অক্টোবর বিপ্লব ও নারীমুক্তি

জাহান-ই-গুলশান
Published : 22 Nov 2011, 02:42 PM
Updated : 30 Oct 2017, 01:45 PM

১৯১৭ থেকে ২০১৭। একশ বছর। মহান অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের মানে শ্রমিক-কৃষক মেহনতি মানুষের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের সংগ্রামের শততম বছর। যদিও আজ আর সেই সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন নেই। নেই সেই শ্রমিক-কৃষকের বলশেভিক সরকার। তব্ আজও বিশ্বের নিপীড়িত জাতি, জনগণের শোষণমুক্তির লড়াইয়ে সেই সোভিয়েত ইউনিয়ন এক বড় আকাঙ্ক্ষার নাম। মানুষের ইতিহাসে নতুন এক রাজনৈতিক-সামাজিক শক্তির যে উত্থান লেনিনের বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে বিশ্ব দেখেছিল তা আজও আমাদের নাড়া দেয়। আমাদের শৈশবে যখন রাজনীতি সমাজনীতির লেশমাত্র বুঝি না, তখন বাড়িতে রাখা 'দৈনিক সংবাদ'এ ছাপা খবর নিয়ে বড়দের আনন্দ-আলোচনা আর বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া চাচাদের কাছে মানুষে মানুষে ভেদাভেদমুক্ত এক দেশের গল্প শুনে বড় বিস্ময় জেগেছিল আমার। মনে আছে বাবা আমাদের একবার একটা প্লাস্টিকের গ্লোব কিনে দিয়েছিলেন। ভূগোলে আমার আগ্রহ বরাবরই কম। গল্পের উত্তর মেরু দক্ষিণ মেরু দেখাতে বাবা যখন সেই গ্লোবটা নিয়ে আমাদের দুভাইবোনকে বসলেন, আমি কেবল সোভিয়েত ইউনিয়ন দেশটা দেখতে চেয়েছিলাম। আর এত জায়গাজুড়ে আঁকা সোভিয়েতের ম্যাপটা দেখে যারপরনাই অবাক হয়েছিলাম। আশির মাঝামাঝিতে বেড়ে ওঠা আমাদের শৈশবের মতো কোটি কোটি মানুষ ১৯১৭ সালের অক্টোবর বিপ্লরেব সাফল্যে উদ্বেলিত হয়েছিলেন। আবার সেই সোভিয়েত পতনে বুকফাটা কষ্ট্ও পেয়েছিলেন। একই ঘটনায় স্বপ্ন পূরণ ও তা ভেঙে যাবার নির্মম বেদনা নিয়ে বিশ্বের দেশে দেশে কোটি কোটি মানুষ আজও অক্টোবর বিপ্লবের স্মরণ করেন। আবারও আশায় বুক বাঁধতে চান। কান পেতে রাখেন যেন মায়কোভস্কির কবিতার মতো আবারও কোনো এক লেনিন বলে উঠবেন, "ইউ ভয়েজ/দ্য উইল/অব দ্য টয়লার/এন্ড দ্য টিলার/অব দ্য হোল ্ওয়ার্ল্ড।"

[আমরাই উচ্চারণ করেছি দুনিয়ার শ্রমজীবী-কৃষিজীবীর আকাঙ্ক্ষা।]

আর তাই ২০১৭ সালে এসেও অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আলোচনার দাবি রাখে।

