মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে

মহানীল বঙ্গোপাধ্যয়
Published : 8 July 2017, 06:04 AM
Updated : 8 July 2017, 06:04 AM

বাংলা সাহিত্যে সর্বকালেই আধুনিক কবি, আমার মতে বাংলা সাহিত্য ও জীবনধারার প্রথম প্রথাবিরোধী ব্যক্তিত্ব ও সাহিত্যিক- মাইকেল মধুসূদন দত্ত। তৎকালীন বাংলা বিনোদন সাহিত্য-বিনোদনে নাটকের ধারণাও তখন তৈরী হয়নি। বিদেশী নাটকের অনুবাদ ও অনুকরণ করে সেইমত অঙ্গ ও মঞ্চসজ্জা করে, নাটকের মহড়া ও মঞ্চায়ন হতে শুরু হয়েছেমাত্র। নাটক নিয়ে জমিদার পরিবারেরা নিজেদের লোকদেখানো স্থূলতায় বিরক্ত হয়েই লিখলেন প্রথম সার্থক নাটক- 'শর্মিষ্ঠা'।তারপর, কৃষ্ণকুমারী বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক ট্রাজেডি।বাংলা সাহিত্যর শ্রেষ্ঠতম কবি মাইকেল মধুসূদন দত্ত, 'শর্মিষ্ঠা'র প্রস্তাবনায় লিখেছেন- 'অলীক কুনাট্য রঙে, মজে লোক রাঢ়ে বঙ্গে, নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়'।প্রাণে সয়নি বলে আরো লিখলেন, 'একেই কি বলে সভ্যতা', 'বুড়ো শালিকের ঘাড়ে রো', 'মেঘনাদবদকাব্য' 'পদ্মাবতী' ইত্যাদি, যা এখনও বাঙালি জাতি পড়ে শেষ করেনি।

এত সাহিত্য করার উদ্দেশ্য হল- ১৮৫৮ সালে প্রকাশিত 'শর্মিষ্ঠা'র শুরুতে যা লিখলেন তা ২০১৭ সালেও সমসাময়িক। এখনও আমরা অলীক, কুনাট্যতে, চমক ও আষাঢ়ে গল্পে মজে আছি ও মজে যাই। কবি মধুসূদন দত্তকে না চিনলেও হিরো আলমকে সবাই চিনি। প্রজ্ঞা-প্রগাঢ়তা-প্রগতিশীলতা'র বদলে প্রতারণা-প্রগলভতা-স্থুলতা'র রীতিই প্রচলিত হয়েছে। যেমন, ডিজিটাল বাংলাদেশে মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম এর একটি সরকারী প্রকল্প ইতোমধ্যে বাস্তবায়িত হয়েছে।নির্বাচিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ল্যাপটপ, কম্পউটার, প্রজেক্টর ইত্যাদি সরবরাহ সম্পন্ন হয়ে থাকলেও, আমার জানামতে, সিলেট বিভাগে দু-তিনটির বেশী প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক-শিক্ষার্থী 'মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম' কি জিনিস জানে না। দ্বিতীয়ত, শীতের মৌসুমে সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকায় হাইজি-বাম্পার ও যাত্রা প্রদর্শনীর আসর বসে। এখানে আসলে কিসের আয়োজন তা সচেতন ব্যক্তিমাত্রই জানেন। তবুও, এক কথায় বললে, পৃথিবীর সব অবৈধ ও বখাটেপনা এখানে শুধু বৈধ নয়, আদরণীয়ও। হবিগঞ্জ জেলার নবীগঞ্জবাসী এসব নগ্ন যাত্রাপালার আয়োজন উচ্ছেদের দাবীতে সোচ্চার হয়ে ওঠেছিলেন। কথিত যে, স্থানীয় একজন মন্ত্রীর হস্তক্ষেপে হাউজি-বাম্পার উচ্ছেদ আন্দোলন বাতিল হয়। পাশাপাশি, বাম্পার চালুর অনুমতি প্রদান করেন।উল্লেখ্য যে, দূরদূরান্তের আগ্রহী বাম্পারীদের জন্য বিনামূল্যের পরিবহন সেবাও আছে।এমতাবস্থায়, সিলেট বিভাগে শতাধিক সংবাদপত্র ও সহস্রাধিক লেখক-সাংবাদিক থাকা সত্বেও মাদক-জুয়া-অশ্লীল যাত্রাপালা'র বিরুদ্ধে জোরালো প্রতিবাদ ও এসব বন্ধ করার জন্য এগিয়ে আসেননি।কারণ, দেশের হাজার-লক্ষ লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিক, আইনজীবী, সমাজসেবী থাকলেও মাইকেল মধুসূদন কিংবা অন্য কোন শ্রেষ্ঠকবির লেখা পড়ে শেষ করিনি। প্রতিদিন দেশের কোন না কোন কবি, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, লেখক, শিল্পীর হাতে শ্রেষ্ঠত্বের পুরস্কার তুলে দেয়া হয়। এমনকি পুরস্কার বঞ্চিত কোন এক কবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট খোলাচিঠি লিখে একটি গুরুত্বপূর্ন পদক বাগিয়ে নেন। কিন্তু, স্বাধীনতার আধাশতাব্দী পরও আমরা কোন রাষ্ট্রনীতি নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন করতে পারিনি, জাতির উন্নতি ও পরিচয়ের মূলস্তম্ভ- শিক্ষা'র কোন ভিত রচনা করতে পারিনি।বরং, মেডিকেল কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষার, বিসিএসসহ নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাস হওয়া সহস্রাব্দের শুরু থেকে আমাদের শিক্ষা-সংস্কৃতি হয়ে দাড়িয়েছে। পিএসসি, জেএসসি, এসএসসি, এইচএসসিসহ সকল পরীক্ষার প্রশ্নপত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আদান-প্রদান করা সহজ হয়ে ওঠেছে।অন্যদিকে, প্রি-প্রাইমারি হতে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন দেশের অপরাপর দপ্তর, বা অপরাপর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের মত চলছে।ভর্তি-ফিস-প্রবেশপত্র-পরীক্ষা-ফিস-কোচিং-ফিস-সনদ-ফিস চক্রে ঘুরপাক খাচ্ছে। তাই, স্বাভাবিকভাবেই এগুলো জাতির পতনের সূচক।

