খোশ আমদেদ মাহে রামাযান

লুৎফর ফরাজী
Published : 1 August 2011, 02:39 PM
Updated : 1 August 2011, 02:39 PM

রামাযান মানে কি?‎

রমাযান আরবী শব্দ। আরবী মাস সমূহের মাঝে একটি মাসের নাম। যার আভিধানিক অর্থ ঝলসিয়ে দেয়া, ‎জ্বালিয়ে দেয়া। রামাযানকে রামাযান এজন্য বলা হয়-(ক) সর্ব প্রথম যখন রামাযানে রোযা ফরয হয় তখন ‎প্রচন্ড গরম ছিল তাই এ মাসকে রামাযান বলা হয়। (খ) রামাযান মাসে আল্লাহ তায়ালা তার অবারিত ‎রহমত ও বরকত দিয়ে বান্দার পূর্ব মাসের গোনাহকে পুড়িয়ে ছাই করে দেন, এ হিসেবেও একে রামাযান ‎বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রোযা কাকে বলে?‎

আরবীতে যে শব্দকে সিয়াম বলে বলে তাকেই আমরা বাংলা উর্দু ও ফারসীতে রোযা বলে থাকি। রোযা ‎মৌলিকভাবে তিন যিনিস থেকে নিয়তের সাথে বিরত থাকার নাম। যথা-(ক) সহবাস (খ) খাবার গ্রহণ (ঘ) ‎পানীয় গ্রহণ।

রোযার ইতিহাস

দ্বিতীয় হিজরীতে মদীনায় থাকা অবস্থায় আল্লাহ তায়ালা আয়াত নাজিল করার মাধ্যমে রোযাকে ফরয ‎করেন মুসলমানদের উপর। মহান রাব্বুল আলামীন পবিত্র কুরআনে সূরায়ে বাক্বারার ১৮৩ নং আয়াতে ‎ইরশাদ করেন-‎‏ يَا أَيُّهَا الَّذِينَ آمَنُوا كُتِبَ عَلَيْكُمُ الصِّيَامُ كَمَا كُتِبَ عَلَى الَّذِينَ مِنْ قَبْلِكُمْ لَعَلَّكُمْ تَتَّقُونَ‎ অর্থাৎ হে ‎মুমিনরা! আমি তোমাদের উপর রোযাকে ফরয করেছি যেমন ফরয করা হয়েছিল পূর্ববর্তীদের উপর যেন ‎তোমরা পরহেযগার হতে পার।(সূরা বাক্বারা-১৮৩) এই আয়াতের মাধ্যমে একথা স্পষ্ট বুঝা যায়, ‎উম্মাতে মুহাম্মদীর পূর্বে অন্য নবীর উম্মাতের উপরও রোযা ফরয ছিল। যেমন বিভিন্ন তাফসীর গ্রন্থে যে ‎বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে তার সারাংশ হচ্ছে-কারো কারো মতে পূর্বের সকল উম্মতের উপরই তা ‎ফরয ছিল কারো কারো মতে কিছু কিছু উম্মতের উপর। তবে এ ব্যাপারে প্রায় সবাই একমত যে, ‎খৃষ্টানদের উপর রামাযানের রোযা ফরয ছিল উম্মাতে মুহাম্মদীর মত। খৃষ্টানদের ক্ষেত্রে বিধান ছিল ‎রামাযানের রাতে ঘুমানোর পর থেকে পরদিনের সূর্য অস্তমিত হওয়া পর্যন্ত পানাহার ও স্ত্রী সহবাস করতে ‎পারবেনা। এ বিষয়টি তাদের কাছে কঠিন মনে হলে শীত ও গ্রীষ্মকালে তারা মনমত রোযার সংখ্যা পাল্টে ‎নিত। অর্থাৎ যে সময়ের রমাযান মাস কষ্টদায়ক হত সে সময় তারা রোযা ১০ টা রাখতো পরের বছর ২০ ‎টি অতিরিক্ত রেখে রোযা ৫০টি রাখত। রোযার ফরয হবার পরও খৃষ্টানদের উপর আপতিত বিধান অনুযায়ী ‎মুসলমানরা রোযা রাখতে শুরু করেন। অর্থাৎ রামাযানের রাতে ঘুমানোর পর থেকেই রোযা শুরু হয়ে ‎যায়। ঘুম থেকে জেগে কোন কিছু পানাহার করা ও স্ত্রী সহবাস করতে পারবেনা। পরবর্তীতে আবু কায়েস ‎বিন সারমা রাঃ সহ কিছু সাহাবী আবেদন করলে আল্লাহ তায়ালা সহজতার আয়াত নাজিল করে জানিয়ে ‎দিলেন সুবহে সাদিকের আগ পর্যন্ত রোযা নেই। পর থেকে রোযা শুরু। (তাফসীরে তাবারী-৩/৪০৯) ‎