বিপ্লবকালে রাশিয়ায় প্রচলিত জুভেনাইল ক্যলেন্ডার অনুযায়ী ১৯১৭ সালের ২৫ অক্টোবরে বিপ্লব সংঘটিত হয় বলে এর নামকরণ অক্টোবর সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব। তবে অনেকে বলশেভিক বিপ্লব আবার অনেকে নতুন গ্রেগরিয়ান ক্যলেন্ডারের হিসেবে নভেম্বর বিপ্লব নামেও অভিহিত করে থাকেন। তবে যে নামেই ডাকা হোক না কেন, 'শান্তি, রুটি ও জমি'র দাবিতে গড়ে ওঠা রুশ বিপ্লব কোনো স্বতস্ফুর্ত অভ্যুত্থান মাত্র ছিল না। বরং তিনশ বছরের পুরনো রোমানভ রাজবংশের জারদের বিরুদ্ধে, অভিজাত ও সামন্তদের বিরুদ্ধে এক সংগঠিত দীর্ঘ লড়াইয়ের চূড়ান্ত পরিণতি ঘটেছিল অক্টোবর বিপ্লবের মধ্য দিয়ে।

আক্টোবর বিপ্লবের অন্যতম সূতিকাগার ছিল ১৯০৫ সালের ২২ জানুয়ারির রক্তক্ষয়ী বিদ্রোহ যা ইতিহাসে 'ব্লাডি সানডে' নামে পরিচিত। জার দ্বিতীয় নিকোলাসের শাসনের বিরুদ্ধে তরুণ ফাদার গ্যাপনের নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষকরা তাদের দাবি-দ্ওায়া নিয়ে প্রতিবাদ মিছিল করে। জারের পেটোয়া বাহিনী সেই মিছিলে আক্রমণ করলে বহু লোক মারা যান। এ ঘটনার প্রতিবাদে রাশিয়ায় ধর্মঘট হয়। দাবি ওঠে পার্লামেন্টের। এরপর নানা ঘটনাপ্রবাহে ইতিহাস্ও নানা বাঁক নেয়। পরিস্থিতি তপ্ত হয়ে ওঠে যখন ১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধে জার দ্বিতীয় নিকোলাস অনুন্নত রাশিয়ার নাম লেখান। শুধু তাই নয়, সৈন্যদের পাশাপাশি সাধারণ কৃষকদের কোনো রকম প্রশিক্ষণ এমনকি অস্ত্র, খাবার ও জুতো ছাড়াই যুদ্ধে যেতে বাধ্য করেন। আর এতে প্রায় ৯০ লাখ রাশিয়ার সৈন্য এবং ৭০ লাখ বেসামরিক মানুষ নিহত হন। এসব হতাহত পরিবারগুলোর দিন কাটতে থাকে অনাহারে বা অর্ধাহারে। জমিদাররাও কৃষকদের জমি থেকে তাড়িয়ে দিতে থাকে।

ফলে যুদ্ধাহত ও জমি থেকে উচ্ছেদ হ্ওয়া কৃষক পরিবারগুলো শহরে কাজ খুঁজতে আসেন। কেননা কিছু কিছু শহরে বস্ত্র ও অন্যন্য হাল্কা শিল্প স্থাপন হতে শুরু করে। এতে মূলত নারীরা কাজ নেন। এই নারী শ্রমিকরাই ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি বিপ্লবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ২৩ ফেরুয়ারি ১৯১৭তে আর্ন্তজাতিক নারী দিবসে (জুভেনাইল ক্যলেন্ডার অনুযায়ী ৮ মার্চ) হাজার হাজার শ্রমিক নারী রাস্তায় নেমে আসেন। তারা কারখানা বন্ধ করে পুরুষ শ্রমিকদেরও মিছিলে অংশগ্রহণের আহবান জানান। এতে প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক এতে যোগ দেন। তারা যুদ্ধ বন্ধের দাবির পাশাপাশি রুটি এবং নিত্যপণ্যেরও দাম কমানোর দাবি জানান। যদিও বুর্জোয়া ঐতিহাসিকরা নারী শ্রমিকদের নেতৃত্বে সংঘটিত এ লড়াকু বিক্ষোভকে বলেন, 'খাদ্যদাঙ্গা'। এরপর ২৪ থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি শ্রমিক ধর্মঘট ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং অন্যান্য শহরেও ছড়িয়ে পড়ে।। সৈনিকরা বিক্ষোভকারীদের সমর্থন দেয়। তবে ২৬ ফেব্রুয়ারি জারের নির্দেশে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ১৬৯ জন শ্রমিক মারা যান। ২৮ ফেব্রুয়ারি বিপ্লবী জনতা মস্কো শহর দখল করে এবং সাময়িক কমিটি গঠিত হয়। আর মার্চের ২ তারিখে সাময়িক সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে রাশিয়ায় জারতন্ত্রের অবসান ঘটে।

ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের অর্জনের মধ্য দিয়ে রাশিয়া অক্টোবর বিপ্লবের পথে আরও এগিয়ে যায়। ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাশিয়ার রাজনীতি ও আন্দোলনে দ্রুত নানা মাত্রা যুক্ত হতে থাকে। এদিকে সাময়িক সরকার জনতার স্বার্থরক্ষার বদলে গোপনে যুদ্ধে জড়ানোর চুক্তি করে। ফলে যুদ্ধমন্ত্রী গুচকভ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন এবং কেরেনস্কিকে তার স্থলাভিষিক্ত করা হয়।

এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। ১৯১৭ সালের ১০ অক্টোবর বলশেভিক পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি লেনিনের প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং সাময়িক সরকার উচ্ছেদের সিন্ধান্ত নেয়। তবে তা ফাঁস হয়ে যায়। এদিকে ১২ অক্টোবর পেত্রোগ্রাদে অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেবার জন্য 'সোভিয়েত বিপ্লবী সামরিক কমিটি' গঠিত হয়। ২৩ অক্টোবর পর্যন্ত বলশেভিকরা সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতা দেবার দাবিতে শ্রমিক-কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক প্রচারণা চালায়। ২৪ অক্টোবর সরকার বলশেভিক পার্টির হেডকোয়ার্টার স্মেলনিতে অভিযান চালায়। সেই রাতেই রেডগার্ড শহরের গুরুত্বপূর্ণ স্থানের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নেয়। লেনিন স্মেলনিতে উপস্থিত হয়ে সরাসরি অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেন। ২৫ অক্টোবর সন্ধ্যায় দ্বিতীয় সর্ব-রাশিয়া কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলে, লেনিন সোভিয়েতের হাতে ক্ষমতার ঘোষণা দেন। ২৬ অক্টোবর শীত-প্রাসাদ দখল করে নেয় বলশেভিকরা। লেনিনের নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠনের মধ্য দিয়ে মানবেতিহাসের এক নতুন অধ্যায়ের যাত্রা শুরু হয়।

এ কথা অনস্বীকার্য যে, অক্টোবর বিপ্লবের চড়াৎ-উৎরাই পেরুনো পথে নারীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। বিপ্লবের আগে, বিপ্লব চলার সময় এমনকি বিপ্লব-পরবর্তী সোভিয়েত প্রতিষ্ঠায় শ্রমিক-কৃষক ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী নারীরা অসামান্য অবদান রাখেন। বলশেভিকদের বিপ্লবের বার্তা শ্রমিক ও কৃষক নরীদের মধ্যে পৌঁছে দিতে মূলত কাজ করেন শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী নারীরা। তাদের অন্যতম ছিলেন, আলেকজান্দ্রা কোলোনতাই, নাদেজদা ক্রুপস্কায়া, রোজা লুক্সেমবার্গ, ইনেসা আরমান্দ, ক্লারা জেটকিন প্রমুখ। সে সময় তাদের বুর্জোয়া নারীবাদ ও মেনশেভিকদের মতবাদের বিরুদ্ধ্ওে আদর্শগত লড়াই চালাতে হয়। ১৯১৪ সালে নারী শ্রমিক পত্রিকা 'রাবোৎনিস্তা' প্রকাশিত হয়। 'রেড সিস্টার্স' খ্যাত নারীরা মিলিশিয়া হিসেবে কাজ করতেন। সিভিল ওয়ারের দিনগুলোতে ৮০ হাজার নারী রেড ফোর্সে যুক্ত ছিলেন। বলশেভিক পার্টির নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক নারীরা ব্যাপকভাবে রাজনৈতিক কাজে ও উৎপাদনে অংশগ্রহণ করেন।

