ক্লাউড প্রযুক্তি ও আমাদের সম্ভাবনা

আইরিন সুলতানাআইরিন সুলতানা
Published : 17 Sept 2011, 10:53 AM
Updated : 17 Sept 2011, 10:53 AM

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে দীর্ঘ প্রতিক্ষার সমাপ্তি হয়তো এবারে ঘটতে যাচ্ছে। তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক বা থ্রিজির শুভ সূচনার ঘোষণা এসেছে সম্প্রতি। ২০০৮ সালে এরিকসন, আর ২০০৯ সালে হুয়াওয়ে থ্রিজি নিয়ে তথ্যপ্রযুক্তি নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলেও আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় গ্রাহকরা এতোদিন থ্রিজির বাইরেই ছিলেন। শেষতক হালেই থ্রিজি লাইসেন্স উন্মুক্ত নিলাম প্রক্রিয়ায় হস্তান্তরের সিদ্ধান্তে ঘোষিত হওয়ায় মোবাইল অপারেটর প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিশেষ নড়াচড়া চোখে পড়ছে।

জানা গেছে, চলতি বছর পরীড়্গামূলকভাবে মোবাইল অপারেটর টেলিটক থ্রিজি সেবা চালু করতে যাচ্ছে। অন্যান্য জনপ্রিয় মোবাইল অপারেটরগুলোর অধিকাংশই এ বছর নবায়ন জটিলতা নিয়ে তৎপর থাকলেও তা
থ্রিজি স্পেকট্রাম ক্রয়ে কোন প্রভাব ফেলবে না বলে আশা করা যায়। দেশে পাঁচটি জিএসএম ও একটি সিডিএমএ মোবাইল অপারেটরই মূলত ইন্টারনেট সেবাকে ঘরে এবং ঘরের পাশাপাশি চলতি পথে আমাদের
হাতে হাতে পৌঁছে দিয়েছে। সাধারণত জিপিআরএস ও এজ (ইডিজিই) প্রযুক্তির ইন্টারনেট সেবা পেয়ে আসছি আমরা। রবি অপারেটর আগে জিপিআরএস
প্রযুক্তিতে ইন্টারনেট সেবা দিলেও ২০০৮ সাল থেকে এজ ইন্টারনেট সেবা দেয়া শুরু করে।

জিএসএম
জিএসএম হচ্ছে টুজি বা দ্বিতীয় প্রজন্মের প্রযুক্তি। এ প্রজন্মেরই ধারাবাহিকতায় এসেছে জিপিআরএস ও এজ। এদের আড়াইজি (২·৫জি) বলে গণ্য করা হয়। প্রযুক্তি-প্রজন্মের শুরম্নর কথা খুব সংড়্গেপে বলতে গেলে, মোবাইল রেডিও টেলিফোনি সিসটেমকে আজকের আধুনিক সেলুলার মোবাইল টেলিফোনি প্রযুক্তির আদি প্রজন্ম বলা যেতে পারে। একে জিরোজি (শূণ্য প্রজন্ম) বলে থাকেন কেউ কেউ। এনালগ রেডিও
প্রযুক্তির সেলুলার মোবাইলের মাধ্যমে যাত্রা শুরম্ন করে প্রথম প্রজন্ম। দেখা গেছে কম-বেশি প্রতি দশ বছর অন্তôর অন্তôর নব প্রজন্মের আগমন ঘটছে। ১৯৯০ এর দিকে টুজি যাত্রা শুরম্ন করে। প্রথম প্রজন্মের এনালগ রেডিও নেটওয়ার্ক দ্বিতীয় প্রজন্মে এসে ডিজিটাল চেহারা পায়।

দ্বিতীয় থেকে তৃতীয় প্রজন্মের নেটওয়ার্ক
দ্বিতীয় প্রজন্ম থেকে তৃতীয় প্রজন্মে পদার্পণে পুরো বিশ্ব কিন্তু একসাথে তাল মেলাতে পারেনি। থ্রিজি ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তুলতে যে সকল প্রতিবন্ধকতা দেখা গেছে, তার অন্যতম একটি হলো- টুজি থেকে থ্রিজিতে রূপান্তর ঘটাতে সম্পূর্ণ নতুন স্পেকট্রাম বরাদ্দের লাইলেন্স প্রয়োজন এবং এই লাইসেন্স ক্রয় করতে হয় বেশ উচ্চমূল্যে। এ ছাড়া থ্রিজিবান্ধব নয়া নেটওয়ার্ক কাঠামো প্রয়োজন। অন্য দিকে থ্রিজি নেটওয়ার্ক সুবিধা উপভোগ করতে গ্রাহকদের প্রয়োজন উন্নত মোবাইল সেট। তারপরও প্রজন্ম-প্রযুক্তির অগ্রযাত্রা আটকে থাকেনি। থ্রিজি হ্যান্ডসেট বাজারে কম থাকার অভিযোগটিও দুর হয়ে যাচ্ছে। প্রায় সবকটি নামী
মোবাইল প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান থ্রিজি উপযুক্ত উন্নত ভার্সনের মোবাইল বাজারজাত করছে এখন।