খোদাভীরু হবার মাস মাহে রামাযান

আল্লাহ তায়ালা বলেছেন আমি তোমাদের উপর রোযা ফরয করেছি যেন তোমরা মুত্তাকী তথা খোদাভীরু ‎হতে পার। রোযার মাধ্যমে একজন বান্দা খোদাভীরু এভাবে হয় যে, একাকি চুপটি ঘরে রোযাদার যখন ‎থাকে তখন সে ইচ্ছে করলেই পানাহার করতে পারে কিন্তু সে এ থেকে কেবল বিরত থাকে আল্লাহর ‎আদেশ অমান্য হয়ে যাবার ভয়ে, একাজটি সে করে থাকে শুধু আল্লাহর ভয়ে, কারণ সেখানেতো কোন ‎মানুষ তাকে দেখছেনা। সুতরাং রোযা রাখাটাই খোদাভীরুতার একটি পরিচায়ক। সুতরাং রামাযানে এই ‎প্রশিক্ষণ নিয়ে অন্য সময়ে যেন বান্দা কোন গোনাহ করতে আল্লাহ দেখছেন এই ভয়ে বিরত থাকে এর ‎একটি প্রশিক্ষণও এই রামাযান। এজন্যই আল্লাহ বলেছেন তোমরা মুত্তকী হবার জন্য আমি রোযাকে ফরয ‎করেছি।

রামাযানের ফযীলত

عن أبي هريرة : قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم إذا كان أول ليلة من شهر رمضان صفدت الشياطين ومردة الجن ‏وغلقت أبواب النار فلم يفتح منها باب وفتحت أبواب الجنة فلم يغلق منها باب وينادي مناد يا باغي الخير أقبل ويا باغي ‏الشر أقصر ولله عتقاء من النار وذلك كل ليلة قال وفي الباب عن عبد الرحمن بن عوف و ابن مسعود و سلمان ‏
قال الشيخ الألباني : صحيح ‏
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ বলেছেন-যখন রামাযানের প্রথম রাত আসে ‎তখন শয়তান ও জীনদের পায়ে বেড়ি পড়ানো হয়। এবং জাহান্নামের দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়, তাই ‎জাহান্নামের কোন দরজা খোলা থাকেনা, ও জান্নাতের দরজা খুলে দেয়া হয়, এমনকি জান্নাতের কোন ‎দরজা বন্ধ থাকেনা। আর একজন আহবানকারী ডাকতে থাকে-হে কল্যাণ প্রার্থী! এগিয়ে এসো! আর ‎মন্দতাপ্রার্থী! তুমি ফিরে যাও! আর আল্লাহ তায়ালার পক্ষ থেকে অনেক গোনাহগারকে জাহান্নাম থেকে ‎মুক্তি দেয়া হয়।(অর্থাৎ তার ক্ষমার সীদ্ধান্ত গৃহিত হয়।) (তিরমিজি শরীফ-রামাযান অধ্যায়)‎
عن أبي هريرة : قال قال رسول الله صلى الله عليه و سلم من صام رمضان وقامه إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ومن ‏قام ليلة القدر إيمانا واحتسابا غفر له ما تقدم من ذنبه ‏
অনুবাদ-হযরত আবু হুরায়রা রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-যে ব্যাক্তি ঈমানের সাথে ও ‎পূণ্যের আশায় রামাযানের রোযা রাখে আর ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় শুয়ার পূর্বে নফল(তারাবীহ) ‎পড়ে তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। আর ঈমানের সাথে পূণ্যের আশায় শবে কদরে নফল ‎পড়ে তার পূর্বের সকল গোনাহ মাফ করে দেয়া হয়। (তিরমিজী শরীফ-রামাযান অধ্যায়)‎

