জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির বিক্ষিপ্ত চেহারা

ফরিদা আখতার
Published : 8 Jan 2011, 10:43 AM
Updated : 8 Jan 2011, 10:43 AM

এ পর্যন্ত যেসব স্বাস্থ্য নীতির খসড়া প্রণীত হয়েছে তার কোনটিই চুড়ান্ত হয়ে জাতীয় সংসদে পাশ হবার পর্যায়ে যেতে পারে নি। বর্তমান সরকার ২০০৯ সালের শুরুতেই ঘোষণা দিয়েছেন স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করার, কিন্তু এখনও তা চুড়ান্ত হয় নি। এবার স্বাস্থ্যমন্ত্রী হেলথ রিপোর্টার্স ফোরামের ৫ জানুয়ারী, ২০১১ তারিখে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে ঘোষণা দিয়েছেন জাতীয় সংসদের আসন্ন অধিবেশনেই জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি উপস্থাপন করা হবে।

দেশ স্বাধীন হয়েছে ১৯৭১ সালে, কিন্তু তারপর এতো বছর পার হয়ে গেলেও স্বাধীন বাংলাদেশের কোন স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নি। দেশের স্বাস্থ্য ব্যবস্থা স্বাধীন হবার আগে যা ছিল তারই ধারাবাহিকতায় স্বাস্থ্য সেবা নামক কর্মকান্ড হিশেবে চলে আসছে। স্বাস্থ্য সেবার অর্থ দাঁড়িয়েছে চিকিৎসা সেবা এবং রোগ নিরাময়ন; রোগ প্রতিরোধ নয়।

এরই মধ্যে ১৯৭৮ সালে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করার জন্য আন্তর্জাতিক সম্মেলনে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের সস্মতিতে আলমা আতা ঘোষণা গৃহিত হয়। বাংলাদেশ এর অন্যতম প্রধান স্বাক্ষরকারী দেশ এবং বাংলাদেশের কিছু ব্যক্তি সরাসরি এই ঘোষণা প্রণয়নের সাথে যুক্ত হবার গৌরব অর্জন করেছেন। তাঁদের মধ্যে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী অন্যতম। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী চিকিৎসকরা স্বাধীন বাংলাদেশের স্বাস্থ্য সেবার জন্য নতুন চিন্তাভাবনা করেছিলেন। সমাজতান্ত্রিক দেশ চীন ও কিউবার স্বাস্থ্য ব্যবস্থা, বিশেষ করে স্বাস্থ্য কর্মী গঠন করে গ্রামে গঞ্জে স্বাস্থ্য পৌঁছে দিতে পারার সম্ভাবনা পরীক্ষা নিরীক্ষা বাংলাদেশে হয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বাংলাদেশের অভিজ্ঞতাকেও আলমা আতা ঘোষণা প্রস্তুত করার আগে নজির হিশেবে ব্যবহার করেছে। এইভাবে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ছোট বড় অভিজ্ঞতার আলোকে ১৯৭৭ সালে ৩০তম বিশ্ব স্বাস্থ্য সম্মেলনে ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য অর্জনের ঘোষণা দেয়া হয়। এর পরের বছর সোভিয়েত রাশিয়ার কাজিকিস্তানের আলমা আতা শহরে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ৩১তম সম্মেলনে আলমা আতা ঘোষণা গৃহিত হয় যা এখনো প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা এবং রোগ প্রতিরোধ সংক্রান্ত সবচেয়ে গুরুত্বপুর্ণ দলিল হিসেবে স্বীকৃত।

আলমা আতা ঘোষণার কয়েকটি তাৎপর্যপুর্ণ দিক ছিল যা, যে কোন স্বাস্থ্য নীতির জন্য দিকনির্দেশনা দিতে পারে। যেমন, 'স্বাস্থ্য' মানে কী? এর একটি ব্যাখ্যা দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে স্বাস্থ্য হচ্ছে একটি পরিপুর্ণ শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক সুস্থ্য অবস্থা; শুধুমাত্র রোগের অনুপস্থিতি নয়। স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপুর্ণ সূচক হিশেবে স্বাস্থ্য সূচক সার্বজনীনভাবে স্বীকৃত। এই সংজ্ঞাটি বাংলাদেশের বিগত কয়েকটি স্বাস্থ্য নীতির খসড়ায় আলমা আতার উল্লেখ ছাড়াই স্থান পেয়েছে।

স্বাস্থ্যগত দিক থেকে ধনী ও গরিব দেশ এবং একই দেশে ধনী ও গরিব মানুষের মধ্যে অসম অবস্থান গ্রহণযোগ্য নয় বলে আলমা আতা ঘোষণায় বলা হয়েছে। আলমা আতা ঘোষণায় এই বৈষম্য বিচারের গুরুত্ব অনেক ব্যাপক ও রাজনৈতিক।

