ওরা রাজাকার, ওদের বিচার চাই

লিয়া সরকার
Published : 5 Dec 2012, 06:09 AM
Updated : 5 Dec 2012, 06:09 AM

তাজরিন ফ্যাশনে এতগুলো মানুষকে কেন পুড়িয়ে মারা হল –

শ্রমিকদের বেতন দিতে চাচ্ছেন না ?

ব্যাংকঋণ পরিশোধ করতে চাচ্ছেন না ?

ইন্সুরেন্সের টাকা পেতে চাচ্ছেন ?

মালিক মশাই , প্রশ্নের জবাব দেওয়া আপনার পক্ষে সম্ভব ?
আমি ভাষা পাচ্ছি না , কি লিখব ? কি বলব ? কোন ভাষায় বললে এইসব কর্তা ব্যাক্তিদের কর্ণকুহরে পৌছবে আমার জানা নাই । কেন আগুনে পুড়ে মরতে হয়?কেন লাফিয়ে আত্তরক্ষার প্রয়োজন পরে ? আগুন লাগার সঙ্গে সঙ্গে গেট বন্ধ করে দেয়া হয়? কেন বলা হয় , আগুন লাগেনি , মহড়া চলছে ।

কেন যে আমরা প্রশ্ন করি , আপনার অসহায়ত্ব কেন যে আমরা বুঝি না , নতুন মডেলের গাড়ি কিনতে , বিদেশে বাড়ি কিনতে , বিবি সাহেবার গয়না কিনতে আপনি যে ফতুর হয়ে গেছেন । কিংবা নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে , বেতন না দেয়া , কিংবা আগুন লাগানো ছাড়া আর কি কোন উপায় আছে ? ওরা কি হাতে গোনা কোন মানুষ ?

বহুদুর পায়ে হেটে এসে বারো থেকে ষোলো ঘণ্টা কাজ করতে হয় তাদের। দুপুরে মাত্র আধঘণ্টা সময় দেয়া হয় খাবার জন্য । সকাল আটটায় যদি তাদের গার্মেন্টসে আসতে হয় তাহলে আরো ভোরে উঠে নিজ হাতে তাদের দুপুরের খাবার রান্না করে নিয়ে আসে। রাত দশটায় বেরিয়ে আবারও হেঁটে হেঁটে বাড়ি ফেরা। অমানবিক এই জীবনের বিনিময়ে তাদের প্রাপ্তি মাস গেলে মাত্র ১৬০০ বা ২০০০ টাকা! কত অল্প দামে কিনে নিলেন এদের স্বপ্ন গুলো । এই টাকাটাও মেরে দিতে ইচ্ছে করে আপনাদের ? মাস শেষে সাধারন মানুষের টাকার যে কি টানাটানি , সেটা কেন বুঝতে চান না ? কি করে মাসের পর মাস বেতন আটকে রাখেন ? ভাতের যে কি কষ্ট , কেন বোঝেন না ? কোন লাট বাহাদুরের বংশধর আপনারা ? দু তিন পুরুষ ঘাঁটলে শ্রমজীবী মানুষের সন্ধান আপনার পরিবারেই মিলবে । কি করে আপনি ওদের অবজ্ঞা করেন । যদি এমন দুর্ঘটনা আপনার জীবনে আসে , পারবেন তো সামাল দিতে ?

এই শ্রমিকেরা আসলে প্রকৃত দেশপ্রেমিক , এরা চুরি করে না , দুর্নীতি করে না , লুটপাটের চিন্তা করে না , হাড় ভাঙ্গা পরিশ্রম করে রোজগার করে । আর যারা এইসব দেশপ্রেমিককে পুড়িয়ে মেরেছে , তারা রাজাকার । মাননীয় প্রধান মন্ত্রী , আপনার কাছে বিনীত অনুরোধ , আপনি এর বিচার করুন ।

