একটি বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা (ঝাড় দেয়া, পানি দিয়ে মোছা, মাকড়সার ঝুল পরিষ্কার করা), রান্নাবান্না করা (মাছ তরকারি কাটা থেকে শুরু করে রান্না করা) সবই মূলত নিজের কাজ। আমার সংসারের কাজ কি অন্যজন এসে করে দেবে? সাধারণত দায়িত্ব গৃহ কর্ত্রীর ঘাড়ে বর্তায় । বাসার অন্যান্য মেয়ে সদস্যরাও অনেক সময় সাহায্য করে থাকে । আজকাল অনেক পুরুষরাও এসব কাজে সহযোগিতার হাতটি বাড়াতে চেষ্টা করেন ।
সকাল,দুপুর ,বিকাল,রাত এই চার বেলায় খাবারের আয়োজন তো গৃহিণীদের জন্য নিত্য দিনের ঘটনা । এছাড়া থালা বাসন মাজা, কাপড়চোপড় ধোয়াসহ অন্যান্য পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার কাজ তো লেগেই আছে। উনি যদি চাকুরিজীবী হন তবে তো ব্যাপারটা তালগোল পাকিয়ে যাবারই কথা। সংসার সামলানোর দায়িত্ব যে তাঁর কাঁধে। যত পারিপার্শ্বিক ব্যস্ততা কিংবা অসুস্থই থাকুন না কেন, সংসারের এই দায় গৃহিণীর রক্তের সাথে মিশে গেছে, এ ভাবনা এড়াবার নয়। তাই এ সকল কাজ সামলাতে একজন সহকারীর দরকার ।
এ ভবসংসারে আপনজন ছাড়া কে পাশে থাকে? আর কেই বা শুনে কার কথা।
জগতের সব সমস্যার সমাধান আছে। গৃহকর্ত্রীর সেই আপনজন হয়ে পাশে থাকে গৃহ কর্মী। অভাবের তাড়নায় সামান্য কয়টা টাকার বিনিময়ে শিশু এবং নারীরা এই কাজে যোগ দেয়। যে টাকায় কোন রেস্টুরেন্টে আপনার পরিবারের একবেলা খাবারের বিল দিতে লাগে, সে টাকায় তার সংসারের গৃহকর্ত্রীর পদ থেকে গৃহ কর্মী বানিয়ে দিলেন ।
ঘর মুছতে দেরি হওয়ায়, দেরিতে জবাব দেয়ায়, রান্না করতে দেরি হওয়ায় গৃহ কর্মীকে কেন দেহের বিভিন্ন স্থানে গরম খুন্তির ছ্যাকা দেওয়া হয়, তাকে বাথরুমে আটকে রাখা হয়। কেন বাড়ির কর্তা কিংবা অন্য পুরুষ সদস্যের মাঝে গৃহ কর্মী মেয়েটির অবৈধ সম্পর্ক হয়ে যায়? কিংবা কখনো তাকে ধর্ষিত হতে হয় দিনের পর দিন। যখনই এটা প্রকাশের ভয় শুরু হয়, তখনি চলে অমানুষিক নির্যাতন, কিংবা হত্যার পরিকল্পনা।
ক্ষুধার্ত রাখা ,বাথরুমে আটকে রাখা, যৌন নিপীড়ন, হত্যা, নির্মম প্রহার,নখ তুলে ফেলা,চুল কেটে ফেলা, বৈদুতিক শক, গরম কুন্তি বা ইস্ত্রির ছ্যাকা, গরম পানি ঢেলে দিয়ে শরীরের বিভিন্ন অংগ পুড়িয়ে দেওয়া যেন সাধারণ ঘটনা, সামান্য ভুলে চড়-থাপ্পড় দেয়া অনেকের জন্য ব্যাপারই না। অনেকে বলেন, নিজের সন্তান ভুল করলেও তো আমরা মারি, আর শাসন না করলে শিখবে কি করে? কারণ ছাড়া নাকি মানুষ মারে না, যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায় তখনি এ ব্যাপার ঘটে। এইসব নির্যাতনের ঘটনা শিক্ষক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, ব্যাবসায়ি, আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন কর্মকর্তাসহ নানান শিক্ষিত পরিবারের ঘটেছে এবং হয়ত এখনও ঘটছে । তাহলে দেখা যাচ্ছে সমস্যা আসলে পুঁথিগত শিক্ষার অভাবে নয় , যেখানে নৈতিক মূল্যবোধের অবক্ষয় ঘটে সেখানে ন্যায় নয়, অন্যায় কাজই ঘটে ।
অথচ আমরা চাইলেই এই মানুষটির পাশে থাকতে পারি। ক্ষুধা মেটানোর তাগিদে সামান্য কয়টা টাকার বিনিময়ে সে অন্যের সংসারের কাজ নেয়। এই দারিদ্রতার সুযোগ নিয়ে সমাজের ছোট্ট একটা অংশ তাদের উপর বর্বরতা চালায়। যার লজ্জার ভার আমাদের কাঁধেও পরে।
আমরা কি এই মানুষটিকে আমাদের পরিবারের একজন ভাবতে পারিনা? সে তো আপনার কাজটি করে দিচ্ছে , আপনাকে সাহায্য করছে । তবে কেন আপনি তার দিকে একটু সহমর্মিতার হাত বাড়াতে পারেন না? আমি এমনও পরিবার দেখেছি ,যাদের বাসায় খাবার পর্যাপ্ত ,অপচয় করছে ,কিন্তু বাড়ির কর্ত্রী গৃহ কর্মীকে খুব মেপে খাবার দেয় ।
আমি মনে করি একজন গৃহিণী চাইলে অনেক ভাবেই তার গৃহ কর্মীকে সাহায্য করতে পারেন। তার বিপদের কথা আপনাকে বলার অভয় দিতে পারেন । খুশী হয়ে আপনি তাকে ১০/২০ টাকা বকশিস দিতে পারেন, ভাল খাবার কেনার সামর্থ্য তার নেই ,কিন্তু আপনি দিতে পারেন , কত খাবারই তো আপনি খান। সেও আপনার মত রক্ত মাংসে গড়া মানুষ, তাই তার উপর অতিরিক্ত কাজের চাপ পড়ছে কিনা সেটা লক্ষ্য রাখা আপনার দায়িত্ব। সাধ্য অনুযায়ী পাশে থাকার চেষ্টা করুন। আপনার গৃহ কর্মীটি শিশু হলে তাকে পড়াশুনার দায়িত্ব নিন । আপনার ঘরের প্রতিটি মানুষের চরিত্র সম্পর্কে আপনি কম বেশী ওয়াকিবহাল । তাই আপনি অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে সতর্ক থাকুন ।
