ফেলানির এলাকায় রোজ পত্রিকা যায় কি না সন্দেহ। কিন্তু ফেলানি এখন পত্রিকার পাতায়। ভূমিকাটা একটা গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। গল্পটা ব্লগার আরণ্যক -এর। চতুর্মাত্রিক ব্লগে ভারত বিদ্বেষ : শেয়ার মার্কেট নিয়া জ্ঞানী বচন ও সীমান্তে পাখী শিকার শিরোনামের পোস্টে তিনি আমাদের একটি ভূমিকা-গল্প শোনাচ্ছেন।
আমি একবার কসবা বেড়াইতে গেসিলাম বন্ধুদের সাথে – কি কারণে যেন খায়েশ হৈলো বর্ডার দেখে আসি। ওপারে আবার একটা বিরাট দিঘী আছে।
তো গেলাম হাটতে হাটতে বর্ডার ক্রস করে। দিঘীর পাড়ে একটু দুর যাওয়ার পরই দেখলাম রাইফেল হাতে এক বিএসএফ তেড়ে আসছে। পাশে তাকিয়ে দেখি বন্ধুরা সব হাওয়া।
আমিও সসম্মানে হেটে বর্ডার ক্রস করে এপার চলে এলাম।
এখন চিন্তা করি কি পরিমাণ ছাগল ছিলাম। ইদানিং সেসব ঘটনা শুনি – বি এস এফের গুলি খাইয়া পত্রিকার শিরোনাম হওয়া মনে বেশী দূরে ছিলো না !!
ওপাশে বন্ধুসম প্রতিবেশী দেশ ভারত। এপাশে মুক্ত-স্বাধীন বাংলাদেশ। দু'দেশের নিজ নিজ স্বীকৃত পরিচয় আছে। অথচ কাঁটাতারের বেড়ায় নাম-পরিচয়হীনভাবে ৪ ঘন্টা ঝুলে থাকে ফেলানির লাশ। আমরা মুম্বাইয়ের আইটেম গার্ল শেফালীর তরতাজা শরীরের ভাঁজে সযত্নে কাঁটা লাগানোর সুব্যবস্থাপনায় (পড়ুন উত্তেজনায় অথবা তাড়নায়) ডুবে থাকি বলে মৃতদেহের ঝুলন্ত এ্যাক্রোব্যাটিক শো আমাদের প্রশাসনের নজর এড়িয়ে যায়।
এলাকার গ্রাম পঞ্চায়েত সদস্য সিপিএমের জগাই সাহা বলেন, "ওই কিশোরী যে দেশেরই নাগরিক হোক না কেন, যে ভাবে দেহটি বেড়ার উপরে ঝুলছিল তা চোখে দেখা যায় না। সেই কারণেই এলাকার বহু বাসিন্দা ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। গ্রামবাসীদের অনেকেই মনে করেন, গুলি না-করে কিশোরীকে গ্রেফতার করা যেতে পারত।" বিএসএফ কর্তারা এ দিন ওই ঘটনা নিয়ে কোনও মন্তব্য করতে অস্বীকার করেন। কাঁটাতারে ঝুলছে সন্দেহভাজন বাংলাদেশি কিশোরীর দেহ।
সরকার পক্ষের কৌশল থাকে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার। বিরোধীদলের রাজনৈতিক কৌশল হলো সরকারের ব্যর্থতা তুলে ধরার । বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার ক্যান্টনমেন্টের বাড়ি নিয়ে সরকারের বাড়াবাড়ির জবাবে বিরোধীদল হরতাল ডেকেছিল। গৃহহীন, পর্যাপ্ত বস্ত্রহীন বিরোধী দলীয় নেত্রী হু হু করে কেঁদেছিলেন। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্বাচনে ভোট চাইতে এসে কেঁদেছেন । আমরা এখনও কারো চোখে অশ্রু দেখিনি ফেলানিকে নিয়ে। বিরোধীদল ফুঁসে ওঠেননি ফেলানিকে নিয়ে। এই সরকারের আমলে জানমাল নিরাপদ নয় এই দাবিতে সারাদেশ অচল করে হরতাল ডাকা হয়নি এখনো। ব্লগার মাহমুদুল হাসান কায়রো তার "গুলি খেয়ে কাঁটাতারে ঝুলে ছিল ফেলানী, পানি পানি বলে আধ ঘন্টা চিৎকার করলেও কেহ পানি নিয়ে এগিয়ে আসে নি। (কোথায় দাড়িয়ে আছি আমরা?)" শিরোনামের পোস্টটিতে ক্ষোভের প্রকাশ করেছেন এভাবে,
আমরা হরতাল চাই না, আমরা খালেদা হাসিনার জবাব চাই না, আমরা চাই বিএসএফের হাতে অন্যায় ভাবে বাংলাদেশীদের খুন করা বন্ধ করতে হবে নয়ত বা ভারতের সাথে সাংস্কৃতির আদান প্রদান, অর্থনীতির চাল চালান বন্ধ করতে হবে। কারণ একদিক দিয়ে তারা আমাদের ভাই বোনকে অন্যায় ভাবে হত্যা করবে আর অন্যদিকে তাদের সাথেই হাত মিলিয়ে সন্ত্রাস দুরকরার নামে মানবাতার গান গাইব, এটা কখনোই হতে পারে না। আমরা এখনো এতটা অন্ধ হইনি।
ভারতীয় সংস্কৃতিকে আলিঙ্গন করতে আমরা ছুটে গিয়ে বিদ্ধ হই কাঁটাতারের বেড়ায়। পারুল মারা যায। কৃষক মজিবর রহমান মারা যায়। বন্ধু রাষ্ট্রকে ধমকে দেয়ার মত জোরালো কণ্ঠ আমাদের সরকারের নেই। আমরা বিনয়ী। আমাদের সৌজন্যতাবোধ প্রখর। বিএসএফকে শাসিয়ে কথা বলা যায় না। ওরা দুঃখ প্রকাশ করলে, আমরা নিজ গায়ে কাদা মেখে সার্ফ এক্সেলের বিজ্ঞাপনের মত খুশী হয়ে বলে উঠি, 'স্যরি বলেছে' । এর বেশী আর কী হতে পারে? বহুল পঠিত ভারতের মানবতাবিরোধী অন্যায়ের শিকার ফেলানী'র জন্য চোখের জল ফেলোনা।বি,এস,এফ এর প্রকাশ্য ক্ষমা প্রার্থনা চাই শীর্ষক পোস্টটিতে ব্লগার প্রজন্ম৮৬ সে কথাই জানতে চেয়েছেন রাষ্ট্রিয় বিবেকের কাছে –
সামাজিক-রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে এত ঘনিষ্টতা সত্তেও বাবার সাথে করে দেশে ফিরতে গিয়ে কাঁটাতারে ঝুলে থাকা বিয়ের কিশোরী কনে কে ৪ ঘন্টা গুলিবিদ্ধ রেখে মৃত্যু'র ১ দিন পরে লাশ ফেরৎ দেয়া নিয়ে বাংলাদেশীগুলো এত রাগ করে কেন??? প্রথম আলো'র মাধ্যমে বি,এস,এফ তো "সরি" বলেই দিয়েছে,এখন কি এই কাঙ্গাল দেশটার কাছে প্রকাশ্য ক্ষমা চাইবে নাকি???
