ঠাকুরগাঁওয়ে বন্যা শেষে জীবনমুখী মানুষের সাথে

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 7 Sept 2017, 08:51 PM
Updated : 7 Sept 2017, 08:51 PM

পোক্ত গুড়ির আমগাছগুলোর গায়ে গায়ে মাটি মাটি দাগ জানান দিচ্ছে সম্প্রতি নেমে যাওয়া বেনো জলের গল্প। নাগর নদী পাশের গ্রামের মানুষগুলো জানে প্রতিবছর অতিবৃষ্টিতে উটকো বান এসে আকণ্ঠ ডুবিয়ে দিয়ে যাবে। ধসিয়ে দিয়ে যাবে মাটির ঘর। তবু তারা ফিরে আসে, পানি নামলেই। ঘর গোছাতে থাকে।

টিকেট নিয়ে হাহুতাশ করতে করতেই টিকেট হাতে অবিশ্বাস্য মুহূর্তকে দুচোখে আটকে ঠিকঠাক পৌঁছে গেলাম উত্তরবঙ্গ। পৌঁছাতে না পৌঁছাতে জানতে পারলাম হামার ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক ভাষা চর্চা পরিষদের পক্ষ থেকে বন্যার্তদের জন্য সহযোগীতা নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি চলছে। আমিও যুক্ত হয়ে গেলাম দলের সাথে। দলে ছিলেন হামার ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক ভাষা চর্চা পরিষদের প্রধান জালাল উদ্দিন, এডমিন আলতাফ হোসেন, এডমিন আব্দুল্লাহ, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাহাবুদ্দীন খান (লার্জ), ঠাকুরগাঁওয়ের সমাজসেবা অফিসার সাইয়েদা সুলতানা, জেলা তথ্য অফিসের মাহবুবুর রহমান, মনোয়ারা আনোয়ারা ম্যাটসের কম্পিউটার অপারেটর মোজাহারুল ইসলাম, ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের বাঁধনের সাবেক সভাপতি ফরহাদ হোসেন, কারমাইকেল কলেজের ছাত্র রেজওয়ানুল হক রনি, হামার ঠাকুরগাঁওয়ের সদস্য ফাতেমা তুজ জোহরা, ঠাকুরগাঁও সরকারি কলেজের ছাত্র শাহিন আলম।
২৯ আগস্ট ২০১৭। পরিচিত-অপরিচিত নারী-পুরুষমুখের সাথে ছুটছি রাণীশংকৈলের পথে। অথবা বালিয়াডাঙ্গীর পথে। দলের কেউ কেউ ঠাকুরগাঁও থাকেন, আবার কেউ কেউ ঢাকা থাকেন। তবে সবার একটা মিল ছিল – সকলেই ঠাকুরগাঁওয়ের সন্তান। তবুও রাণীশংকৈল না বালিয়াডাঙ্গী – কোথায় যাচ্ছি? সুনির্দিষ্ট স্থান বুঝতে ধন্ধে পড়ছিলাম। পৌঁছতেই অবশ্য জট খুলে গেল। সব সীমানার খেলা। পথের এপাশে বালিয়াডাঙ্গী, পথের ওপাশে রাণীশংকৈল।

বালিয়াডাঙ্গীতে আতিথেয়তা পেয়ে সবাই সামান্য বিশ্রামের সুযোগ পেল। গ্রামের উঠোন, বাতাস, সরলতা – সবই সতেজ। তবু গরমটা চাঙ্গা। এরমাঝে টেবিল-বেঞ্চ পেতে কার্যক্রম শুরু হলো। শৃঙ্খলা রাখতে, এবং নিরাশ না করতে পূর্বেই পরিবার ও ত্রাণগ্রহণকারীর তালিকা করা হয়েছিল। সবাইকে অনুরোধও করা হলো যেন পূর্ণ সহযোগীতা করা হয় আমাদের দলকে। বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার বড়পলাশবাড়ী ইউনিয়নের কাশুয়া বালিয়াবস্তী  গ্রামবাসী সত্যিই আমাদের কাজে সহযোগীতা করেছিল। এ কারণেই প্রায় ১৩৫টি পরিবারের মাঝে বস্ত্র, ৬শ প্যাকেট আটা, ১২০ পিস করে বল সাবান, লাক্স সাবান, কলম, খাতা ও ৩৮০টি খাবার স্যালাইন বিতরণ করা যায়।

