শহীদ কাদরী: মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছি, স্বদেশ আমাকে ডাকছে

saifullamahmud_dulal
Published : 29 August 2016, 09:03 AM
Updated : 29 August 2016, 09:03 AM

'না, শহীদ সেতো নেই; গোধূলিতে তাকে
কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায় নি, পাবে না।
…………………
সভয়ে দরোজা খুলি- এইভাবে দেখা পাই তার- মাঝরাতে;
জানি না কোথায় যায়, কি করে, কেমন করে দিনরাত কাটে
চাকুরিতে মন নেই, সর্বদাই রক্তনেত্র, শোকের পতাকা
মনে হয় ইচ্ছে করে উড়িয়েছে একরাশ চুলের বদলে !
না, না, তার কথা আর নয়, সেই
বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।'
(অগ্রজের উত্তর/ শহীদ কাদরী)


ক] মাতৃভূমি ত্যাগ করা লেখকের আত্মহত্যার সামিল
চির বাউন্ডুলে জীবিত শহীদ কাদরী বাড়ি ফেরেননি। এখন ফিরবেন লাশ হয়ে। দশ বছর বয়সে অর্থাৎ কৈশোরে ১৯৫২ সালে জন্মভূমি কলকাতা ছেড়ে ঢাকা আসেন। ঢাকায় বেড়ে ওঠা যৌবনের দিনগুলো ফেলে ১৯৭৮ সালে বিদেশ পাড়ি জমান। জন্মভূমি আর মাতৃভূমির নীড় ছেড়ে হাজার হাজার মাইল দূরে উড়াল দিয়ে চলে গেলেন নিরুদ্দেশে। তারপর আর ঘরে ফিরেননি। হয়ত তাঁকে অনেকেই খুজঁছেন। পাচ্ছেন না। তাই তিনি লিখেছেন- 'অগ্রজের উত্তর' কবিতা। বড়ভাই বলছেন-'না, শহীদ সেতো নেই; গোধূলিতে তাকে/ কখনও বাসায় কেউ কোনদিন পায় নি, পাবে না।/ … বেরিয়েছে সকাল বেলায় সে তো- শহীদ কাদরী বাড়ি নেই।'

তেত্রিশ বছর গৃহহীন কবি লন্ডন, বার্লিন, বোষ্টন ঘুরে ঘুরে প্রাজ্ঞ বাউলের মতো ঘুরে ফিরে একটু থিতু হয়েছেন- নিউ ইর্য়কে। কারণ, সাধ থাকলেও আর উড়াল দেয়ার সামর্থ ছিলো না। তাঁর জীবনটা হুইল চেয়ারে আটকে ছিলো। এক মিনিটের বেশি হুইলচেয়ার থেকে উঠে দাঁড়াতে পারতেন না। বিশাল শরীরটা ভেঙ্গে গিয়েছিলো। কিডনি নষ্ট। একদিন পর পর ডায়ালিসিস। ডায়ালিসিসের পর খুবই ক্লান্ত থাকতেন। ছয়-সাত বছর ধরে বেঁচে ছিলেন এই ডায়ালাইসিসের ওপর। ডায়ালাইসিস নিয়ে পাঁচ বছরের বেশি কেউ বাঁচে না। অথচ শহীদ কাদরী ছিলেন তারুণ্যে দীপ্ত। অটুট মনোবল, কণ্ঠস্বর দৃঢ়। প্রাণবন্ত, প্রফুল্ল। আগের মতোই অফুরন্ত আড্ডাবাজ। আড্ডার আতশবাজি ফুটিয়ে হু হু হেসে ওঠেন। মাতিয়ে তুলেন আসর। তাঁর উপলব্ধি ছিলো- 'মাতৃভূমি ছাড়তে নেই, মাতৃভূমি ত্যাগ করা লেখকের আত্মহত্যার সামিল'। তাঁর ভাষ্য-'আমার জীবনের সবচে বড় ভুল'।
