এম এ লতিফ লিমন
Published : 21 Jan 2013, 05:25 PM
Updated : 21 Jan 2013, 05:25 PM

মানুষের জীবন কত বিচিত্র হতে পারে ! মানুষ হয়ে জন্ম নিয়েও সে পায়না মানুষের স্বাদ । অপূর্ণ থেকে যায় তার জীবনের বড় পাওনাগুলো । এমন মানুষ জগতে অসংখ্য । কিন্তু আমরা কি কখনো মানুষ হয়ে মানুষের দুঃখ বুঝার চেষ্টা করেছি ? কখনো কি সেই দুক্ষকাতর মানুষগুলোকে স্নেহের বন্ধনে বেঁধেছি ?…না, বাঁধিনি । কারণ, আমরা মানুষ জাতি স্বার্থপর । এই সমাজ স্বার্থপর । স্বার্থপরতার জন্য মা-বাবা তার সন্তানকে দূরে ঠেলে দেয়, এক সহোদর আর এক সহোদরকে অস্বীকার করে ।

জীবনের এমন কঠিন বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে সেদিন আমি স্তব্দ হয়ে গিয়েছিলাম । যে বাস্তবতার কথা আগে কখনো কল্পনাতেও আসেনি । সেদিন আমার সমস্ত স্বত্তা শুধু একই ধ্বনি উচ্চারণ করেছিল, "বিধাতা, এ তোমার কেমন খেলা?"

আমি তখন মাত্র এইচ এস সি পরীক্ষা শেষ করেছি । পড়াশুনা থেকে ক্ষণকালের মুক্তির স্বাদ উপভোগ করার জন্য, আমার মেজু ভাইয়ের কর্মস্থল ঢাকায় তার বাসাতে চলে এসেছি । মেজু ভাই তখন অবিবাহিত ছিল । তাই তার বাসাটা ছিল পুরোপুরি খালি । তার মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির তরফ থেকে ৫০% ভাড়া পরিশোধ করা ফ্ল্যাটটি ছিল চমৎকার । ঢাকার মত জনাকীর্ণ শহরে এমন নিরিবিলি বাসা পাওয়াটা সত্যি দুষ্প্রাপ্য । কিন্তু গ্রামের মুক্ত পরিবেশ রেখে এখানে এসে আমার দম দুই দিনেই প্রায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছিল । প্রতিদিন সকালে উঠেই মেজুভাই অফিসে ছুটে । ফিরে আসে রাত দশটা নাগাদ । মাঝখানের এই সময়টা আমার কাটে শুধু বাসায় বসে বসে হলিউড-বলিউডের ছবি দেখে । মেজু ভাইয়ের নির্দেশে বাসার বাইরে বের হওয়াটাও আমার জন্য নিষেদ । সকালে বুয়া এসে রান্না করে ফ্রিজে রেখে যায়, দুপুরে তাই খাই । আর রাতে মেজু ভাই ফেরার পথে রেডি-ফুড কিনে বাসায় ফিরে ।

একদিন মেজুভাই অফিস থেকে ফোন করে জানাল যে, সে অফিসের কি একটা কাজে ঢাকার বাইরে গেছে, আজ রাতে বাসায় ফিরবেনা । তাই তার অফিসের এক পিয়নকে খাবার দিয়ে বাসায় পাঠিয়ে দিচ্ছে । পিয়নটি নাকি আজ রাতে বাসায় থাকবে ।

আমি বসে বসে টিভি দেখছিলাম । রাত ন'টা নাগাদ বাসার কলিংবেল বেজে উঠল । আমি দরজা খুলে প্রথমে একটু আশ্চর্য হলাম । কেননা আমি ভেবেছিলাম পিয়নটি নিশ্চয় কোন গুফওয়ালা, কর্কশ মুখশ্রীর লোক হবে । কিন্তু আমার পূর্ব-ধারনাকে মিথ্যা প্রমানিত করে অল্প বয়সের, কোমলকণ্ঠের তরুন পিয়নটি সালাম জানাল । আমি সালাম নিয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম । পিয়নটি প্রবেশের অনুমতির অপেক্ষা না করেই রুমের ভিতরে ঢুকে টেবিলের উপর খাবার রেখে গড়গড় করে বলে চলল- আমার নাম রহমত । বাড়ি সিরাজগঞ্জ । আপনার ভাই যে অফিসে চাকরি করে, সেই অফিসেই পিয়নের চাকরি করি । আপনার ভাই, মানে আমার বস খুব দয়ালু লোক । কয়েকবার করে আমার চাকরি প্রায় চলে গিয়েছিল । বসের দয়ায় এখনো টিকে আছি ।