বিশেষ দিনে যেমন, ঈদের দিন , এইদিনে সেই গৃহ কর্মী কে আপনি ঈদ বোনাস দিতে পারেন , কারন আপনি তাকে ঈদের দিন অন্যান্য দিনের তুলনায় বেশী খাটান । স্বল্প মূল্যে তাকে কিংবা তার সন্তাকে পোশাক কিনে দিতে পারেন। দিতে পারেন এক প্যাকেট সেমাই, চিনি । খুব তো টাকা লাগে না। অল্প টাকা খরচ করে খুব সহজেই একটি মুখে হাসি ফুটাতে পারি ।
আমাদের সংবিধানের ১৪, ১৫ ১৭, ২৮, ৩৪ ও ৩৬ নং অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রের নাগরিক হিসেব গৃহ-শ্রমিকদের অধিকার উল্লেখ রয়েছে। তবে আমার জানা মতে গৃহশ্রমিকদের জন্য নির্দিষ্ট কোন আইন বা নীতিমালা নেই।
প্রথম আলোর একটি খবরে প্রকাশ, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে বাংলাদেশ থেকে নারী কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন সংশ্লিষ্ট অনেকে। অভিবাসন-বিষয়ক বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা এবং প্রবাসী বাংলাদেশিরা তাঁদের প্রাপ্ত তথ্য ও অভিজ্ঞতার কথা উল্লেখ করে বলেছেন, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশীয়, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। কাজেই বাংলাদেশের নারীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত না করে সে দেশে পাঠানো উচিত হবে না।
অভিবাসন-বিষয়ক বেসরকারি সংস্থাগুলো বলেছে, কর্মস্থলে নির্যাতনের কারণে ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কা যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন দেশটি বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে। কিন্তু নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সেখানে নারী গৃহকর্মী পাঠানো ঠিক হবে না।লেবাননে বাংলাদেশি নারীরা যে ভয়াবহ পরিস্থিতিতে পড়েছে, আমরা চাই না সৌদি আরবেও তারা সেই সমস্যায় পড়ুক। আমরা চাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করে নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো হোক।' 'অন্য দেশে গৃহকর্মীদের সাধারণ সমস্যা সাধারণত ঠিক সময়ে বেতন না হওয়া কিংবা ছুটি না পাওয়া। কিন্তু সৌদি আরবে এর বাইরেও নির্যাতন, ধর্ষণের ঘটনা ঘটছে নিয়মিত। আমরা সেখানে গৃহকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে ভয়াবহ এই চিত্র পেয়েছি।'
সৌদিতে না খাইয়ে রাখা , তাঁর হাতের নখ উপড়ে ফেলার মত অনেক ঘটনা ঘটেছে । যা আমাদের অজানা নয় । বাসার কাজ করার কথা বলে নিয়ে, সৌদি আরবে যাওয়ার পর তাঁকে একটি বাসায় আটকে নির্যাতন করা হয়। পুরুষ সদস্যরা তাঁকে ধর্ষণ করে ও চাবুক দিয়ে মারে। অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে একটি আশ্রয়কেন্দ্রে ফেলে আসা হয়। তাই গৃহ কর্মী পাঠানোর ব্যাপারে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন জরুরী ।
গৃহকর্মী নিবন্ধনের নিয়ম করা হবে বলে শ্রম মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। মানবাধিকার কমিশনের মহাসচিব দেলোয়ার বলেন, নিজ বাচ্চাকে মানুষ যেভাবে আদর করে ,সেরকম মনোভাব গৃহকর্মী শিশুদের প্রতি দেখাতে হবে।
অনেক সময় বাড়ির কর্তা ব্যক্তিরাও গৃহকর্মীর দ্বারা চুরি , ডাকাতি, ধর্ষণ, অপহরণ, খুন সহ নানাবিধ হয়রানীর শিকার হয় । এ ব্যাপারে নিজেদের সতর্কতা অনেক বেশি জরুরী । অপরিচিত কাউকে গৃহ কর্মী হিসেবে নিয়োগ না দেয়াই ভাল , কাউকে নিয়োগ দিলে ভাল করে তার সম্পর্কে খোঁজ নিতে হবে । তার আচার আচরণ অসংলগ্ন হলে প্রয়োজনীয় ব্যাবস্থা নিতে হবে । মনে রাখতে হবে নিজেদের অসতর্কতা যেন ক্ষতির কারন না হয়ে দাঁড়ায় ।
তথ্যসূত্র প্রথম আলো ও অন্যান্য ।
লিয়া সরকার ।