সেলিনা হোসেন: কত আপনজন

বিভুরঞ্জন সরকারবিভুরঞ্জন সরকার
Published : 23 Feb 2012, 01:47 PM
Updated : 14 June 2022, 02:51 PM

আমাদের অনেকের অত্যন্ত প্রিয় মানুষ কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেনের জন্মদিন ১৪ জুন। ১৯৪৭ সালের এই দিনে তার জন্ম। সে হিসেবে তিনি আমার সাত বছরের বড়। পৈত্রিক নিবাস লক্ষ্মীপুর জেলায় হলেও জন্ম তার রাজশাহীতে। বেড়ে ওঠা, শিক্ষা বগুড়া ও রাজশাহীতে। প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষা বগুড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষা রাজশাহীতে। আমার বেড়ে ওঠাও উত্তরের শেষ মাথা পঞ্চগড়ে। সেলিনা হোসেনের নামের সঙ্গে আমার পরিচয় সেই স্কুল জীবনে, ১৯৬৭-৬৮ সালেই। না, তার নাম আমি লেখক হিসেবে প্রথম শুনিনি। তার নাম আমি যখন শুনেছি তখন লেখক খ্যাতি তিনি অর্জন করেননি। আমি তার নাম শুনেছি ছাত্র আন্দোলনের নেত্রী হিসেবে। সেলিনা আপা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ইউনিয়নের নেত্রী ছিলেন, সম্ভবত বিশ্ববিদ্যালয় কমিটির সহসভাপতি। আমাদের এলাকায় ছাত্র ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে তাকে একবার প্রধান অতিথি হিসেবে নেওয়ার কথা আলোচনা হলেও শেষপর্যন্ত আর সেটা হয়নি। তাই তার নাম তখন শুনলেও চোখে দেখা হয়নি। সেটা হয়েছে আরও বছর দশেক পরে।

তিনি যে প্রগতিশীল রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়েছিলেন তা স্বীকার করেছেন পরবর্তী সময়ে এক সাক্ষাৎকার। বলেছেন: 'তখন সমাজতান্ত্রিক আদর্শে বিশ্বাসী ছিলাম। ভেবেছিলাম এই রাজনীতি মানুষকে ভাত, আশ্র্রয়, শিক্ষা, স্বাস্থ্যের সুব্যবস্থা দেবে। মানুষের জীবন হবে স্বস্তি ও শান্তির। কিন্তু শিক্ষাজীবন শেষে রাজনীতির পাঠ শেষ করে দিই, শুধু লেখালেখির জগৎ ধরে রাখব বলে। রাজনীতির যে আদর্শগত দিক শিক্ষাজীবনে গ্রহণ করেছিলাম তার প্রয়োগ ঘটিয়েছি লেখায়। তবে সরাসরি নয়। সৃষ্টি কাহিনি, চরিত্র, ঘটনা ইত্যাদির মধ্য দিয়ে। মানবিক মূল্যবোধের জায়গা সমুন্নত রেখে। বেঁচে থাকার মাত্রার সমতার বিন্যাস ঘটিয়ে। মানুষের ভালোমন্দের বোধকে রাষ্ট্র সম্পর্কের জায়গায় রেখে আমি রাজনীতির নানা দিকের প্রতিফলন ঘটাতে চাই। সবচেয়ে বড় কথা জনসাধারণের জীবন রাজনীতি বিচ্ছিন্ন নয়। রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত জীবনযাপন করে মানুষ এটাই আমার গভীর বিশ্বাস।'

সাহিত্য সাধনায় ব্রতী হওয়ার পর তিনি তার লেখায় এই বিশ্বাসের জায়গা থেকে দূরে সরে যাননি। লেখকের সামাজিক দায়বদ্ধতার প্রসঙ্গে তিনি মনে করেন, শিল্পের জন্য শিল্প, এটা তো কতকাল আগেই বর্জিত হয়েছে। শিল্পের সামগ্রিক দায়বদ্ধতা সৃজনশীল মানুষের গভীরতম বোধ, তাকে রূপায়িত করা দরকার। কেউ যদি এড়াতে চান, তো এড়াবেন। সেটা তার স্বাধীনতা। তিনি মনে করেন, সমাজের বহুমাত্রিক সংকট সাহিত্যের প্রধান দিক। বাংলাদেশের সাহিত্য এমন নানামুখী ধারায় রচিত হচ্ছে। নবীন-প্রবীণ লেখকরা শিল্পের ভূমিকায় সৃষ্টিশীলতাকে প্রধান করে দেখেন। লেখকরা এই মৌলিক বিবেচনা থেকে দূরে থাকেন না।