ডোকোমো প্রথম থ্রিজি নেটওয়ার্ক চালু করেছিল ২০০১ সালে, জাপানে। ২০০৪ সালে ভোডাফোনের থ্রিজি সেবায় আফ্রিকায় এক গ্রাহক প্রথম ভিডিও ফোন কল করেছিলো। ২০১০ এ প্রাইভেট প্রতিষ্ঠান টাটা ডোকোমো ভারতে থ্রিজি সেবা চালু করে। অবশ্য তার আগেই সরকারি প্রতিষ্ঠান বিএসএনএল থ্রিজি যাত্রা শুরম্ন করেছিল ভারতে।

ওয়াইম্যাক্স এবং থ্রিজি
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়তে প্রাথমিকভাবে দু'টো শর্তকে গুরুত্ব দিতে হবে-
(১) উচ্চ গতির ইন্টারনেট সেবা
(২) ই-গভর্নেন্স সিস্টেম।

থ্রিজির পূর্বে অবশ্য ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তির কারণে হাই স্পিড ব্রাউজিংয়ের অভিজ্ঞতা ঘটেছে ইন্টারনেট গ্রাহকদের। দেশে ২০০৯ সাল থেকে ওয়াইমাক্স সুবিধা চালু হয়েছে। কিউবি ও বাংলালায়ন এই মাইক্রোওয়েভ ইন্টারনেট সেবা দিচ্ছে গ্রাহকদের। তার বিহীন উচ্চ গতির ইন্টারনেট সুবিধাকে জনপ্রিয় করেছে ওয়াইম্যাক্স। এখন পর্যন্ত দেশের প্রত্যন্ত এলাকাগুলোতে ওয়াইম্যাক্স সুবিধা না পৌঁছালেও, ভবিষ্যতে সেরা সুবিধা পেতে ওয়াইম্যাক্সই ভরসা। কারণ নদীভিত্তিক বা পাহাড়ি এলাকায় তারযুক্ত অবকাঠামো গড়ে তোলা অতি ব্যয়বহুল। তাই তারবিহীন ব্যবস্থা ছাড়া বিকল্প নেই। দেখা গেছে বড় বিল্ডিং বা বাধা থাকার পরও ওয়াইম্যাক্স সিগন্যালে 'ইন্টারফিয়ারেন্স' কম ঘটে। এ কারণেই ওয়াইম্যাক্সকে 'লাস্ট মাইল' ইন্টারনেট সেবা প্রযুক্তিও বলা হয়। ইনফ্রাস্ট্রাকচার ব্যয় তুলনামূলক কম বলে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তিকে গুরম্নত্ব দেয়া হয়। যদিও আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত ওয়াইম্যাক্স ইন্টারনেট গ্রাহক সেবা সন্তোষজনক নয়, বলাবাহুল্য ওয়াইমাক্স কিন্তু থ্রিজি থেকে ৩০ গুণ বেশি গতিসম্পন্ন।

ক্লাউড এবং সম্ভাবনা
অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে যেখানে দুর্নীতি বেশি ঘটে, সেখানে ই-গভর্নেন্স এর মতো স্বয়ংক্রিয় (অটোমেটেড) পদ্ধতি প্রশাসনিক, দাপ্তরিক কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে পারে। একটু যদি বিশ্বের প্রযুক্তি ব্যবস্থাপনার দিকে চোখ বুলানো যায় তো ক্লাউড নিয়ে মাতামাতি চোখে পড়বে খুব সহজে। ক্লাউড কম্পিউটিং হলো, ইন্টারনেট ভিত্তিক প্রযুক্তি, যার মাধ্যমে আমরা সফটওয়্যার, ফাইল, কম্পিউটারের অন্যান্য তথ্য ব্যবহার ও শেয়ার করতে পারি। যদি অদূর ভবিষ্যতে ইন্টারনেট শব্দটি অপ্রচলিত হয়ে ক্লাউড শব্দের অহরহ প্রচলন শোনা যায়, তো অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না।

ক্লাউড, এর ব্যবহারকারীকে বিভিন্ন তথ্যপ্রযুক্তি সার্ভিসগুলোর রিমোট এক্সেস সুবিধা প্রদান করে একটি ইন্টারফেসের মাধ্যমে। সেই অর্থে আমরা বহু আগেই ক্লাউড সুবিধাভোগী। হটমেইল, ইয়াহু,
জিমেইলের মত ওয়েবভিত্তিক ইমেইল ব্যবহারকারীদের নিজ নিজ অ্যাকাউন্ট এক্সেস করতে রিমোট লগইন করতে হয়। ইমেইলের তথ্য কিন্তু ব্যবহারকারীর কম্পিউটারে জমা(স্টোর) থাকে না, থাকে ই-মেইল সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সার্ভারে। এটি ক্লাউড কম্পিউটিংয়েরই একটি বৈশিষ্ট্য।