সেহরীর ফযীলত

أنس بن مالك رضي الله عنه قال : قال النبي صلى الله عليه و سلم ( تسحروا فإن في السحور بركة ) ‏
অনুবাদ-হযরত আনাস রাঃ থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-তোমরা সেহরী খাও কেননা সেহরীতে ‎বরকত নিহিত। (বুখারী শরীফ-২/৬৭৮)‎
عن عمرو بن العاص أن رسول الله -صلى الله عليه وسلم- قال فصل ما بين صيامنا وصيام أهل الكتاب أكلة السحر
অনুবাদ-হযরত আমর বিন আস থেকে বর্ণিত রাসূল সাঃ ইরশাদ করেন-আমাদের ও আহলে কিতাবীদের ‎মাঝে রোযার মাঝে পার্থক্য নির্ণায়ক হল সেহরী খাওয়া। (মুসলিম শরীফ-৩/১৩০)‎

বান্দাদের পূণ্য আর গোনাহমুক্তির ক্ষেত্রে বোনাসময় মাস

গোনাহগার বান্দাদের গোনাহ মাফের ব্যাপকতার জন্য এ মাস এক বিশাল সুযোগের মাস। রামাযানের ‎শুরু থেকেই গোনাহ মাফের যে অফার শুরু হয় তা থাকে ঈদের চাঁদ উঠা পর্যন্ত। একবার কোন ইবাদাত ‎করলে অন্য মাসে ৭০ বার সে ইবাদাত করার সোয়াব পাবার নিশ্চয়তা। সুবহানাল্লাহ! মহান আল্লাহর ‎অবারিত মাগফিরাত আর বরকতপূর্ণ এ মাস। এ মাসে যেন আল্লাহ তায়ালা ক্ষমা আর বরকতের ঝাঁপি ‎খুলে দিয়েছেন। ‎
من تقرب فيه بخصلة من الخير كان كمن أدى فريضة فيما سواه و من أدى فيه فريضة كان كمن أدى سبعين فريضة فيما سواه ‏‎ ‎
অনুবাদ-সালমান রাঃ থেকে বর্ণিত একদা নবীজী সাঃ খুতবায় বলেন-যে ব্যক্তি এ মাসে (নফল) নেক ‎আমলের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জন করবে, সে ঐ ব্যক্তির ন্যায় হবে যে রামাযান ছাড়া অন্য সময় ‎একটি ফরয আদায় করল, আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করবে সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ‎ফরয আদায় করল। (সহীহ ইবনে খুজাইমা-৩/১৯১)‎

আহবান

প্রিয় পাঠক/পাঠিকারা! আসুন রহমত বরকত মাগফিরাতে পূর্ণ এই পবিত্র মাসটি আমরা এবার অন্য সময়ের ‎তুলনায় পবিত্র ও সুন্দর করে পালন করি। তারাবিহ-তাহাজ্জুদ, সেহরী-ইফতার, জিকির-তাসবীহ, প্রথম ‎ওয়াক্তে-জামাতে নামায পড়া ইত্যাদীর মাধ্যমে এ রামাযানটি পালন করি পূর্ণাঙ্গ আনুগত্বের সাথে। সাথে ‎সাথে সকল প্রকার গোনাহ ও অশ্লীলতা থেকে মুক্ত থাকি দৃঢ়তার সাথে। আল্লাহ তায়ালা আমাদের এ ‎পবিত্র মাসে ইবাদত করে তার প্রিয় বান্দা হবার তৌফিক দান করুন। সাথে সাথে যারা এ মাসে নিজের ‎গোনাহকে মাফ করাতে না পারে তাদের ক্ষেত্রে হযরত জিবরাঈল আঃ যে অভিশাপ করেছেন যে ব্যক্তি এ ‎মাসে গোনাহ মাফ করাতে না পারে সে ব্যক্তি সবচে দূর্ভাগা নবীজী সাঃ যে বদদুআর প্রদুত্তরে ‎বলেছেন আমীন, সেই মকবুল বদ দুআকৃত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত না হতে আল্লাহ তায়ালা আমাদের হিফাযত ‎করুন। আমীন।