কবিতা দিয়ে শুরু করলেও তিনি পরে নিজেকে প্রকাশের মাধ্যম হিসেবে গদ্যকেই বেছে নিয়েছেন এবং গল্প ও উপন্যাসে খ্যাতি ও সুনাম কুড়িয়েছেন। ১৯৬৯ সালে প্রকাশিত হয় তার গল্পগ্রন্থ 'উৎস থেকে নিরন্তর'। তারপর থেকে অব্যাহত বিপুল ও সমৃদ্ধ লেখনী দিয়ে তিনি বাংলা সাহিত্যকে পুষ্ট করে চলেছেন। এরই মধ্যে তার ৩৫টি উপন্যাস, ১৩টি গল্পগ্রন্থ এবং ১০টি প্রবন্ধের গ্রন্থ প্রকাশ হয়েছে। এ ছাড়া তার ২২টি শিশুতোষ গ্রন্থ আছে। ১৩টি সম্পাদনা গ্রন্থসহ নারী অধিকারবিষয়ক বেশ কিছু প্রামাণিক ও গবেষণা গ্রন্থ রচনা এবং সম্পাদনা করেছেন, যা তার সমাজ-মনস্কতা ও ভাবনা বৈচিত্র্যকেই ফুটিয়ে তোলে।

বাংলা কথাসাহিত্যে সেলিনা হোসেন প্রকৃতভাবে একটি নিজস্ব পরিধি কিংবা বলা যায় একটি বৃত্তকাঠামো তৈরি করেছেন নিজ পারঙ্গমতায়। সাহিত্যিক হিসেবে তিনি কখনো নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভুলে যাননি, উপেক্ষা করেননি। তাই আমরা তার রচনায় সামাজিক অঙ্গীকার, পরিবর্তনের দায়বদ্ধতা, প্রগতিশীল মানসিকতা এবং শিল্পের সহনশীলতা, নারীর ব্যক্তিক এবং একই সঙ্গে ব্যক্তিত্বের গভীর স্বাধীনতা উপভোগ করি নান্দনিকতায়। তার শৈল্পিক চেতনায় সবসময় ইতিহাসের দায়বদ্ধতা জড়িয়ে থাকে পুঙ্খানুপুঙ্খ। ইতিহাসের সঙ্গে সময়কে উপভোগ্য করে সাহিত্যিক পথচলার নতুন সড়ক নির্মাণ করেছেন।

চাকরি জীবন শুরু করেছিলেন বাংলা একাডেমিতে ১৯৭০ সালে গবেষণা সহকারী হিসেবে। ১৯৯৭ সালে বাংলা একাডেমির প্রথম নারী পরিচালক হন। ২০০৪ সালে চাকরি থেকে অবসর নিলেও কাজ পাগল মানুষ হিসেবে কাজ থেকে অবসর নেননি। পরবর্তী সময়ে তিনি শিশু একাডেমির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন। এখন আছেন বাংলা একাডেমির চেয়ারম্যান হিসেবে। এছাড়াও একাধিক সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠনের সঙ্গেও সক্রিয়ভাবে জড়িত।

বাংলা একাডেমি পুরস্কার, আলাওল সাহিত্য পুরস্কার, ফিলিপস সাহিত্য পুরস্কারসহ অনেক সম্মাননা পেয়েছেন। পুরস্কার তাকে অহংকারী না করে যেন আরও বিনয়ী করেছে।

তার লেখা একাধিক ভাষায় যেমন অনূদিত হয়ে তার পরিচিতির দিগন্ত বিস্তৃত করেছে, তেমনি তার লেখা অন্তত দুটি উপন্যাসের চলচ্চিত্র রূপ দেওয়ায় তিনি পড়তে না পারা মানুষের কাছেও পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছেন। 'হাঙর নদী গ্রেনেড' এবং 'পোকামাকড়ের ঘরবসতি' নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। যাপিত জীবন, নিরন্তর ঘণ্টাধ্বনিসহ অনেক পাঠকপ্রিয় উপন্যাসের রচয়িতা তিনি। ছিটমহল নিয়ে বাংলা সাহিত্যে তার প্রথম উপন্যাস ভূমি ও কুসুম। সৃষ্টির আনন্দে মেতে আছেন এখনো নিরলসভাবে। নানা বিষয়ে অসংখ্য সম্পাদনা গ্রন্থের সঙ্গে তিনি নিবিড়ভাবে জড়িত ছিলেন, আছেন।

