবেকার তাও বোধগম্য হচ্ছিল না। তবে এও সুগার মিলের পড়তি দশার দিকের হতে পারে সেটা স্লোগান দেখেই বোঝা গেল। এমনকি পড়তি দশার কারণও বোঝা যায় লেখা থেকে। মাত্র তিন লাইনের স্লোগানে উত্তরোনের উপায়ও বলা ছিল। সাইনবোর্ডে লেখায় সুগারমিলের দিকে দৃষ্টি ফেরানোর আকৃতি ছিল। লেখা ছিল –

বাড়ল আবার আখের দাম
আখের আবাদ বাড়ান
ঠাকুরগাঁও সুগারমিলকে বাঁচান।

স্পষ্ট নয় তবু শেষের লেখাটা ধারণা করা যায় – প্রচারে: ইক্ষু বিভাগ, ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস লি:

জুন ২০১৭। ঠাকুরগাঁও পৌরসভা লেখা ফটক পেরিয়ে বসে আছি পৌরসভা মেয়র মির্জা ফয়সল আমীনের কক্ষে। মূল ছিল নগর নাব্য-মেয়র সমীপেষু মেয়রের হাতে তুলে দেয়া এবং সেই সাথে কিছু প্রশ্ন। সাথে ছিলেন আমাদের ব্লগ ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডট কমের প্রিয়মুখে আবুল কাশেম। আমাদের সাথে যোগ দিয়েছিলেন ঠাকুরগাঁও এর সমাজকর্মী এবং কবি জালাল উদ্দীন। আরো ছিলেন হ্যালোর শিশু সাংবাদিক রহিম শুভ এবং ঠাকুরগাঁওয়ের তরুণ সাংবাদিক শাকিল আহমেদ।

নাগরিক সাংবাদিক প্রশ্নপর্বে মেয়রকে বিভিন্ন প্রশ্নের সুযোগে ঠাকুরগাঁও সুগার মিলস নিয়েও প্রশ্ন করার সুযোগ হয়েছিল। মেয়রকে জানানো সুযোগ হয়েছিল দুটো স্লোগানই। সেই সাথে নাগরিক দৃষ্টিকোণ থেকে দাবি ছিল ঠাকুরগাঁও সুগার মিলের এই পুরনো স্লোগানগুলো পুনরায় জনপ্রিয় করা যায় কিনা এবং জঙ্গলে ঢেকে যাওয়া ফলক পুনরুদ্ধার করা যায় কিনা? মেয়র বিষয়টি নিয়ে  ইতিবাচক মত দেন। তিনি বলেন,

"… আমি বুঝতে পেরেছি প্রশ্নটি। আমি প্রথমেই একটি বিষয় অবগত করতে চাই সুগার মিল কিন্তু সম্পূর্ণ একটি  অটোনোমাস প্রতিষ্ঠান। এটি সম্পূর্ণভাবে একটি স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান। এখানে  পৌরসভার বা সরকারের বা কারোরই হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই। যতটুকু জায়গা মিলে সুগারমিল, তাদের মেইন ক্যাম্পাস, এর বাইরে সুগার মিলের অনেক জমি আছে, প্রায় হাজার হাজার একর সুগার মিলের জমি বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে আছে, যেখানে সুগারমিল কৃষকদের বন্টন করতো- তুমি এক বছর আখ চাষ করবে…।

(ছবি: শাকিল আহমেদ)

— আমি আপনার মতই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। আমি চাইবো  সুগার মিলের হারানো জৌসুল আর ঐহিত্য ফিরে আসুক। প্রতি বছরই আমরা পেপারপত্রপত্রিকা দেখি এবং বিভিন্ন গণমাধ্যমে অবলোকন করি যে সুগার মিল লস করছে। ব্যাপক চিনি এখানে মজুদ পড়ে থাকছে। চিনি কেনার ব্যবস্থা নেই। এ ব্যাপারে সরকারই হস্তক্ষেপ করতে হবে এবং সরকারই পারে সঠিকভাবে একে লাভজনক প্রতিষ্ঠান করতে। আর আপনি যেটা বললেন  আপনার কথার সাথে আমি একমত। আমি চেষ্টা করবো.. চেষ্টা করবো না আপনাকে আমি কথা দিতে পারি,  আমি সুগারমিলের যিনি জিএম আছেন, জেনারেল ম্যানেজার, পরিচালকও আছেন, পরিচালকের সাথে কথা বলবো। ফলকগুলোকে যেন আবার পুরনো জৌলুসে ফিরিয়ে আনা যায় সে ব্যাপারে আমরা একদম অফিসিয়ালি চিঠি দিয়ে জানাবো। আমি নাগরিক হিসেবে অন্তত …"।

ফলকের জৌলুস ফিরিয়ে আনলেই সুগারমিলের জৌসুল ফিরবে এমন নয়। তবে পুরনো স্লোগান, ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে পুরো মিল প্রাঙ্গনে প্রতিদিন প্রেরণা জোগাতে পারে। এই প্রেরণাই সুগারমিলকে বাঁচাতে সকল পরিকল্পনাকে বাস্তবায়িত হতে সহজ করবে।

নিশ্চয়ই কিছুদিনের মধ্যে জঙ্গল থেকে বেরিয়ে আসবে সেই স্লোগান ফলকটি। এবং স্পষ্ট হয়ে উঠবে মলিন স্লোগান লেখা মলিন সাইনবোর্ডটি। ঠাকুরগাঁও পৌরসভা মেয়র মির্জা ফয়সল আমীন প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন অফিসিয়ালি তিনি এ বিষয়ে ‍উদ্যোগি হবেন। এই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখবেন এমনটাই আমরা নাগরিক সাংবাদিকরা বিশ্বাস করি।