বিডিআরের সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান গতকাল বিবিসিকে বলেছেন, 'বিএসএফ মাঠপর্যায়ের নিয়মনীতি (গ্রাউন্ড রুল) বারবার ভঙ্গ করছে। গ্রাউন্ড রুলে এ জাতীয় অনুপ্রবেশের ঘটনায় কোনো অবস্থায় গুলি ছোড়া যাবে না। কিন্তু বিএসএফকে কীভাবে বোঝানো যায়, আমি জানি না। এর আগে যতবার বিএসএফের সঙ্গে বৈঠক হয়েছে, তারা সব সময় বলেছে, এ ধরনের ঘটনা আর ঘটবে না। বছর খানেক আগে ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বলা হয়, এরপর আর গুলির ঘটনা ঘটবে না। কিন্তু ওই দিনই গুলি ছুড়েছে বিএসএফ। তারপরও বারবার গুলি ছুড়েছে।'
নিউইয়র্কভিত্তিক মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মনে করছে, এসব হত্যাকাণ্ডে জড়িত বিএসএফের সদস্যদের বিচার হওয়া উচিত। তাদের এ মনোভাবের সঙ্গে একমত পোষণ করে মেজর জেনারেল আজিজুর রহমান বলেন, বিচার করা হলে বিএসএফ গুলি করার আগে অন্তত চিন্তা করবে। মানবাধিকার সংগঠনগুলোর পরিসংখ্যানে বলা হয়েছে, কেবল গত বছর ৭৪ জন বেসামরিক নাগরিক বিএসএফের হাতে নিহত হয়েছে।
সীমান্ত মাত্রই এমন গোলাগুলি ঘটনা ঘটে কী? সামহোয়্যার ইন ব্লগের ব্লগার সংকলক এর পোস্ট থেকে একটা ধারণা পাওয়া যায় আন্তর্জাতিক অঙ্গন নিয়ে।
ভারতের সাথে শত্রুরাষ্ট্র পাকিস্তানের সীমান্ত আছে। কাশ্মীরে ভারতীয় বাহিনীর সাথে নিয়মিত গোলা বিনিময় হয় কিন্তু এভাবে নিরীহ মানুষ নিহত হয় না। আজকে পাকিস্তানের চেয়ে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষ যেনো ভারতের প্রধান শত্রু। তাহলে কী বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্র আর তার নাগরিকদের মেনে নিতে চাইছে না ভারত? উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সীমান্তে এমন ঘটনা খুবই বিরল অথচ এই মুহুর্তেও দেশ দুটি যুদ্ধ প্রস্তুতি রয়েছে।
গুলি করার নিয়ম নেই তবু গুলি ছুঁড়ে বিএসএফ আমাদের মানবাধিকার লংঘন করছে। এখানে আমাদের কী করার আছে? আমরা বন্ধু ব্লগে ব্লগার টুটুল -এর মত করে বলতে হয়,
হ্যা। বসে বসে মাছি মারার মত ব্লগ লেখা ছাড়া আম-ব্লগারদের আর কী করার আছে? কার দোষ তা খুঁজে বার করতে চান? কাকে দোষ দেবেন? দূর্বল পররাষ্ট্রনীতি? সরকারের ভারতপ্রীতি? আত্মকেন্দ্রিক ইস্যু নিয়ে বিরোধীদলের রাজনৈতিক ময়দানে ফায়দা লোটার অপচেস্টা? নাকি অবৈধভাবে চোরাপথে ফেলানী, পারুলের চলাচল?
না। দোষ আসলে ফেলানীর পরণের জামাটার। ওটা সেদিন, সেসময় কাঁটা তারের বেড়ায় কেন আটকে গেল? নাকি কাঁটাতারের বেড়াটা বড় জ্বালাচ্ছে? ওটা তুলে দিলে সব ল্যাঠা চুকেবুকে যাবে এখন!
বিএসএফ এর স্লোগান (মোটো) হলো, ডিউটি আনটু ডেথ। সীমান্তে বাঙালিদের মৃত্যু নিশ্চিত করা পর্যন্ত বিএসএফ তাদের ডিউটি আক্ষরিক অর্থেই নিশ্চিত করছে।