গ্রামের বয়সীরাও এসেছিলেন। ওদিকে খাতা-কলম পেয়ে শিশুদের উল্লাস ছিল বন্যার দুর্ভোগকে ভুলিয়ে নতুন জীবনের প্রস্তুতির।

হামার ঠাকুরগাঁও আঞ্চলিক ভাষা চর্চা পরিষদের প্রধান জালাল উদ্দিন উপস্থিত গ্রামবাসীর উদ্দেশ্যে বললেন চমৎকার কথা। বেঁচে উঠতে হবে তাদেরই। ঘুরে দাঁড়াতে হবে তাদেরই। আমরা কেবল একটু সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা করছি।

গ্রামের সাথেই নদী। নদীকে ঘিরে জীবন। নদীকে ঘিরেই জীবীকা। আবার নদীই কখনো সর্বগ্রাসী। দোষ নদীর নয়। প্রকৃতির অস্বাভাবিকতার জন্য দায়ী তো মানুষই। আমরা চললাম নদী দেখতে।

একটু চলতেই পড়লো জগদল সীমান্ত ফাঁড়ি। ওদিকের ছবি তোলা যাবে না, তবে নদীর কাছে যাওয়া যাবে, ছবি তোলা যাবে। আমরা বাগান পেরিয়ে আসলাম অতাশ্চর্য জীবনীশক্তি নিয়ে বয়ে চলা নদীর কাছে। নাগর নদী। বাংলাদেশ-ভারতের একটি আন্তঃসীমান্ত নদী। নাগর নদীর কাছে উত্তরবঙ্গের অনেক জায়গা থেকেই যাওয়া যায়। আমরা নাগর নদীর কাছে এলাম রাণীশংকৈল উপজেলার কাশিপুর ইউনিয়নের জগদল সীমান্ত ফাঁড়ি পেরিয়ে।

আবারো  সীমানার গল্প। এপাশে বাংলাদেশ। ওপাশে ভারতের সীমানা। শক্ত সিমেন্টের পিলার দেখা যায়। আর দুপ্রান্তের মাঝে সীমানার বেড়ার তোয়াক্কা না করে বয়ে যায় নাগর নদী। নাগর নদীর এই অংশের প্রবাহ নাগর আর তিরনই নদীর মিলিত স্রোতে। এখন নদীতে তত গভীর জল নেই। অথচ সপ্তাহ দুয়েক আগেও নাকি নদী উপচে প্লাবিত ছিল পুরো এলাকা। প্রকৃতি এমনই খেয়ালি!

৪ সেপ্টেম্বর ২০১৭। আবার নদী । টাঙ্গন। তবে এখানে নাকি ত্রিধারার খেলা। সেনুয়া, টাঙ্গন আর তারাবান মিলে ফের টাঙ্গন। এ নদীগুলোও ভরাট হয়ে গিয়েছিল। একটা গাছের নগ্ন শিকড় দেখে মনে হলো হয়ত বন্যায় মাটি সরে গেছে।

এখানে নৌকা বাওয়া যায়। সূর্যর তেজ একটু পড়তেই বাতাসটা বেড়ে গেল। আর বেড়ে গেল তির তির স্রোত। নদীর সাথে শুকনো ডাঙ্গায় হেঁটে তারপর দেখা পাওয়া যায় জীবনযুদ্ধে জয়ী কিছু মানুষের। মরিচাখারি,খাল পাড়া।  জালাল উদ্দিনের উদ্যোগে ও সমন্বয়ে ইতিমধ্যে তিন দফা ত্রাণ ও খাদ্য ব্যবস্থা করা হয়েছে। আজ কুশল বিনিময়। সেই সুযোগে শোনা গেল তাদের প্রত্যাশার কথা। প্রয়োজনীয় চাহিদার কথা।

আমরা সবার জন্য ইতিবাচক থাকি। গ্রামবাসীও আমাদের জন্য ইতিবাচক থাকে। তারপর বিদায় নিয়ে আমরা ফেরার পথে হাঁটি।