জনগনের স্বাস্থ্য ভাল রাখার চেষ্টা করা দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন এবং শান্তির জন্য অপরিহার্য। তাই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের মাধ্যমে ধনী ও গরিব দেশের মানুষের স্বাস্থ্য পরিস্থিতির মধ্যে পার্থক্য কমিয়ে আনা সম্ভব। কিন্তু এই বিষয়টি মোটেও স্বাস্থ্য নীতির দিক থেকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয় নি। জনগনের স্বাস্থ্যের মান উন্নত হওয়া একটি দেশের উন্নয়ন পরিকল্পনার জন্য কত জরুরী স্বাস্থ্য নীতির প্রণেতারা সে বিষয়টি দেখতে ব্যর্থ হয়েছেন। তাই স্বাস্থ্য নীতির সাথে দারিদ্র বিমোচন পরিকল্পনা যুক্ত হয় নি। কিংবা দারিদ্র বিমোচন পরিকল্পনায় স্বাস্থ্য সূচক উন্নত করার মতো পরিকল্পনা রাখা হয়নি। মানুষের দরিদ্র হবার প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে স্বাস্থ্য সেবা যতোই উন্নত হোক, সে দেশ কখনোই উন্নত হতে পারে না।

আলমা আতা ঘোষণা অনুযায়ী জনগনের অধিকার এবং একই সাথে দায়িত্ব রয়েছে স্বাস্থ্য সেবা প্রদান সংক্রান্ত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে অংশগ্রহণ করার। জনগণের এই অংশগ্রহণ রাজনৈতিক ক্ষমতার সাথেও যুক্ত। উপর থেকে চাপিয়ে দেয়া কোন নীতি নয়, জনগনের অধিকার স্বীকার করে তার অংশগ্রহণে তার প্রয়োজন অনুসারে নীতি প্রণীত হবে এবং বাস্তবায়ন করা হবে। এই বিষয়টিকে প্রগতিশীল সংগঠনগুলো একভাবে দেখেন এবং তাঁরা এর রাজনৈতিক দিকটি অনুধাবন করে জনগন এবং স্থানীয় সরকারের সম্পৃক্তির প্রস্তাব করেন, কিন্তু সরকার এর পাশাপাশি শুধুই পেশাজীবি সংগঠন, বিশেষ করে চিকিৎসকদের সংগঠনের প্রতি গুরুত্ব আরোপ করেন। ফলে স্বাস্থ্য নীতি নিয়ে কথা বলেন চিকিৎসকরা এবং তাঁদের পছন্দ অপছন্দ এই ব্যাপারে প্রধান হয়ে দাঁড়ায়। তাছাড়া বর্তমানে রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্তিও জনগনের অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে বাঁধা হয়ে যায়। এই আচরন স্বাস্থ্য সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে এবং জনগনের অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বড় বাধা হয়ে ওঠে। স্বাস্থ্য নীতি শুধু চিকিৎসকদের নীতি নয়, স্বাস্থ্য জনগনের নীতি হিশেবে দেখা উচিত।

সরকারের দায়িত্ব হচ্ছে জনগনের স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা করা এবং তা করা সম্ভব শুধুমাত্র পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য ও সামাজিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে। এই কারণে আলমা আতা ঘোষণায় ২০০০ সালের মধ্যে সবার জন্য স্বাস্থ্য লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলা হয়েছিল, যেন মানুষ সুস্থ্য থাকতে পারে এবং অর্থনৈতিকভাবে অবদান রাখতে পারে। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ওপর গুরুত্ব দিয়ে স্বাস্থ্য সেবার ক্ষেত্রে সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার কথা বলা হয়েছিল। সেদিক থেকে দেখলে স্বাস্থ্য নীতিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার উল্লেখ সর্বশেষ খসড়ার (২০১০) লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের মধ্যে পাওয়া গেলেও এর কর্মকৌশল ও বাস্তবায়ন বিক্ষিপ্তভাবে করা হয়েছে। যার কারণে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা আলাদাভাবে একটি জোরালো কর্মসূচী আকারে ফুটে উঠছে না।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা জনগনের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছানোর প্রথম ধাপ, এবং ব্যক্তি, পরিবার ও কম্যুনিটির সাথে জাতীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবার সম্পর্ক স্থাপনের প্রথম স্তর। আলমা আতা ঘোষণা মতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সবচেয়ে জরুরী এবং এই সেবা পৌঁছানোর জন্যে এমন পদ্ধতি অবলম্বন করতে হবে যাতে জনগণের অংশ গ্রহন থাকবে এবং যা জনগনের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে থাকবে। জাতীয় স্বাস্থ্য নীতির খসড়া ২০১০-এ প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যের মধ্যে রাখা হয়েছে। বলা হয়েছে, 'প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা এবং গ্রাম, ইউনিয়ন ও উপজেলা পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য মানের চিকিৎসা ব্যবস্থার সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা'। আবার নীতিসমুহের মধ্যে উল্লেখ করা হয়েছে 'প্রাথমিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার অত্যাবশ্যকীয় সেবাগুলি বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ভুখন্ডের যে কোন ভৌগলিক অবস্থানের প্রত্যেক নাগরিকের কাছে পৌঁছে দেয়া'। কিন্তু কৌশল সমুহের মধ্যে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার কোন দিকনির্দেশনা নেই। অর্থাৎ লক্ষ্য ও মুলনীতিতে উল্লেখ থাকলেও কর্মকৌশলে কোন প্রতিফলন নেই।