এ বছর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের 'গ' ইউনিট বা বাণিজ্য অনুষদের ভর্তি পরীক্ষায় অভিনব এবং ব্যাপক দুর্নীতি সংঘটিত হয়েছে।প্রথমবার নেয়া পরীক্ষা বাতিল করা হলেও পুনরায় পরীক্ষার বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।তবে, বাতিল হওয়া পরীক্ষার পূন:পরীক্ষায় প্রথমবারের চেয়েও অভিনব পন্থায় দুর্নীতির আশ্রয় নেয়া হয়েছে তা বিশ্ববিদ্যালয়-সংশ্লিষ্ট সকলের জানা।প্রথমবার, অবৈধভাবে ভর্তির জন্য চুক্তিবদ্ধরা জানতে পারেন যে, প্রশ্নপত্রের চারটি সম্ভাব্য উত্তরের মধ্যে সঠিক উত্তরের ঘরটি একটু ঝাপসা থাকবে। অর্থাৎ, ২০১৭ সালের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের 'সি' বা 'গ' বা 'বাণিজ্য' ইউনিটকে 'ঝাপসা ইউনিট' নামে নামকরণ করা হয়।

উল্লেখ্য, বাতিল হওয়া পরীক্ষা অনুষ্ঠানে নেয়া হয় এক ঐতিহাসিক উদ্যোগ। বিশ্ববিদ্যালয় ঘোষিত পুন:পরীক্ষার দিন বাংলাদেশ ছাত্রসংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হরতাল আহবান করে।এ অবস্থায় সকল ক্লাস-পরীক্ষা স্থগিত ঘোষণা করা হয়।কিন্তু, ওইদিনের 'গ' ইউনিটের ভর্তির পূন:পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে কি না, তা জানানো হয়নি।কিন্তু অনেকটা গোপনীয়তা ও রাখঢাক করে পরীক্ষা নেয়া হয়েছে, যারা চুক্তিবদ্ধ তাদের। এবার হয়েছে ঝাপসা সাংবিধানিক দুর্নীতি।নি:সন্দেহ যে, এক্ষেত্রে জাতির দৃষ্টিকে ঝাপসা করে দিয়ে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানো হল শিক্ষা, সম্মান ও পরীক্ষানীতিকে।

তাই একটিমাত্র দৃষ্টান্ত চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে জাতীয় সমস্যা হিসাবে ধরে নিলে জাতীয় পতনের শ্রেষ্ঠ নমুনা বলতেই হয়। হয়ত, বাংলাদেশের চলমান সামাজিক অবস্থায় এটি একটি নমুনা হয়েই থাকল। আমরা নতুন কিছুর দিকে দৃষ্টি দিলাম। প্রতিদিন একটার পর একটা চমক আসছে আর যাচ্ছে।

একদা দিনাজপুরে পুলিশ কর্তৃক ইয়াসমীনকে হত্যাপূর্বক ধর্ষণ, নিরাপত্তা হেফাজতে সীমা চৌধুরী, রাঙ্গামাটিতে সেনাবাহিনী কর্তৃক কল্পনা চাকমা। সম্প্রতি, কুমিল্লা সেনানীবাসে তনু হত্যা, রিশা হত্যাসহ শতশত হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটে গেছে আমরা এর ধারাবাহিকতা বন্ধ করতে পারিনি। কারণ, আমরা একটি ঘটনারও নিস্পত্তি দেখিনি, দাবিও তুলিনি। অতিশয় মারাত্মক কিছু হলে আমরা কিছুদিন মিছিলসভা, স্মারকলিপি করি, পত্রিকায় কলাম-প্রবন্ধ ছাপা হয়। কোন কোন আন্দোলনে দেশের প্রধান শিক্ষাবিদ বা বুদ্ধিজীবী একাত্মতা প্রকাশ করেন, সাত-দশ-একশ জনের যৌথস্বাক্ষরে প্রতিবাদপত্র প্রকাশিত হয়। কিন্তু এর শেষ দেখেন না।

এরই মাঝে আরেকটা ছাত্রী হত্যা-ধর্ষণের শিকার হয়। আমরা, অজ্ঞ-বিজ্ঞ, অশিক্ষিত, অলস ও অকর্মণ্য নির্বিশেষে, পরেরদিন আবার, হালকা কিংবা স্থুল, চোখ ধাধানো ঘটনা ও অবিশ্বাস্য খবরে চমকে উঠি, সারাদিন আলোচনায় ক্ষোভ-বিক্ষোভ প্রকাশ করি।মজে থাকি নতুনটি নিয়ে। তবে কি মাইকেল মধুসূদন দত্ত'র বাণী'র অন্যথা হবে না?