সেজন্যই হয়তো মৃত্যুর কয়েক দিন আগে কবি বলেছিলেন, আমি মৃত্যুর গন্ধ টের পাচ্ছি। আমাকে বাংলাদেশ ডাকছে।

খ] ত্রিশ বছরেও নেননি নাগরিকত্ব, গ্রহণ করেননি বিদেশি পাসপোর্ট
কানাডায় আসার পর প্রায় প্রতি বছরই নিউ ইয়র্ক যাই, কাজে বা বইমেলায় কিংবা সেমিনারে। সময়সীমা সীমিত থাকার কারণে শহীদ কাদরীর সাথে দেখা করা হয় না। বাংলাদেশে সত্তর দশকের শেষ দিকে তাঁর পুরানা পল্টনের বাসায় আমরা আড্ডা দিতে যেতাম। ২০০৫-এ ফোবানা সম্মেলনে এসে কবি-বন্ধু শামস আল মমীনের সাথে ত্রিশ বছর পর আবার শহীদ ভাইয়ের সাথে আড্ডা। অবশ্য মাঝে মাঝে পত্র যোগাযোগ হতো।
২০০৯ সালে আগস্টে নিউ ইয়র্কে গেলাম শুধু মাত্র শহীদ ভাইয়ের লোভনীয় আড্ডার আকর্ষণে। সাথে শামস আল মমীন। আর সেখানে গিয়ে পেলাম- দৈনিক সংবাদের নিনি আপাকে, নিনি ওয়াহিদ। তাঁর সাথে একমাত্র মেয়ে শেমন্তী। বিদেশে বেড়ে উঠলেও শাড়ি পরা শেমন্তী স্বদেশের সংকৃতিতে নিজেকে পূর্ণ করে তুলছে। নাচ, গান, নাটক, আবৃত্তিতে পটু। মাঝে মাঝে শেমন্তীর আবৃতি আর ইশরাত জাহান নীরা ভাবীর পরিবেশিত গরম গরম চা মাত্রা বাড়িয়ে দিলো আমাদের আড্ডার। নিনি আপার বানানো চালের গুড়োঁয় পেঁয়াজ-ধনিয়াপাতা-মরিচ-মশলা মেশানো পাতলা রুটি আর সবজীর চপের স্বাদে জমজমাট আড্ডা চলো প্রায় মধ্যরাত অব্দি।
এখানে নীরা ভাবীর কথা একটু না বললেই নয়। নীরা শব্দের উল্টো পিঠেই নারী। যিনি আবহমান নারীদের মতো অসীম মমত্ব আর অফুরন্ত ভালোবাসার বাঁধনে আগলে রেখেছেন শহীদ কাদরীকে। প্রথম স্ত্রী নাজমুন্নেসা পেয়ারী কিংবা বিদেশিনী দ্বিতীয় (মৃত) স্ত্রী ডানা ইসলামের বাঁধন খুলে গিয়েছে। কিন্তু নীরা ভাবী প্রকৃত নারীর মতো বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন।
পেয়ারী ভাবী এখনো শহীদ ভাইকে ভুলতে পারেন না। বার্লিনে ভাবী তাঁর ফ্ল্যাটে কত অপ্রকাশিত কথা বলেছিলেন। শহীদ ভাইয়ের প্রথম বই উত্তরাধিকার-এর প্রচ্ছদ আঁকা থেকে শুরু করে তাঁদের একমাত্র ছেলে লাবীবের বিয়ে। ঢাকা, টরন্টো এবং নিউ ইয়র্ক এসেও পিয়ারী ভাবী আমার মাধম্যে শহীদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করতেন। ২০০৯ সালে মুক্তধারার বইমেলায় এসে জ্যাকসন হাইটের একটা রেস্টুরেন্টে দেখাও করলেন। তাদের ভেতর একটা অদ্ভূত টান ছিল।