প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা আলমা আতা ঘোষণা অনুযায়ী মোট সাতটি নিয়মের ওপর ভর করে আছে। এর মধ্যে রয়েছে,
ক। অর্থনৈতিক, সামাজিক-সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক অবস্থা এবং প্রাসঙ্গিক গবেষণা ও জনস্বাস্থ্য অভিজ্ঞতা।
খ। জনগনের প্রধান স্বাস্থ্য সমস্যা বিশেষ করে রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় এবং পুণর্বাসন সেবা ইত্যাদি।
গ। বিদ্যমান স্বাস্থ্য সমস্যা সংক্রান্ত স্বাস্থ্য শিক্ষা এবং প্রতিরোধ, খাদ্য সরবরাহ ও পুষ্টির নিশ্চয়তা; যথেষ্ট এবং নিরাপদ পানি সরবরাহ এবং পয়ঃনিষ্কাশন, মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য সেবা, পরিবার পরিকল্পনা; সংক্রামক রোগ প্রতিরোধে টিকা কর্মসূচী, বিশেষ এলাকাভিত্তিক রোগ নিয়ন্ত্রণ, সাধারণ রোগ ও আঘাতের চিকিৎসা এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সরবরাহ।
ঘ। স্বাস্থ্যবিভাগ ছাড়াও সকল সংশ্লিষ্ট বিভাগ যেমন কৃষি, পশুসম্পদ, খাদ্য, শিল্প, শিক্ষা, বাসস্থান, যোগাযোগ, গণপূর্ত বিভাগের কাজের সম্বন্বয় সাধন করা।
ঙ। প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জনগনের কার্যকর অংশগ্রহন এবং স্থানীয় ও জাতীয় পর্যায়ের সম্পদের সুষ্ঠু ব্যবহার।
চ। বিভিন্ন পর্যায়ের স্বাস্থ্য সেবার সাথে সম্বন্বিত ও সুষ্ঠু রেফারেল সেবার ব্যবস্থা করা।
ছ। সকল পর্যায়ের স্বাস্থ্য কর্মী, যেমন চিকিৎসক, নার্স, দাইমা, গ্রামীণ চিকিৎসক এবং কম্যুনিটি স্বাস্থ্য সেবা কর্মীদের প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ প্রদান করে সকলে মিলে যেন একটি টীমের মতো কাজ করতে পারে।
আলমা আতার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান হচ্ছে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার বিস্তারিত ও সম্বনিত ধারণা তৈরি। স্বাস্থ্য নীতিতে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার উল্লেখ আছে ঠিকই কিন্তু এর কোন সম্বন্বিত রূপ ফুটিয়ে তোলা হয় নি। ফলে বিক্ষিপ্তভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হয়েছে।

আলমা আতা ঘোষণায় জাতীয় পর্যায়ে ব্যাপক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য এবং অন্যান্য সংশ্লিষ্ট বিভাগের সাথে সম্বন্বয়ের জন্য জাতীয় স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করার প্রস্তাব করা হয় এবং এর জন্যে প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক অঙ্গীকার ও বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় জাতীয় তহবিল এবং বিদেশী অর্থ সংস্থানের ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এতো বছর পার হবার পরও কোন সরকারের পক্ষেই একটি স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন করা সম্ভব হয় নি। এর পক্ষে রাজনৈতিক অঙ্গীকারের যথেষ্ট অভাব ছিল। তবু ইতিহাস দেখলে কিছু ইতিবাচক উদ্যোগের কথা অবশ্যই বলা দরকার। যেমন ১৯৮২ সালের ওষুধ নীতি। এই ওষুধ নীতি বিশ্বের অনেক দেশেই প্রশংসিত হয়েছে, কারণ এর মধ্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ উৎপাদন ও বাজারজাতকরণ ইত্যাদি বিষয় এমনভাবে ছিল যা প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানের জন্য জরুরী। এরপর ১৯৯০ সালের স্বাস্থ্য নীতি প্রণীত হয়েছিল কিন্তু গ্রহণযোগ্য হয় নি, একে একে ২০০০ সাল, ২০০৬, ২০০৮ ও ২০০৯ সালের স্বাস্থ্য নীতি আমরা দেখেছি, কিন্তু এখনও কোনটাই সুর্যের আলো দেখতে পারে নি।

আমরা আশা করবো এবার স্বাস্থ্য নীতি প্রণীত হবার আগে জনগনের মতামত নেয়ার চেষ্টা করা হবে বিশেষ করে যারা স্বাস্থ্য নীতি পর্যালোচনা করছেন এবং নির্দিষ্টভাবে মতামত দিচ্ছেন। শক্তিশালী প্রাথমিক স্বাস্থ্য সেবার ব্যবস্থা রেখে স্বাস্থ্য নীতি প্রণয়ন অত্যন্ত জরুরী। একটি গণতান্ত্রিক সরকারের কাছে এই প্রত্যাশাটুকু আমরা করতে পারি।

ফরিদা আখতার : লেখক ও গবেষক।