মার্কসবাদের দার্শণনিক ভিত্তির উপর দাঁড়ানো অক্টোবর বিপ্লব প্রথমবারের মতো কেবল কৃষক-শ্রমিকের শাসন কায়েম করেনি, বরং নারীদের জন্য্ও এক উন্নত, মর্যাদাপূর্ণ, সমানাধিকারভিত্তিক জীবন বিনির্মাণ করেছিল। সৃষ্টি করেছিল নতুন মানুষ। জারের রাশিয়ার উৎপাদন ব্যবস্থা ছিল সামন্ততান্ত্রিক। ফলে পারিবারিক, সামাজিক জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সামন্ত সংস্কৃতিই প্রাধান্য বিস্তার করত। 'পরিবারের মধ্যে পুরুষ হচ্ছে বুর্জোয়া আর নারী হচ্ছে প্রলেতারিয়েত'– অ্যাঙ্গেলসের এ কথার প্রতিচ্ছবিই যেন সে সময় রাশিয়ার নারীদের জীবনে দেখা যায়।

বিপ্লব-পূর্ব রাশিয়ায় মেয়েদের শিক্ষাগ্রহণের তেমন সুযোগ ছিল না। কেবল উচ্চ ও মধ্যবিত্ত নারীদের কিছু অংশ উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করতে পারতেন। কিন্তু কৃষক শ্রমিক নারীদের সুগৃহিণী হবার জন্য ঘরকন্নার কাজ শেখানো হত। মাতৃ ও শিশুমৃত্যুর হার ছিল অনেক বেশি। বিবাহিত নারীর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব স্বীকার করা হতো না। এমনকি বাড়ির বাইরে একাকী কোনো নারী বেরুলে তাকে পুলিশ অপরাধী হিসেবে আটক করত। নারীদের নামে পাসপোর্ট পর্যন্ত ইস্যু করা হত না।

সন্তান প্রতিপালন ও ঘরকন্নার কাজেই নারীদের আটকে থাকতে হত। লেনিন যেমনটি বলেছেন– 'নারীর গার্হস্থ্য জীবন হল হাজার রকমের সামান্য সামান্য বিষয় নিয়ে প্রতিদিনের আত্মত্যাগ'– আর এ আত্মত্যাগের দিকটি এমনকি সবসময় বর্তমান সময়ের মতো জারের রাশিয়াত্ওে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে দেখা হত। ফলে কী পরিবারে, কী সমাজে, কী রাষ্ট্রীয় আইনে নারীকে পরিপূর্ণ মানুষ হিসেবে বিকশিত হবার ব্যবস্থায় ছিল না। বরং পতিতাবৃত্তি সরকারি আইন দ্বারা পরিচালিত হত। তাদের কোনো নাগরিক অধিকার ছিল না। তখন পাসপোর্টের পরিবর্তে পতিতাদের হলুদ কার্ড দেওয়া হত। কোনো নারী যদি একবার হলুদ কার্ড নিতে বাধ্য হতেন তবে সারাজীবন তিনি পতিতাবৃত্তি থেকে বের হতে পারতেন না।