যাইহোক, শহীদ ভাইয়ের সাথে প্রায়ই টেলিফোনে দীর্ঘ আড্ডা হতো ঘন্টার পর ঘন্টা। যেহেতু একদিন পর পর ডায়ালিসিস দিতে হতো, তাই দিন-বার হিসেব করে ফোন দিতে হতো। কিন্তু দ্বিপাক্ষিক সেই সব আড্ডার অনেক কিছু প্রকাশ করার মত নয়। মূলত কবিতাকে ঘিরেই আড্ডায় আড্ডায় আমরা ঘুরে বেড়াতাম সারা পৃথিবী। পৃথিবীর পরিবেশ, বিশ্ব সাহিত্য, দেশ-বিদেশের রাজনীতি, ধর্ম-অধর্মের দ্বন্দ্ব, সেক্স-প্রেম, পরচর্চ্চা পরিপূর্ণ হয়ে ওঠে আমাদের আড্ডা। আমাদের আড্ডায় ঘুরে ফিরে আসেন রোকনুজ্জামান খান,শামসুর রাহমান, হাসান হাফিজুর রহমান, আল মাহমুদ, মান্নান সৈয়দ, আবিদ আজাদ, শিহাব সরকার এবং আরো অনেকেই। তিনি স্মৃতিচারণ করেন তাঁর সময়ের আর আমি করি আমার ফেলে আসা ঢাকার দিনগুলোর। তারপর দু'জনে মেলাতে চেষ্টা করি কিছু মিলে, কিছু মিলেনা। শহীদ ভাই বলতেন, তিনি শারীরিকভাবে অসুস্থ, কিন্তু মানসিকভাবে খুবই সুস্থ-সবল। তাঁর বাসার কাছেই থাকতেন অসুস্থ হুমায়ূন আহমেদ। তাঁর খোঁজ খবর নেয়ার জন্য অপেক্ষা করতেন। তখন হুমায়ূন আহমেদ তাঁকে নিয়ে 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' শীর্ষক লেখাও লিখেছেন। তাতে তুলে ধরেছেন শহীদ কাদরীর স্বতন্ত্রতা, পূর্ণতা এবং শূন্যতা।
বাংলা কবিতার জগতে এক জীবন্ত কিংবদন্তি শহীদ কাদরী তাঁর জামাইকাস্থ বাসায় প্রতি মাসে নির্বাচিত কবিদের কবিতা পাঠ ও আবৃত্তির আসর করতেন ২০১৪ সালের আগষ্ট থেকে। কবিতাকে পাঠকের কাছে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন, সেই সাথে খ্যাতিমানদের 'অজনপ্রিয় ভালো কবিতাগুলো' তুলে ধরা এই আসরের উদেশ্য। কবি শহীদ কাদরী আয়োজিত এই কাব্যসন্ধ্যায় আরো থাকতো- কবির সাথে আড্ডা, কবিতা কেন পড়ি, কবিতা কেন লিখি?

তিনি মনে করেন- প্রকৃত কবিতার মাঝেই বেঁচে থাকেন একজন শুদ্ধতম কবি। কবিরা সব সময়ই দাঁড়ান সত্যের পক্ষে। তারা মাটিকে ভালোবাসেন বলেই বার বার ফিরে যান অবনত ভালোবাসার কাছে। তাদের কবিতাই হয়ে ওঠে আপামর মানুষের শক্তির উৎস।
এলোমেলো আড্ডা দিতে দিতে শহীদ ভাই বললেন, তোমাদের কানাডায় মূলধারার বেশ ভালো লেখক কবি আছেন। ইকবাল হাসান, লুৎফর রহমান রিটন, মাসুদ খান, সির্দ্ধাথ হক, তুমি। তোমরা ভালো লিখছো। কিন্তু আমাদের এখানে তেমন কেউ নেই। আমাদের কবিতার আনুষ্ঠানটা কয়দিন চালাতে পাড়বো, বুঝতে পারছি না!
