চার দেয়ালের ভেতরে নওশাদদের অন্যরূপ!

লিয়া সরকার
Published : 29 Jan 2013, 06:46 PM
Updated : 29 Jan 2013, 06:46 PM

" In a deep sense I am also alone "

স্বামীর মুঠোফোনে sent sms অপশনে এই ক্ষুদে বার্তাটি দেখে অপলক তাকিয়ে থাকে বেলা । এক মেয়ে বন্ধুকে পাঠানো ক্ষুদে বার্তায় এই কথাটি লিখেছে নওশাদ। বেলা শুধু ভাবতে থাকে দু বছরের সংসারে তার আত্মত্যাগের কথা । পারিবারিক ভাবে বিয়ে হয়েছে বেলার। মাস খানেকের পরিচয়ে বিয়ে হয়েছে তাদের। তাদের দেখা হয়েছে তিন/চার বার। সবার অজান্তে একবার দেখা করেছে তারা । কিছুটা সময় রেস্টুরেন্টে, নদীর ধারে বসে একান্তে কাটিয়েছে তারা। নওশাদের প্রবল মিনতির জন্য বেলা আপত্তি জানাতে পারেনি। দাম্পত্য জীবন শুরু করার পূর্বে মাস খানেক সময় পেয়েছে। এর মধ্যে মুঠো ফোনের কল্যাণে প্রতি রাত কত কথাই যে বলেছে তারা। রাত ফুরিয়ে যায়, কিন্তু তাদের ভালবাসার কথা ফুরায় না। বেলার পছন্দে সব জিনিস কিনে সংসার সাজাতে চায় নওশাদ। সংসারের সর্বত্রই থাকবে বেলার ছোঁয়া। বেলার জীবনে অনাগত সকল সমস্যা সমাধানের জন্যই নাকি নওশাদের জন্ম। নওশাদের এটুকু জীবনে অপ্রাপ্তির সকল কষ্ট মিটে যাবে বেলাকে পেলে। বেলার রূপ, চলন বলন সব পছন্দ নওশাদের। এমন জীবন সঙ্গীই খুঁজছিল নিজের জন্য। সুন্দর করে সংসার সাজাবে, ফুলে ফুলে, সুখে সুখে ভরিয়ে দিবে বেলার বাকীটা জীবন। হানিমুনে বেলা কোন দেশে যেতে চায়, এ নিয়েও ভাবনার অন্ত ছিল না নওশাদের। বিয়ের পর পরই তার কর্মস্থলে বেলাকে নিয়ে সংসার শুরু করবে। একটি দিনও অপচয় করতে চায় না নওশাদ। প্রতি ছুটির দিনে ঘুরে বেড়াবে, রেস্টুরেন্টে খাবে, শপিং করবে কত মজাই না করবে নওশাদ। বেলাকে কিন্তু অবশ্যই সেজে গুঁজে বের হতে হবে। কত কথার ফুলঝুরি নওশাদের, বলে শেষ করা যাবে না।

বেলা কিন্তু খরচের ব্যাপারে একদম কৃপণ হতে পারবে না কৃপণতা পছন্দ নয় নওশাদের। বেলাকে কিছুই করতে হবে না । সে শুধু তার সাথে তাল মেলাবে। বেলা কি এটুকু করতে পারবে না ? অবশ্যই পারব, আপাতত কণ্ঠে হ্যাঁ মেলায় বেলা। এসব বলে প্রতি রাত পার করেছে নওশাদ। স্বপ্নমুখী, আদুরে বেলার জীবনসঙ্গীর ব্যাপারে আর কোন দুশ্চিন্তা থাকার কথা নয়। তার প্রত্যাশার সাথে প্রাপ্তির তেমন কোন পার্থক্য থাকবে বলে মনে হয় না। প্রবাদে আছে বিয়ে তাকেই করা উচিত, যে তোমাকে ভালবাসে। এ বিয়েতে তাহলে কোন ভুল হবে না। বেলাকে উজার করে ভাল বাসতে চায় নওশাদ, এর চেয়ে সৌভাগ্যের বিষয় কি হতে পারে?