আমার আকস্মিকতা যখন কাটল ততক্ষণে তরুনটির প্রতি আমার কেন যেন একটা মায়া পরে গেছে । কিন্তু আমার একটু অস্বস্থি লাগছে এজন্যই যে, তার আচার-আচরণ, হাটার ধরন কেমন যেন অনেকটা মেয়ে মানুষের মত এবং শুরু থেকেই সে আমাকে আপনি করে সম্ভোধন করছে । আমাকে আমার সমবয়সী বা বড় কেউ আপনি করে ডাকলে খুব অস্বস্থি বোধ হয় ।
আমি বললাম, রহমত ভাই, আপনি আমাকে তুমি করে বলবেন । কারণ আমি আপনার বয়সে ছোট ।

রহমত ভাই প্রতিউত্তরে বলল, না- তা কেমন করে হয়? আপনি হলেন আমার বসের ছোট ভাই । আমি কি আপনাকে তুমি করে বলতে পারি ?

আমি আর কথা বাড়ালাম না । শুধু ভাবতে লাগলাম একটা সামান্য পিয়ন এত সুন্দর করে, শুদ্ধ করে কথা বলতে পারে !!! নিশ্চয় সে কোন ভদ্র ঘরের সন্তান । ভাগ্যচক্রে আজ এখানে পিয়নের চাকরি করতে হচ্ছে ।

রাতে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে রহমত ভাই আর আমি একসাথে বসে টিভি দেখতে বসলাম । এতদিন একা একা খুব বোরিং লাগছিল । আজ আমার প্রায় সমবয়সী একজনকে পেয়ে জমিয়ে আড্ডা দিলাম । আমিও খুব আড্ডাবাজ ছেলে আর রহমত ভাইকেও মনে হল খুব রসিক এবং মজার লোক । অনেকক্ষণ আড্ডা মেরে আমি রুমে শুতে গেলাম । আর রহমত ভাইও গেস্ট রুমে গিয়ে শুয়ে পড়ল । শুবার পরপরি আমি একেবারে ঘুমের স্বর্গরাজ্যে চলে গেলাম ।

হঠাৎ ঘুমের মাঝখানে আমার দেহে হালকা কোমল হাতের স্পর্শ পেলাম । প্রথমে মনে হল যে, এটা স্বপ্নের কোন ব্যাপার । কিন্তু ঘন ঘন হাতের ছোঁয়ায় পরক্ষনেই বুঝতে পারলাম, এটা স্বপ্ন নয়, বাস্তব । ভয়ে হকচকিয়ে উঠে আমি টেবিল ল্যাম্প জ্বালালাম । লাইট জ্বালিয়েই আমি স্তব্ধ হয়ে গেলাম । আমি আমার চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিলামনা । মনে মনে আমি স্বপ্ন ও বাস্তবের মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের চেষ্টা করছিলাম । আমি দেখি যে, রহমত ভাই আমার বিছানায় আমারই পাশে আধাশুয়া অবস্থায় চরম উত্তেজনায় কাঁপছে । এই অবস্থা দেখে আমার ধাতস্থ হতে কিছুটা সময় লাগল ।

আমি ভিতকন্ঠে জিজ্ঞাস করলাম, রহমত ভাই, আপনি আমার বিছানায় কেন ?
রহমত ভাই অপ্রকৃতস্থভাবে কিছুক্ষণ নীরব থেকে হাউমাউ করে কেঁদে উঠল । আমি কিছুই বুঝতে পারলামনা । শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলাম । কিন্তু এইটুকু উপলব্ধি করতে পারলাম যে, এই কান্না এক অর্থবহ দুঃখের কান্না ।
রহমত ভাই আদ্রচোখে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আমকে মাফ করে দিন । আমি আসলে নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছিলামনা । আমার এই দেহটার কারনে আমার মরে যেতে ইচ্ছে করে ।
আমি বললাম, কেন ? আপনি এমন করছেন কেন ?