শহীদ কাদরীর ইচ্ছে ছিল- বাংলা কবিতার একটি প্রতিনিধিত্বশীল সংকলণ করা। অনেক দিন ধরে প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পড়তেছিলেন অতি তরুণতম কবিদের কবিতা। তাই নিয়ে আলোচনা করতেন। মাঝে মাঝে কারো কারো কবিতা পড়ে মুগ্ধ হন। তবে বেশির ভাগই হতাশাব্যঞ্জক। নতুনত্ব বা উত্তরাধুনিকতার নামে অনেকেই গার্বেজ লিখছে। প্রবাসের কবিদের ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযোজ্য। গদ্য চর্চার অবস্থা আরো ভয়াবহ। কিন্তু তাঁর সেই কাজ অসমাপ্তই থেকে গেলো!
নিউ ইয়র্কের দুই কবি তাঁকে নিয়ে দু'টি বই লিখছেন। হাসানআল আবদুল্লাহ 'শহীদ কাদরী : সময়ের সম্পন্ন স্বর' এবং সৈয়দ আদনান 'শহীদ কাদরী বাড়ি নেই'। বই দু'টি দেখে শহীদ কাদরী ভী-ষ-ণ ক্ষুব্ধ হয়েছেন এবং বই দু'টি বাতিল করে দিয়েছেন। ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশে তাঁর উপর রচিত বই দু'টি ছুঁড়েও ফেলে দিয়েছেন। কারণ, লেখকদ্বয় নিজের মতো করে উল্টাপাল্টা লিখেছেন। শহীদ কাদরী যা বলেন নি, তাঁরা তা-ও শহীদ কাদরীর নামে চালিয়ে দিয়েছেন। মানে তাঁর বক্তব্য বিকৃত করেছে বা তাঁর ভাষা লেখকদ্বয় না বুঝেই লিখে দিয়েছেন। ফলে তাঁদের সাথে শহীদ কাদরীর ব্যক্তিগত সম্পর্কও নষ্ট হয়েছে। তাই তাঁকে নিয়ে কেউ কিছু লিখতে চাইলে এই তিক্ত অভিজ্ঞতার জন্য তিনি মোটেও আগ্রহ প্রকাশ করেন না। বরং বিরক্তবোধ করেন।

শহীদ কাদরী স্বদেশ থেকে দূরে থাকলেও হৃদয়ের গহীণে লালন করেন দেশের অস্তিত্ব। আর দেশও তাঁকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েছে। তিনি ত্রিশ বছর ধরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাস করেও সে দেশের পাসপোর্ট গ্রহণ করেন নি, নেননি নাগরিকত্ব! কেবল গ্রিন কার্ড নিয়েছেন। গত বছর আগষ্টে কবির জন্মদিনের আগের দিন তাঁর বাসভবন গিয়ে কনস্যুলেট অফিস থেকে বাংলাদেশি পাসপোর্ট প্রদান করে। এখন সেই পাসপোর্ট নিয়েই স্বদেশে ফিরবেন লাশ হয়ে!
মাত্র একটি কাব্যগ্রন্থ লিখেই ১৯৭৩ সালে তিনি পেয়েছেন বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরষ্কার। ২০১১ সালে তাঁকে প্রদান করা হলো একুশে পদক। ১৯৪২ সালের ১৪ আগস্টে জন্ম নেয়া এই কবি মাত্র চারটি কাব্যগ্রন্থের–[উত্তরাধিকার (১৯৬৭), তোমাকে অভিবাদন প্রিয়তমা (১৯৭৪), কোথাও কোন ক্রন্দন নেই (১৯৭৮) এবং আমার চুম্বনগুলো পৌঁছে দাও (২০০৯)]–মাধ্যমেই শৈল্পিকতা, আধুনিকতা এবং নান্দনিকতার জন্য তিনি আজো তরুণদের কাছে জনপ্রিয়।
শহীদ কাদরীর একমাত্র ছেলে লাবীব কাদরীও নিউ ইয়র্কে থাকে। জানি না, লাবীব লেখালেখি করে কিনা। শহীদ ভাইকে তা কখনো জিজ্ঞাস করা হয়নি। কারণ, লিখিতভাবে জানতে চাইবো। শহীদ ভাইয়ের সাথে কথা হয়েছে, তাঁকে ১০১ প্রশ্ন দেবো। তিনি উত্তর দিবেন। সেখানে থাকবে সব কিছু। তাও আর হলোনা!