কিন্তু বাস্তবে বেলার ক্ষেত্রে এসব কিছুই ঘটল না। মেহেদীর রঙ, ঘ্রান যেতে না যেতেই বেলার টনক নড়ল, সে অনেক কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হয়েছে। যেখানে নওশাদের রূপ কঠিন মেজাজের। বেলাকে নিয়ে নেই তার কোন আয়োজন, নেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের কাজ। পরিবারের সাথে হেসে খেলে আটপৌরে জীবন কাটাচ্ছে নওশাদ। যেখানে বেলা একজন অনাকাঙ্ক্ষিত অতিথি। মধুচন্দ্রিমার লাজুক চাঁদ আজো উঠেনি বেলার জীবনে। একটি বারের জন্যও বেলাকে নব বঁধু হিসেবে সম্মান করেনি নওশাদ। একটি বারও বেলা, কিংবা দাম্পত্য জীবন নিয়ে নওশাদ কোন কথা বলে না। অফিস, বাসা, নিজের জগত আর আনমনে ঘুম এই নিয়ে ভাল আছে নওশাদ। বেলা সেখানে অযাচিত ।

কাঁন্না গোপন রাখতে পারছে না বেলা, লুকোতে পারে না বাধ ভাঙ্গা অশ্রুকে। নিজেকে একটু আড়াল করে নিঃশব্দে হাউমাউ করে কেঁদে হালকা হবার বৃথা চেষ্টা করে বেলা। হালকা হবার কোন উপায় নেই, এতো সবে শুরু। নববধূ বেলা বুঝে পায় না, কেন এমন হচ্ছে? বিয়ের সপ্তাহ খানেক পর নওশাদের কাছে এমন আচরণের কারণ জানতে চায় বেলা। জবাবে, নওশাদ অগ্নিমূর্তি হয়ে বলে, মুঠোফোনের আমি আর বাস্তবের আমি এক নই। ওসব বলতে ইচ্ছে করেছিল, তাই বলেছি। আমি এমনই, আমি কি তোমার জন্য নিজেকে বদলে ফেলব? তোমার স্বপ্ন জগত থেকে তুমি বরং বের হও। এই বলে নওশাদ কক্ষ থেকে বের হয়ে যায়। নিঃশব্দে ডুকরে ডুকরে কাঁদতে থাকে বেলা। কি করবে এখন বেলা? কাউকে বলে দুশ্চিন্তায় ফেলা যাবে না কিংবা নিজকে ছোট করা যাবে না। কিভাবেই বা সামাল দিবে নিজেকে?

এতসব ভাবনা অসহায় করে তুলল বেলাকে। নব বঁধু বেলার প্রতিটা দিন সকলের সাথে তালগোলে কাটিয়ে দিলেও প্রতিটা রাত সিক্ত হয় কান্নায়। পাশে নওশাদ নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে। বেলা ভেবে পায়না, কেন নওশাদ তাকে এত ভুলিয়ে ভালিয়ে বিয়ে করলো? এ প্রশ্নের উত্তর আজো খুঁজে বেড়ায় বেলা। এভাবেই পার হচ্ছে বেলার বছর তিনেকের সংসার। একটি বন্ধ ঘরে আটপৌরে জীবন কাটাচ্ছে বেলা । যেখানে সে নওশাদের মনের খোরাক হচ্ছে, তাকে দেখা শোনা করছে, সাংসারিক চাহিদা পূরণ করছে। অফিস থেকে ফিরে বেলার হাসি মাখা মুখ দেখতে চায়। সে সারাদিন পরিশ্রম করে আসে,এটুকু সে নাকি সে আশা করতেই পারে। সংসারের সমস্ত কাজ বেলা একা করা সত্তেও নওশাদের কাছে এগুলো কোন কাজই মনে হয় না, বেলা কি পরিশ্রান্ত পারে না? তার মন কি খারাপ থাকতে পারে না? কিন্তু নওশাদের কাছে এসব কথা মূল্যহীন। বেলাকে খুশি করার কোন চেষ্টাই করে না নওশাদ। বরং বেলা যখন নওশাদকে নিয়ে মায়ের বাড়ি যায়, কিংবা তার মা, ভাই বোন বেড়াতে আসে, তখন বেলাকে নানান কথা শোনায়। তার মন ভেঙ্গে দেয়। কিংবা অথিতিদের তেমন কোন খোঁজ রাখে না।

