লোকসঙ্গীতের সাতরঙ (পর্ব- ০১)

লোরক
Published : 23 Sept 2011, 10:26 AM
Updated : 23 Sept 2011, 10:26 AM

গম্ভীরা (Gomvira): চাপাইনবাবগঞ্জ জেলায় প্রচলিত একশ্রেনীর লোকসঙ্গীতের নাম 'গম্ভীরা'। ডঃ প্রদ্যোৎ ঘোষ গম্ভীরা শব্দের ব্যুৎপত্তিগত যে অর্থ করেছেন তা হল -শিবের মন্দির, গাজন ঘর, গাজন উৎসব। সনাতন ধর্মালম্বীদের অন্যতম পূজ্য দেবতা শিব। শিবের এক নাম, 'গম্ভীর'। কাজেই এককালে শিবের উৎসবে শিবের বন্দনা করে যে গান গাওয়া হত- সেই গানের নামই কালক্রমে হয়ে যায়; 'গম্ভীরা'। শিব> গম্ভীর> গম্ভীরা।

মধ্যযুগীয় সনাতন বিশ্বাসে শিবকে সুখ দুঃখের নির্বিকার প্রতীক হিসেবে মনে করা হত। গানের সুরে সুরে দেবদেবীকে সম্বোধন করে বলা হতে থাকে গ্রামীণ দারিদ্রক্লিষ্ট মানুষের সুখ-দুঃখ। কখনও কখনও সারা বছরের প্রধান প্রধান ঘটনা এ গানের মাধ্যমে আলোচিত হত। পালা-গম্ভীরায় অভিনয়ের মাধ্যমে এক একটা সমস্য তুলে ধরা হত। চৈত্র-সংক্রান্তিতে বছরের সালতামামি উপলক্ষে পালা-গম্ভীরা পরিবেশন করা হত। এসবই ৪৭ এর দেশ বিভাগ-পূর্ব সময়ের কথা।

এই কথা বলার কারণ আছে।
গম্ভীরা গানের উৎপত্তি পশ্চিমবঙ্গের মালদহ জেলায়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব পাকিস্থানের রাজশাহী ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ অঞ্চলে গম্ভীরা টিকে রইল। তারপর থেকে গম্ভীরা গানের পৃষ্ঠপোষক হয় মুসলিম সমাজ। ফলত, গানের আঙ্গিক ও বিষয়বস্তুর পরিবর্তন হয়ে ওঠে অনিবার্য। যেমন -আগে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের অস্তিত্ব কল্পনা করা হত। বর্তমানে গম্ভীরা গানের আসরে শিবের পরিবর্তে 'নানা-নাতি'র ভূমিকায় দুজন অভিনয় করে। কাজেই, গানটা সর্ম্পূনতঃ মর্ত্তের মানুষের হয়ে গেল। দেবতারা সব তফাতে গেলেন। যাগ গে। নানার মুখে পাকা দাঁড়ি, মাথায় মাথাল,পরনে লুঙ্গি; হাতে লাঠি। আর নাতির পোশাক ছেঁড়া গেঞ্জি, কোমরে গামছা ইত্যাদি। একেবারে তৃণমূল পর্যায়ের ছবি। 'নানা-নাতি'র সংলাপ ও গানের মধ্য দিয়ে দ্বৈতভাবে গম্ভীরা গান পরিবেশিত হয়। এভাবেই দেশবিভাগের পর থেকেই রাজশাহী নবাবগঞ্জ ও নওগাঁ অঞ্চলে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে গম্ভীরা।

বাংলার লোকসঙ্গীতের মধ্যে গম্ভীরাই সবচে বেশি জনমানুষসংশ্লিষ্ট গান। কেননা, গানে গ্রামীণজীবনের সমস্যা তুলে ধরা হয় ও সমাধানও বলে দেওয়া হয়। আঞ্চলিক ভাষায় রচিত সংলাপ ও গানের মাধ্যমে কোনও একটা বিষয় তুলে ধরা হয়। গানের একটি ধুয়া থাকে; সংলাপের ফাঁকে ফাঁকে গানগুলি ধুয়ার সুরে গীত হয়। গম্ভীরা গানে প্রধানত গ্রামীণসমাজের নানা দোষ-ক্রটি উঠে আসে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের কুতুবুল আলম, রকিবউদ্দীন, বীরেন ঘোষ, মাহবুবুল আলম প্রমূখ গম্ভীরা গানের বিশিষ্ট শিল্পী। এঁরা গম্ভীরাকে বাংলাদেশে জনপ্রিয় করে তুলেছে।

গম্ভীরা গানে প্রথমে বন্দনা করা হয়। আগে শিবের বন্দনা করা হত তবে বর্তমানে বন্দনা যুগোপযোগী বিষয়ভিত্তিক। যেমন

' কাদবি কতকাল, মা তোর কি জঞ্জাল।।
মাগো তোর অর্ডারে যুদ্ধ হলো
কত রক্ত দিয়ে স্বাধীন হল
কত সেনা আইলো গ্যালো
মোরা হইনু শুধু নাজেহাল।।'

বন্দনার পরে গম্ভীরা গান শুরু হয়। নানা-নাতি ছাড়াও গম্ভীরা গানে থাকে
১) দোহার ছয় সাত জন,
২) হারমোনিয়াম বাদক একজন,
৩) তবলা বাদক একজন,
৪) জুড়ি বাদক একজন।

একটি সুখবর দেই দেরীতে হলেও গতবছর গম্ভীরা গান চর্চা ও রক্ষার জন্য চাঁপাইনবাবগঞ্জে 'গম্ভীরা একাডেমী'র ভিত্তিপ্রস্থর স্থাপন করা হয়।
আমাদের ফেইসবুক পেইজ :