একটি বিদায়ঃ ক্ষণকালের স্তব্ধতা

লুৎফর ফরাজী
Published : 7 July 2011, 06:35 AM
Updated : 7 July 2011, 06:35 AM

নিজ হাতে কাল আমার এক প্রিয়জনকে কবরের ছোট্ট খুপরিতে নামিয়ে দিলাম। আমাকে ‎‎"বাবা" বলে ডাকতেন। তিনি যখন নিস্তব্ধ হয়ে গেলেন। যখন এই ধরাধামের মায়ামমতা ছেড়ে ‎পাড়ি জমালেন অচীন দেশে তখন বাকশক্তি কে যেন রোধ করে দিয়েছিল। চুপ হয়ে দেখলাম ‎আত্মীয়দের মাতম। ক্ষণকাল পর এতদিনের আপন, সুখদুঃখের সাথি মানুষটাকে দূরের জঙ্গলে ‎নির্বাসিত করতে সবাই ব্যতিব্যাস্ত হয়ে পড়ল। যেই গহীন অরণ্যে তিনি গভীর রাতের ‎নির্জনতায় যেতে ভয় পেতেন সাপ-বিচ্ছু আর অজানা সব আতংকে। সেই গহীনতায় আজ তিনি ‎যাত্রি। একাকি থাকবেন সুদীর্ঘ যামিনী, অনন্ত দিন। গোছল দিয়ে সাদা কাপড় পড়িয়ে খাটে ‎চড়িয়ে যখন নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ঐ দূরের জঙ্গলঘেরা ছোট্ট ঘরের দিকে তখন কতনা কথা ‎মানসপটে ভীর করছিল একে একে। জানাজা পড়িয়ে যখন নামানো হচ্ছিল তাকে ছোট্ট গর্তে। ‎সবাই তৎপর ছিল সেসময়। কিন্তু আমি কেন যেন শরীক হতে পারিনি সেই কর্মতৎপরতায়। মূক ‎হয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। নিজ হাতে প্রিয়জনকে মাটি চাপা দিয়ে গর্তে নিমজ্জিত করতে পারছিনা। ‎শুইয়ে দিয়ে যখন বাঁশের কঞ্চি ফিট করা হচ্ছিল কবরের উপরে তখন কেন যেন আমার মনে ‎হচ্ছিল-"ভাই এই চির নিশ্চুপ হওয়া মানুষটিতো দাঁড়াতে পারবেনা, কবর চিড়ে বেড়িয়ে ‎তোমাদের কাছে আর আসবেনা তবে তাকে বাঁশ চাপা দেবার দরকার কি" মাটি যখন চাপিয়ে ‎দিচ্ছিল সবাই তখন আমিও অশ্রুসজল চোখে এগিয়ে গেলাম তিন মুষ্টি মাটি দেয়ার সুন্নত পালন ‎করতে। যাকে ভালবাসি, হৃদয় নিংড়ে যাকে মোহাব্বত করি, যার বাবা বলে ডাক শুনে মনটা ‎অপার স্নিগ্ধতায় ভরে যেত তাকে কবরস্ত করে মাটি চাপা কি দিতে পারলাম শেষ পর্যন্ত?? কি ‎করেছিলাম ঠিক মনে নেই। কিন্তু নিশ্চল আর বোবা হয়েছিলাম তা মনে হয় সত্য। ‎কোদাল দিয়ে যখন মাটি টেনে পা মাড়িয়ে মাটিকে শক্ত করা হচ্ছিল, আমার মন তখন ‎বিষন্নতায় ছেয়ে গিয়ে যেন বলতে চায়-"তিনি আসবেন না, ফিরে আসবেন না, উঠে বসবেন না, এখান ‎থেকে পালিয়ে যাবার ভয়ও নেই তবে তাকে এরকম করে মাটি চাপা আর দিওনা, কাটা দিয়ে ‎তাকে আর আটকাতে হবেনা, চারিদিকে বেড়া দিয়ে আর বন্দি করনা এই নিরিহ মানুষটাকে? ‎ঠিক সেই সময় আকাশ কাঁপিয়ে ঝরে পরল-মেঘের কান্না, আমার চোখের কান্না বৃষ্টির কান্নায় ‎ছেয়ে গেল সব। কবর থেকে>কিয়ামত>হাশর>তারপর জান্নাত কিংবা জাহান্নাম। মহান রাব্বুল ‎আলামীন এই অনন্ত যাত্রায় তুমি তার সহায় হও।

ছলো ছলো আঁখি জলে ভিজিয়ে গেলো,‎
একা একা বন্ধু কোথায় চলো,‎
স্মৃতি ঘেরা মায়াডোর সব ছাড়িয়ে,‎
একা একা কোথা যাও বন্ধু বলো।

কত হাসি কত কথায় জড়ানো স্মৃতি,‎
মনোতটে বাসা বাঁধা সম্প্রীতি,‎
সব ভুলে কিভাবে একা চলো।
একা একা কোথা যাও বন্ধু বলো।

নিশ্চুপ জড়ো হয়ে রইলে ঘুমি,‎
নিদ ভেঙ্গে একবার তাকাও তুমি,‎
নিষ্ঠুর অভিমানি চোখটি খোল।
একা একা কোথা যাও বন্ধু বলো।

মাঠে ঘাটে কত শত বসাতে আসর,‎
হাসি আর গল্পের উঠাতে যে ঝড়,‎
এত সব স্মৃতি তুমি কিভাবে ভুলো,‎
একা একা কোথা যাও বন্ধু বলো।

মাটি চাপা ছোট্ট ঘরের মাঝে,‎
যেওনাকো বন্ধু দোহাই লাগে,‎
দু'য়া করি তবু তুমি থাকো ভালো,‎
একা একা কোথা যাও বন্ধু বলো।