নওশাদের সমস্ত পছন্দ প্রতি মুহূর্তে চাপিয়ে দেয় বেলার কাঁধে। নওশাদের চোখে তার কোন ভুল নেই, সব কিছুতেই বেলার ভুল, বেলাকে এর মাশুল দিতে হয়। বন্ধুত্তের নামে নওশাদ মেয়ে বন্ধুদের সাথে সীমা পরিসীমা পার করে। কিছু ঘটে বেলার সামনে, বাকীটা হয়ত বা আড়ালে। এ নিয়ে কিছু বললেই বেলাকে খুব অপদস্থ হতে হয়। সে নাকি নিচু মনের, আর ও কত কি! কত যে অসম্মানজনক ঘটনা ঘটেছে বেলার এই এই দাম্পত্য জীবনে, বেলা চাইলেও ভুলতে পারছে না। অনেকবার সে বলেছে বেলাকে চলে যেতে, হাতও তুলেছে বেলার গায়ে। নওশাদ ভাবে, বেলা খাচ্ছে দাচ্ছে, ঘুমাচ্ছে, সংসার করছে, ঈদে নিজের জন্য পোশাক কিনছে, আর কি ই বা চাইবার আছে বেলার। বেলার কোনো কথা, যুক্তি নওশাদের ভাল লাগে না, যৌক্তিক মনে হয় না, আর কত দিন বেলাকে এমন অসম্মানিত হতে হবে বেলা জানে না।

এ সব ভাবতে ভাবতেই নওশাদের আগমন ঘটল। ক্ষুদে বার্তাটি দেখিয়ে জানতে চাইল, এটা কি ?

নওশাদ জবাব দেয়, এটা ক্ষুদে বার্তা ।

কেন লিখেছ ?

জবাব দিবে তো দুরের কথা, বলে, তুমি আমার মুঠো ফোন চেক করা শুরু করেছ? এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার, এসবে তুমি কেন হাত দিবে?

এত ছোট মনের মানুষ তুমি, ছিঃ ।

বেলা তাকে থামিয়ে বলে, স্ত্রীকে ছোট করা যেন কেউ তোমার কাছ থেকে শিখে। চলে যাও আমার কাছ থেকে।

নওশাদ চলে যায়। এভাবেই সপ্তাহ ধরে নির্বাক চলছে বেলার সংসার। বেলার মনে ভালবাসার কোন স্বপ্ন নেই, নেই কোন প্রতীক্ষা। বেলা জানে নওশাদকে ভালোবাসা বেলার পক্ষে আর সভব নয়। বেলার মনের সুপ্ত ভালবাসা অংকুরেই বিনষ্ট হয়ে গেছে। আর নওশাদের জন্য বেলার মনে জমে গেছে অনেক ক্ষোভ, আর ভালোবাসার প্রতি একরাশ অভিমান।

২৯ জানুয়ারী নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে পুরুষদের সমাবেশ ও শোভাযাত্রায় নওশাদ ও তার বন্ধুরা অংশ নিচ্ছে। অফিসে যেতে যেতে মুঠো ফোনে এসব নিশ্চিত করছে নওশাদ। বলছে, নারীর প্রতি সহিংসতা রোধে আমাদের জনমত গড়ার সময় এখনই। বেলা শুধু অপলক নেত্রে তাকিয়ে দেখছে নওশাদের চলে যাওয়ার দৃশ্য। এভাবেই চালিয়ে যায় নওশাদরা তাদের হিপোক্রেসির সামাজিকতা ।

বাস্তব সত্য কথাগুলো সকলের সাথে শেয়ার করলাম, শুধু নামগুলো কাল্পনিক। বেলা আমার খুব কাছের একজন। আমি জানি না বেলার জীবনটা এখন কোনদিকে মোড় নিবে। তবে এটুকু জানি, ভাগ্যের উপর ছেড়ে না দিয়ে বেলাকে শক্ত হাতে হাল ধরতে হবে। এভাবে জীবনকে চলতে দেয়া যায় না। জীবনেরও তো একটা প্রাণ আছে!

লিয়া সরকার ।