সেলিনা হোসেনের সঙ্গে আমার প্রথম মুখোমুখি পরিচয় গত শতকের সত্তর দশকের শেষ দিকে বাংলা একাডেমিতে তার কক্ষে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবস্থায় আমরা কয়েকজন বন্ধু মিলে 'মুক্তকণ্ঠ' নামে একটি সাহিত্য সাময়িকী প্রকাশ করেছিলাম। ওই সাময়িকীতে লেখা দেওয়ার অনুরোধ নিয়ে সেলিনা আপার কাছে গিয়ে বিমুখ হয়ে ফিরিনি। সেই যে শুরু তারপর আর আমার সঙ্গে সেলিনা আপার যোগাযোগে ছেদ পড়েনি। সাংবাদিকতা জীবনে আমি যেসব পত্রিকায় কাজ করেছি সেসব পত্রিকায় সেলিনা আপা লেখা অথবা সাক্ষাৎকার দিয়েছেন। সেলিনা আপা আর কবি শামসুর রাহমানের বাসা কাছাকাছি হওয়ায় একজনের কাছে গেলে আরেকজনের বাসায় গিয়ে চায়ের কাপে চুমুক না দিয়ে আসিনি।

২০০৬ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত আমি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের প্রকাশনার দায়িত্বে ছিলাম। এই এক দশকে সেলিনা আপার সঙ্গে সরাসরি কাজের অভিজ্ঞতা হয়েছে। আমি যে সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলাম সেই সংগঠন মূলত নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য কমানো তথা নারীর অধিকার ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করত। এই সংগঠন নারীর প্রতি অসম্মানসূচক শব্দ গণমাধ্যমে পরিহার করার লক্ষ্যে কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল। এজন্য জেন্ডার সংবেদনশীল শব্দ কোষ তৈরিরও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। এই কাজটি মূলত সেলিনা আপার নেতৃত্বেই হতো। জেন্ডার বিশ্বকোষ, জেন্ডার ও উন্নয়ন কোষসহ আরও কয়েকটি গবেষণামূলক গ্রন্থ সম্পাদনার গুরু দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত ধৈর্য্য ও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেছেন।

সে সময় বগুড়াসহ আরও দু-একটি জেলায় নারী অধিকার বিষয়ক সম্মেলনে সেলিনা আপার সঙ্গী হয়ে সফরের যে মধুর অভিজ্ঞতা হয়েছে তা কখনো ভুলব না। বগুড়া তার স্মৃতির শহর। সেখানে যাওয়া-আসার পথে তিনি কত টুকরো কথা যে বলেছেন তা আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে অমূল্য সম্পদ হিসেবে গচ্ছিত আছে। মনে পড়ছে, সম্মেলন শেষে বিকেলের দিকে ঢাকা ফেরার পথে রাস্তার পাশে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার অফিস দেখে আমরা একটু যাত্রা বিরতি করেছিলাম। উপজেলা কর্মকর্তা সেলিনা আপাকে তার সামনে দেখে তো অবাক। হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো উৎফুল্ল ও উচ্ছ্বসিত হয়ে তিনি দ্রুততম সময়ে আমাদের যে কতকিছু দিয়ে আপ্যায়িত করেছিলেন আর বারবার আফসোস করছিলেন, কেন একটু আগে জানিয়ে গেলাম না আমরা!

এই ঘটনা থেকেই আমি সেলিনা আপার প্রতি যে কত ধরনের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা তৈরি হয়েছিল, তা বুঝতে পারছিলাম।

ছোটখাটো গড়নের হাসিখুশি এই মানুষটির সান্নিধ্যে যিনি এসেছেন, তিনিই জানেন, মানুষকে আপন করে নেওয়ার কী এক জাদুকরি প্রভাব মিষ্টভাষী সেলিনা আপার মধ্যে সদাসক্রিয়। তিনি যখন কথা বলেন তখন শুনতে ইচ্ছে করে। তার বিনয় তাকে এক আলাদা স্নিগ্ধতা দিয়েছে।

জন্মদিনে সুস্বাস্থ্য ও সৃজনশীল দীর্ঘ জীবন কামনা করি। শুভ জন্মদিন, সেলিনা আপা।