চার মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুরে ভয়াবহ অগ্নিকান্ডে ক্ষতিগ্রস্ত তাজরিন ফ্যাশনসের শ্রমিকরা বিক্ষোভ শুরু করেছে। এই সময় পুলিশের সঙ্গে শ্রমিকদের কয়েক দফায় সংঘর্ষ, ধাওয়া ও পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। সেখানে গিয়ে চলতি মাসের বেতন নিতে হবে। এ কথা শোনার পর শ্রমিকেরা চার মাসের বকেয়া বেতন না দিলে সেখানে যাবেন না বলে জানিয়ে দেয় । যখন ক্ষুধার্ত , শুকনো মুখে পাওনা আদায়ের জন্য আপনার বিরুদ্ধে শ্লোগান করে আপনার তখন লজ্জা লাগে না ? আপনার বিবেকে বাধে না ? এই পাওনা আদায়ের জন্য রাস্তায় নামতে হয়, মিছিল করতে হয় , পুলিশের লাঠি পেটা খেতে হয় ।

এ ধরনের মৃত্যুর কারণে , আজ পর্যন্ত কোন গার্মেন্টস মালিক অথবা মালিকপক্ষের কারও বিরুদ্ধে কোন মামলা হয়ছে করে আমার জানা নেই । কেন , তারা আইনের উর্ধ্বে ? বেশির ভাগ গার্মেন্টস মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ , তারা ব্যাংকের পুরো টাকা ফেরত দেয় না। এছাড়া বছরের পর বছর ট্যাক্স হলিডে, সরকারি অর্থাৎ জনগণের জমি লিজ নেয়াসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা তো রয়েছেই। শ্রমিকের মজুরি, ওভারটাইম ঠিকমতো দেয় না, এমনকি সরকার যে নিম্নতম মজুরি নির্ধারণ করেছে সেটাও নাকি দিচ্ছে না অনেক মালিক।

আগুন আগুন লাগার পর পোশাক কারখানাটির কর্মকর্তারা তালা মেরে চলে যান। তাদের কেউ আগুনে পুড়ে মারা যাননি। অগ্নিকাণ্ডের সময় মালিকপক্ষের কেউ কারখানায় আসেননি। তাই আগুনের ঘটনাকে পরিকল্পিত মনে না করার কোন কারন নেই ।

সরকারী বেসরকারী হিসাব কি জানি না , শুধু বলবো মৃত্যুর সংখ্যা আরও বেশি , নইলে এত নিখোঁজ কেন? নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় লাশ সরিয়ে ফেলা হয়েছে । যে মানুষটি সকালে কারখানায় কাজে এলো সে নিখোঁজ কেন হবে? সে মৃত। শুধু ক্ষতিপূরনের অংক বেড়ে যাবে বলে নিখোঁজের এই নাটক করা হচ্ছে ।

শনিবার সন্ধ্যায় আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর তাজরিন ফ্যাশন এবং সোমবার উত্তর খানের দু'টি গার্মেন্টসে আগুন লাগে। তাজরিন ফ্যাশনে আগুন লাগার একদিন পরই আশুলিয়ার ডেবোনিয়ার গার্মেন্টে ২০ হাজার টাকা নিয়ে আগুন লাগিয়ে দেন সুমি বেগম নামে ওই কারখানার এক নারীশ্রমিক। ওই ঘটনায় পুলিশ তাকে গ্রেফতার করেছে। তাই একের পর অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা পরিকল্পিত কিনা, তা খতিয়ে দেখা প্রয়োজন বলে মনে করছেন সচেতন মহল।

এই সুমি বেগম কি জজ মিয়ার উত্তরসূরি ? আমরা জানতে চাই ।

পোশাক কারখানায় তালা লাগানোর অভিযোগ বহু পুরনো। ২০০৬ সালে কেটিএস টেক্সটাইল অ্যান্ড গার্মেন্টসে আগুনের সময় তালা দেয়ার কথা আদালতে স্বীকার করেছিলেন এর মালিকরা। কিন্তু তারপরও এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে, কারণ এ দেশে অনায়ের বিচার হয় না । মালিকরা কোটি কোটি টাকা আমাদের রাজনৈতিক নেতা , সংশ্লিষ্ট লোকজনদের দিতে পারে , শ্রমিকরা পারে না । এসব ঘটনায় পুলিশ মামলা করে , ৬/৭ মাস তদন্তের পর প্রতিবেদনে বলা হয় ,
" শর্টসার্কিট থেকে আগুন লাগে , তবে দায়ী ব্যাক্তিদের শনাক্ত করা সম্ভব হয় নি "।