এমন দুর্বিষহ অবস্থা থেকে নারীদের মুক্ত করতে অক্টোবর বিপ্লবের পরপরই সোভিয়েত সরকার যুগান্তকারী সব পদক্ষেপ নেয়। সম্পত্তিতে, শিক্ষায় ও চাকরিতে তাদের কোনো শর্ত ছাড়াই সমানাধিকার প্রদান করা হয়। নারী পুরুষ উভয়ের জন্যই ন্যূনতম মজুরি এবং আট ঘণ্টা কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা হয়। নারীদের সামাজিক উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় যুক্ত করতে, রান্নাঘর ও আঁতুড়ঘরের বোঝা দূর করতে যৌথ রান্না, লন্ড্রি, শিশুদের জন্য কিন্ডারগার্টেন করা হয়। পুরো বেতনে মাতৃত্বকালীন ছুটির পাশাপাশি প্রসূতি মায়েদের জন্য পার্টটাইম চাকুরী এমনকি কর্মক্ষেত্র থেকে তিন ঘণ্টা পরপর শিশুকে মাতৃদুগ্ধ খ্ওায়ানোর জন্য ছুটি দেওয়া হয়। এছাড়া ঋতৃস্রাবের সময় মেয়েদেও ঐচ্ছিক ছুটির নেবার বিধান্ও রাখা হয়। পাশাপাশি নারীদের জন্য রাতের কাজ নিষিদ্ধ করা হয়। গর্ভবতী নারীদের জন্য নিয়মিত বিনামূল্যে স্বাস্থ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। নবজাতক সন্তানকে ২ মাস থেকে ৫ বছর পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় ব্যয়ে প্রতিপালনের ব্যবস্থাও তখন চালু হল।

বিপ্লবের পরপরই ১৯১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে সিভিল ম্যারেজ বা লৌকিক বিয়ে চালু করা হয়। নতুন পারিবারিক এ আইন রাশিয়ার আইনবিদ জেনিয়া বেলোশোভার ভাষায়, 'পছন্দ করার স্বাধীনতা এবং প্রীতি, পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও সমানাধিকারভিত্তিক সোভিয়েত পরিবারের ভিত্তি' হিসেবে উল্লেখ করেছেন। বিয়েবিচ্ছেদের বেলায় নারী পুরুষের মতামতে প্রাধান্য দিয়ে তা সহজীকরণ করা হয়। বিয়ে ও বিয়েবর্হিভূত সন্তানের প্রতি বৈষম্য দূর করে একই দৃষ্টিতে দেখা হয়।

শিক্ষাক্ষেত্রে সমান সুযোগ সৃষ্টি করে দেওয়ায় ১৯৩২ সালের মধ্যে ৮৪ শতাংশ নারী শিক্ষিত হয়ে ওঠেন। শুধ তাই নয়, রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক গুরুত্বপূর্ণ কাজে নারীদের অংশগ্রহণ তাক লাগিয়ে দেয়। ১৯৩৮ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায় যে, বড় বড় শিল্পে প্রায় ৪০ শতাংশ, চিকিৎসা গবেষণায় ৫০ মতাংশ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪৩.১ শতাংশ নারী নিযুক্ত ছিলেন।উৎপাদনের উপকরণগুলো সামাজিক মালিকানা স্থাপিত হ্ওয়ায় নারী পুরুষের মধ্যে কাজের ভেদাভেদ দূর হয়। ফলে ১৯৩৩-৩৪ সালে সোভিয়েতের মেয়েরা ট্রাক্টর, কম্বাইন চালাতে শুরু করেন।

পতিতাবৃত্তি বন্ধে ১৯২৫ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন 'পতিতাবৃত্তির বিরুদ্ধে সংগ্রাম কর্মসূচী' হাতে নেয়। যৌনকর্মীদের জন্য কাজ, শিক্ষা ও ট্রেনিংএর ব্যবস্থা করা হয়। এরপর সোভিয়েত সরকার আরেকটি অনন্য ডিক্রি জারি করেন। যখনই কোনো কর্মকর্তা পানশালায় বা রাস্তায় যৌনকর্মীদের খোঁজে অভিযান চালাত, তখন সেখানে উপস্থিত সব পুরুষদের নাম, বাড়ি ও কর্মস্থলের ঠিকানা লিখে নেওয়া হত। তবে খদ্দেরদের আটক করা হত না। পরদিন জনবহুল কোনো এলাকায় তাদের নাম-পরিচয় জানিয়ে বড়বড় অক্ষরে লিখে দেওয়া হত 'নারীদেহের ক্রেতা'। বেশ কয়েক দিন আবার সেই পোস্টার টানানো থাকত। এতে পরবর্তীতে যৌনরোগবিরোধী অভিযান্ও দারুণভাবে সফল হয়। এমনকি ১৯৩১ সালের শেষদিকে সিফিলিস, গণোরিয়া ও অন্যন্য যৌনরোগে আক্রান্ত রোগীর অভাবে বহু ক্লিনিক সরকার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।