রহমত ভাই নির্লিপ্তভাবে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে জবাব দিলেন, আমি হিজড়া ।

কথাটা শোনামাত্রই আমার কেমন যেন অস্থরতা কাজ করছিল । রহমত ভাইকে নিজের স্বজাতি মনে হচ্ছিলনা । মনে হচ্ছিল অচেনা ভিনগ্রহের কোন প্রানি । কথাটা যে আগে কখনো শুনিনি টা নয় । কিন্তু আমার সামনে হিজড়া শব্দটা আজ যেন তার দৈহিক কাঠামো নিয়ে জীবন্ত আস্ফালন করছে । আমি বাকরুদ্ধ হয়ে রইলাম ।

আমি রহমত ভাইয়ের দিকে তাকাতে পারছিলামনা । বুঝতে পারছিলাম তার বুকের ভিতরটা অনুশোচনায় পুড়ছে । আমি শুধু কষ্ট করে বললাম, তাহলে আপনি এই অফিসে কি করে চাকরি করেন ?

আমার কথার পর বেশ কিছুক্ষন নিরবতা । রহমত ভাই নিজের কষ্টের কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তার কান্নার সব বাঁধ ভেঙ্গে গেছে । তাই নিজেকে সামলাতে পারছেনা । তাপরও নিজেকে কিছুটা সামলে নিয়ে বলল, আমি কোন খারাপ ছেলে না ভাই । আমার পরিবার উচ্চবংশ । এস এস সি পর্যন্ত পড়ালেখার পরেই আমার দৈহিক-মানসিক ত্রুটির কথা সমাজের লোকেরা জেনে যায় । সমাজের ভয়ে আমার পরিবার আপনজন আমাকে পরিত্যাগ করে । আমাকে সংসার থেকে জোর করে তাড়িয়ে দেয় । আমি বাঁচার তাগিদে এই ঢাকাতে চলে আসি । কোনভাবে একটা পিয়নের চাকরি যোগার করি । আমি অন্য দশটা হিজড়া থেকে ভিন্নভাবে বাঁচার জন্য প্রতিমুহূর্তে জীবনের সাথে লড়াই করে যাচ্ছি । হয়তোবা অফিসেও একদিন সবাই জেনে যাবে । তারপর আমার স্থান হবে রাস্তায় । লোকে আমাকে নিয়ে হাসি-তামাশা করবে, আমাকে কুপ্রস্তাব দিবে কিংবা বাধ্য হয়ে আমাকে আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে হবে ।
রহমত ভাই আমার সামনে আর দাঁড়াতে পারলনা । চোখ মুছতে মুছতে চলে যায় ।

আমি শুধু তার প্রস্থানের দিকে চেয়ে রইলাম । কোন কিছু ভাবতে পারছিলামনা । প্রকৃতির এতবড় একটা অসংগতি বাস্তবে আমার সামনে উন্মোচিত হওয়ায় আমার সমস্ত অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে গিয়েছিল । রহমতের মত সহস্র মানুষ স্রষ্টার অজানা খেয়ালে ত্রুটিপূর্ণ মনো-দৈহিক কাঠামো নিয়ে পৃথিবীতে জন্মগ্রহন করার পর পরিবারের স্নেহ-মায়া-মমতা থেকে হচ্ছে বঞ্চিত । সমাজ থেকে হচ্ছে নিগৃহীত । কেউ কি তাদের দুঃখের কথা ভাবে ? আমিও হয়তোবা কিছুদিন পর ভূলে যাব। রহমতের মত কোন সন্তান আমার ঘরে জন্ম নিলে হয়তোবা তাকে আঁতুড় ঘরেই বিষ খাইয়ে মেরে ফেলব নতুবা অস্বীকার করব । কিন্তু এই মানুষগুলোর কি মানুষ হিসাবে বাঁচার অধিকার নেই ? জীবনের স্বাদরঙ কি তাদের জন্য নিষিদ্ধ? পিতামাতার স্নেহ থেকে তারা কি সবসময় বঞ্চিত হবে ? তাদের দৈহিক তৃপ্তিটা কি সারাজীবন অপূরণীয় থেকে যাবে ? না- আমি আর ভাবতে পারছিনা । সেই রাত আমার নির্ঘুম কেটেছিল ।

কিন্তু এখনো অনেক রাতে রহমতের মত হাজারটা হাতের স্পর্শে আমার মাঝে মাঝে ঘুম ভেঙ্গে যায় । তখন আমার মনে একটা আর্তনাদই প্রতিধ্বনিত হয়- হে সৃষ্টিকর্তা, এ তোমার কেমন সৃষ্টি ? হে মানুষ, তোমরা কি পারনা, রহমতের মত মানুষদেরকে একটু সহানুভূতি দিতে…।