আগস্ট মাস আমাদের বেদনার মাস। আগস্ট মাস তাঁর জন্মমাস। এই মাসেই তিনি চির নিদ্রায় শায়িত হলেন!

গ] 'আমরা না-হিন্দু, না-মুসলিম; তখন সব ধর্মই ছিলো আমাদের ধর্ম'
বাবা খালেদ ইবনে আহমেদ কাদরী ছিলেন 'স্টার অব ইন্ডিয়া'র সম্পাদক। বৃটিশ আমলে কেন্দ্রীয় সরকারের কর্মকর্তা। বনেদি পরিবারে জন্ম নিয়েও তিনি হয়েছেন বাউন্ডুলে। সেই সব স্মৃতিচারণ করতে করতে হারিয়ে যান কলকাতায়। বাবার দামী নতুন জুতো ২৫ পয়সায় বিক্রি করে বা তাঁর কোটের পকেট থেকে ১০০ রুপী চুরি করে সিগারেট খাওয়া। আর তার জন্য অকারণেই ফেঁসে যেতেন বড় ভাই শাহেদ কাদরী। এরকম কতো না মজার মজার হারানো দিনের পুরনো কথা শহীদ ভাইয়ের স্মৃতির ঝুঁলিতে। জাবর কাটা স্মৃতিগুলোর ভেতর খুঁজে পাওয়া যায় ইতিহাস, ঐতিহ্য, শিক্ষা, সংকৃতি। এসব অসাধারণ স্মৃতিকথা লিখতে চান না। বলেন- কি হবে লিখে?

বাবা হারানো কলকাতা আর মা হারানো ঢাকাকে তিনি আজো ভোলেন নি। প্রবাসজীবন যাপনের প্রতি মুহূর্তেই সেই দিনগুলোর আনন্দ আর বেদনাকে মনে করেন, লালন করেন। দেশ থেকে হাজার হাজার মাইল দূরের অবস্থান করলেও তাঁর হৃদয় দেশের মাটির গভীরে প্রোথিত। 'কসমোপলিটান শহর নিউ ইয়র্কে থাকলেও মন তাঁর পড়ে থাকে ঢাকা ও কলকাতায়। ওই কুয়াশাভেজা সকাল, বৃষ্টিতে সাদা হয়ে যাওয়া কালো রাত, রিক্সার টুং টাং ধ্বনি, মাছির গুঞ্জনের ভেতর একদা পরে থাকা নিজের অস্তিত্ব খুঁজে ফেরেন মধ্য-ম্যানহাটানে বাংলার বৈশাখের ঝঞ্ঝার মতো বুকের উপর আছড়েপড়া দুর্বিনীত বাতাসের ঝাপটার ভিতর'।
যে পল্টনে থাকতেন বুদ্ধদেব বসু সেই পল্টনেই থাকতেন শহীদ কাদরীও। বুদ্ধদেব বসুর স্মৃতি আর শহীদ কাদরীর স্মৃতি ভিন্ন। রাতদিন টানা ম্যারাথন আড্ডা চলতো শহীদ কাদরীর পল্টনের বাসায়। সত্তর দশকের সেই আড্ডার সর্ব কনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম আমিও। পুরানা পল্টন যেন পুরনো হয়ে গেছে। সেই স্মৃতির শহরে আর কোনো দিনই ফেরা হবে না শহীদ কাদরীর।
সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন, ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বছরে 'ইস্পাহানির ওরিয়েন্টাল এয়ারলাইন্সে যখন কলকাতা থেকে ঢাকা এসে নামলাম— মনে হ'ল, আলোর রাজ্য থেকে এক অন্ধকার গলিতে প্রবেশ করেছি। তবে একটি কথা বলছি তোমাকে— কলকাতায় আমি কোনোদিন নৌকা দেখিনি। ঢাকার সদরঘাটে নৌকা দেখা ছিল এক বিস্ময়ের মতো। আমার বয়স তখন ১০। প্রথমদিন বুড়িগঙ্গার বুকে পালতোলা নৌকা দেখে আমি তো রীতিমতো অবাক। কী আশ্চর্য, ঢাকায় এভাবে সারাজীবন নৌকা দেখতে পারবো! প্রতিদিন বিকেলে সদরঘাট যেতাম নৌকা দেখতে। তারপর রিভারভিউ ক্যাফেতে বসে চা আর চকলেট-বিস্কুট খেয়ে সন্ধ্যায় বাসায় ফিরতাম'।
না। কোনো কোনো রাতে বাসায় ফিরতেন না। রাতের শহর চষে বেড়াতেন। চাংখারপুল থেকে পুরানা পল্টন, পল্টন থেকে পুরোনো ঢাকা; ঢাকা শহরের এক মাথা থেকে অন্য মাথায়। যখন সবকিছু বন্ধ হয়ে যেত তখন তাঁদের আড্ডা জমতো রেল-স্টেশনে। সেখানে 'আদর্শ মুসলিম হোটেল' ও 'আদর্শ হিন্দু হোটেল' খোলা থাকতো সারারাত। সে সম্পর্কে বলেন, 'মালিক একজনই— তিনি মুসলমান। আমরা তখন না-হিন্দু, না-মুসলিম। সব ধর্মই আমাদের ধর্ম তখন। আমরা রাত তিনটায় হিন্দু হোটেলে ঢুকে আড্ডা দিয়ে রাত শেষে মুসলিম হোটেলে চা খেয়ে বাড়ি ফিরতাম।' কম পয়সায়, বিনা পয়সায় চা-পুরি। এক কাপ ২/৩ জনে ভাগাভাগি। কিছু পয়সা হলে হোটেল ইন্টারকনে গিয়ে প্রাণ ভরে পান করা। কবিতা নিয়ে মাতামাতি। উত্তর আধুনিক কবিতা লেখার প্রতিযোগিতা। আমারই প্রথম কবিতায় নাগরিক জীবনের রাজপথ, ফুটপাত, রেষ্টূরেন্ট, ব্যারাক, পার্ক, প্লেকাড, প্রভৃতি শব্দ ব্যবহার শুরু করি।
বিউটি বোর্ডিং, রেক্স রেস্তোরাঁ, রমনা রেস্তোরাঁয়, ঔপন্যাসিক রশীদ করীমের বাড়ি, শামসুর রাহমানের বাড়ি, ফজল শাহাবুদ্দীনের অফিস, সন্ধানী আর পুরানা পল্টনে আড্ডা হ'ত নিয়মিত।
আর তাঁর সেই সময়ের সঙ্গী ছিলেন- শামসুর রাহমান, আল মাহমুদ, ফজল শাহাবুদ্দীন। আড্ডার সেই দিনগুলো-রাতগুলো তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায়। মন খারাপ করে বলেছিলেন- 'হ্যাঁ, আমি ভাবতেই পারি না শামসুর রাহমান, রশীদ করীম নেই। আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, মান্নান সৈয়দের সঙ্গে আর কোনোদিন দ্যাখা হবে না। সিকদার আমিনুল হক, বিপ্লব দাশও চলে গেল! আর আবিদও যে এতো তাড়াতাড়ি চলে যাবে কখনো ভাবিনি'।
শহীদ ভাই, আপনার কথা দিয়েই আপনাকে বলতে চাই- আপনিও এভাবে চলে যাবেন, ভাবতে পারছি না, মানতে পারছি না!