এছাড়া সোভিয়েতের নারীরা ফ্রান্সে (১৯৪৪ সালে), যুক্তরাষ্ট্রে (১৯২০ সালে) এবং যুক্তরাজ্যের (১৯২৮ সালে) আগেই ভোটাধিকার অর্জন করেন। সেটি ওই ১৯১৭ সালেরই ঘটনা। নারীমুক্তির এ রকম অসাধারণ সব কর্মসূচি সোভিয়েত সরকার গ্রহণ করে যা আগে কখনও দেখেনি বিশ্ব। সোভিয়েত ইউনিয়নই প্রথমবারের মতো বলশেভিক নেতা আলেকজান্দ্রা কোলনতাইকে মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেয়। আর নারী-সহায়ক সোভিয়েত নীতির কারণে ২৬ বছরেই ভ্যালেন্তিনা তেরেসকোভা বিশ্বে প্রথম নারী মহাকাশযাত্রী হিসেবে মহাশূণ্যে পাড়ি জমাতে পারেন। তবে বিপ্লবের বিপর্যয়ের পর রাশিয়ার নারীদের এগিয়ে যাবার যাবার পথ্ও রুদ্ধ হয়ে যায়।

বিশ্বে আজ লাল ফৌজ নেই। নেই কাস্তে হাতুড়ির উড়ন্ত লাল নিশান। লেনিনের মৃত্যুর পর স্ট্যালিনের শাসনকালে নেওয়া বেশ কিছু অনিচ্ছাকৃত ভুলসহ নানাবিধ কারণে এবং বিশেষত তাঁর মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভের ক্ষমতা গ্রহণের মধ্য দিয়ে সোভিয়েত ই্উনিয়নে পুঁজিবাদের পথগামীদের অনুপ্রবেশ ঘটে। সোভিয়েত পরিণত হয় সামাজিক সাম্রাজ্যবাদে। পরবর্তীতে ১৯৯১ সালে গর্বা চেভের সময় আনুষ্ঠানিকভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যায়।

অক্টোবর বিপ্লব ও এর বিপর্যয় নিয়ে অনেক তর্ক, সমালোচনা আজও চলমান। হয়ত সেসব চলবে আরও বহু বছর। সোভিয়েতের পতন থেকে শিক্ষা নেবার, শ্রমিক শ্রেণির একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য এসব আলোচনা জরুরিও বটে। তবে আজকের দুনিয়ায় যখন পুঁজিবাদের নগ্ন আগ্রাসন কোটি কোটি মানুষকে যে দেশছাড়া করছে, নারীনিপীড়ন বাড়িয়ে তুলেছে, শ্রমিকের মজুরির বৈষম্য সৃষ্টি করে চলেছে, জঙ্গিবাদ লালন করছে, বিশ্বজুড়ে রেসিজম-ফ্যসিজমে মদদ দিচ্ছে, অস্ত্র ও মাদক ব্যবসায় পসার জমিয়েছে, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতে হস্থক্ষেপ বাড়িয়ে তুলেছে, প্রাণ-প্রকৃতি ধ্বংস করে দিচ্ছে তখন পুঁজিবাদে আর কেই-বা আস্থা রাখবে?

বিশ্বের সকল নিপীড়িত জাতি ও জনগণ তাই আজ আবারও দুনিয়ার আকাশে লাল ঝাণ্ডা ওড়াবার স্বপ্নই দেখতে চাইবে।