পোশাক কারখানায় আগুন লাগার ঘটনাকে পরিকল্পিত বলে উল্লেখ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, 'এটি দুর্ঘটনা নয়, পরিকল্পিত, এতে কোনো সন্দেহ নেই। এক নম্বরে পুলিশ, তারপর গার্মেন্টস। এরপর কিসের ওপর হামলা হবে, সেটা দেখতে হবে।'শেখ হাসিনা বলেন, 'রোববার ডেবোনেয়ার গার্মেন্টসে আগুন লাগানোর চেষ্টা করেছে চক্রান্তকারীরা। সুমি বেগম নামের এক নারী শ্রমিক কারখানায় আগুন দেয়। অন্য একজন তা দেখে ফেলায় সঙ্গে সঙ্গে আগুন নেভানো হয়। এ জন্য পুলিশ সুমি ও জাকির নামের দুজনকে গ্রেপ্তার করেছে। আমি সিসিটিভিতে ধারণ করা ভিডিওতে দেখেছি, সুমি আগুন দিয়ে বেরিয়ে আসছে। সুমি স্বীকার করেছে, মাত্র ২০ হাজার টাকার বিনিময়ে সে এ কাজটি করেছে। এর পেছনে কারা জড়িত, তাদের খুঁজে বের করতে হবে। যখন বায়াররা আসে, কনট্রাক্ট সই করা হয়, তখনই এ ঘটনা ঘটানো হলো।'

প্রধানমন্ত্রী বলেন, পাট থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসত। তাই স্বাধীনতার পর পাটের গুদামে আগুন লাগত। এখন তৈরি পোশাক থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আসে। তাই গার্মেন্টসে আগুন দেওয়া হচ্ছে। কিছু লোক আগুন লাগার পর দুর্ঘটনাকবলিতদের সাহায্য না করে পরিস্থিতি ঘোলাটে করার চেষ্টা করে।আশুলিয়ার অগ্নিকাণ্ডে জামায়াতে ইসলামী ও ছাত্রশিবির জড়িত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন তোফায়েল আহমেদ ।কি দুঃখের কথা , যেখানে জীবন মৃত্যুর খেলা , সেখানে লুকিয়ে আছে রাজনৈতিক ফায়দা ।

সাধারণ শ্রমিকদের শ্রমে,ঘামে,রক্তে পোশাক শিল্পের চাকাটা চলছে , উপার্জন করছে বৈদেশিক মুদ্রা। এদের মেরে আপনাদের কোন ফায়দা হাসিল হবে না । একের পর এক এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে পোশাক শিল্পের সর্বনাশ হতে আর দেরি হবে না। এসব ঘটনা কারা ঘটাচ্ছে তা দ্রুত বের করা উচিত ।

এতোবার কারখানায় আগুন লাগা ও শ্রমিক পুড়ে মরার ঘটনা ঘটার পরও কেন কারখানাগুলোতে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করা হয় না। যে কারখানায় যথোপযুক্ত অগ্নিনির্বাপন ব্যবস্থা নেই সেগুলো কিভাবে ব্যাংক ঋণ পায়, কিভাবে তাদের লাইসেন্স থাকে! আঙ্গুলটা কিন্তু সরকারের উপরই উঠে ।

জাতীয় শোক , ১-২ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়ে কি হবে ? এই মানুষগুলো কি জীবনে এই টুকু টাকা উপার্জন করতো । তাতে কি ওদের সংসার চলার নিশ্চয়তা আছে ?ক্ষতিপূরণ দিতে পারবে কি মা , বাবার , পুত্র , কন্যা , ভাই বোনের ভালবাসার , স্নেহ , মমতার? সব ক্ষতিপূরণ দেয়া সম্ভব হয় না । তবে পারেন বেঁচে থাকার মৌলিক চাহিদা গুলো নিশ্চিত করতে । এতটুকুই না হয় করুন ।

তথ্যসূত্র প্রথম আলো ও অন্যান্য ।

লিয়া সরকার ।