জনপ্রিয় ক্লাউড সার্ভিসের মধ্যে রয়েছে, (১) ওয়েব অ্যাপ্লিকেশন এক্সেস। ইয়াহু, জিমেইল, হটমেইল এই সার্ভিস। (২) ভার্চুয়াল ডেটা সেন্টার। আইবিএম, এর ক্লাউড কম্পিউটিং গ্রাহকদের ডাটা সেন্টার এক্সেস সুবিধা দিয়ে থাকে। (৩) রিমোট কম্পিউটিং। অ্যামাজনের ইলাস্টিক ক্লাউড কম্পিউটিং (ইসিটু) সর্বপ্রথম রিমোট ক্লাউড কম্পিউটিং সেবা প্রদান করে। (৪) ই-গভর্নেন্স। ক্লাউড কম্পিউটিং নির্ভর ই-গভর্নেন্স পদ্ধতি রিসোর্স শেয়ারিংকে বাড়িয়ে তোলে। (৫) ই-লার্নিং। দূরশিড়্গণের ড়্গেত্রে ক্লাউড পদ্ধতি শিড়্গার্থী ও বিদ্যাপিঠকে আধুনিক প্রযুক্তির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে সড়্গম।

প্রস্তাবনা
দেশে এখন ইন্টারনেট গ্রাহক রয়েছে এক কোটি। আমাদের ইন্টারনেট নির্ভরতা ও গ্রাহক সংখ্যা বাড়ানো জরুরী। এজন্য শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত প্রযুক্তি সেবা সহজলভ্য করতে কম্পিউটার/ল্যাপটপ এবং ইন্টারনেট সেবা মূল্য কমানো জরুরী। সর্বনিম্ন ১০-১২ হাজার টাকায় সরকারের দেশিয় ল্যাপটপ দোয়েল প্রজেক্টটি সাধুবাদযোগ্য। কিন্তু ইন্টারনেট সার্ভিস প্রোভাইডারদের জন্য ব্যান্ডউইথ মূল্য কমানো হলেও এর সূফল গ্রাহকরা এখনো পাননি। তথাপি পরিস্থিতি খুব খারাপ এমনটা বলা যাবে না। তাই ওয়াইম্যাক্স, থ্রিজির পর বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরাও প্রবেশ করতে পারি মেঘ রাজ্যে। উল্লেখ্য, ক্লাউড কম্পিউটিং ব্যয় সাশ্রয়ী। যদি 'ক্লাউড ভিত্তিক ইগভর্নন্স' গড়ে তোলা যায় তবে প্রশাসনিক, দাপ্তরিকসহ নাগরিক সেবাখাতগুলোতে পারস্পরিক যোগাযোগ, তথ্য-সেবা আদানপ্রদান সহজসাধ্য হয়ে উঠবে।

শিক্ষাখাতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে গ্রামের বিদ্যালয় পর্যন্ত তথ্য বিনিময় করা যাবে। ক্লাউডকে এমনিতেও গ্রিন টেকনোলজি গণ্য করা হয়। আর ক্লাউড ভিত্তিক ই-গভর্নন্স বাড়িয়ে তোলে 'পেপাল লেস' দাপ্তরিক কাজের চর্চা। এতে করে 'গ্রিন টেকনোলজি' নিয়ে আমাদের সচেতনতামূলক প্রচারণা সফলতার মুখ দেখবে।

'ডিজিটাল বাংলাদেশ' -এর জন্য অবশ্য এটাই শেষ প্রযুক্তি-সেবা সমাধান নয়, বরং আগামীতে আরো চ্যালেঞ্জ রয়েছে। ২০০৯ এর শেষের দিকে সুইডেনের স্টকহোম ও অসলো'তে ফোরজি নেটওয়ার্ক চালু হয়। বিশ্বে ফোরজির প্রথম বাণিজ্যিক যাত্রা ওখান থেকেই। ২০১১ শেষ হতে হতে ২৩৭টি সুইডিশ শহর ও গ্রামে ফোরজি সুবিধা ছড়িয়ে দেয়ার কাজ চলছে। পিছিয়ে পড়তে না চাইলে ফোরজি গতিতে ছোটার এই প্রস্তুতি আমাদেরও নিতে হবে।

***
লেখাটি www.bdnews24.com এর টেক পাতায় ভি-ম্যাগে (ঈদ সংখ্যা ২০১১) প্রকাশিত (পৃষ্ঠা-৩৪) [, ]

***
ক্লাউড নিয়ে পূর্বের আলোচনা: মেঘজাল প্রযুক্তিঃ জানা কথা অজানা কথা