জাবি ছাত্রের মৃত্যু: ক্যাম্পাসে শোকের মাতম

আসিফ মাহবুব
Published : 26 May 2016, 06:06 PM
Updated : 26 May 2016, 06:06 PM

একটি উদিয়মান স্বপ্নকে হারালো জাতি। তার মধ্যে ছিল আলাদা উদ্যম। প্রতিটি কাজে সে ছিল সক্রিয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পরেই সে আমাদের সাথে যুক্ত হয়। তাকে কোন প্রোগ্রামে আসতে জোড় দিয়ে বলতে হতো না। তার মৃত্যুতে আমরা এতটাই শোকাহত আমাদের শোক জানানোর ভাষা নেই। এভাবেই বলছিলেন জিসানের দীর্ঘ দিনের রাজনীতির সহযোদ্ধা জাবি সংসদ ছাত্রইউনিয়নের সভাপতি দীপাঞ্জন সিদ্ধান্ত কাজল। এছাড়াও ফেসবুকে তার বন্ধু, সহপাঠী, বড়ভাই, ছোট ভাইদের কিছু আবেগ জড়িত পোস্ট তুলে ধরা হলো।

আব্দুল কাইয়ুম বিপুল: বুঝলাম না হৃদয়ের কোষগুলো শুঁকিয়া গেলো নাকি ? ছেলেটার সাথে কথা খুব কমই হয়েছে কিন্তু আমি চিন্তা করছি ওর পিতা মাতার কথা কিভাবে সইবেন এই ভার? আমি হইত আজকের পর কোন দিন তোমার কথা মনে করব না। ভাগ্য মেনে নেয়া ভালো নাকি না মেনে উপাই নেই। আল্লাহতালা তোকে জান্নাতবাসী করুক,, আমিন।

সৌমিত জয়দ্বীপ: জিসান ছাত্র ইউনিয়ন করত। ছবি তুলত। পাগলামি করত। বড়দের কাছে এটা-ওটা আবদার করত। অমিত প্রতিভাবান ছেলে জিসান। এই তো গত শনিবার (২২ মে) সরাসরি পরিচয়। মাত্র এক ঘন্টার আড্ডায় আমি বোঝার চেষ্টা করেছিলাম ওকে। বড়ই জটিল ছেলে। জটিল ছিল ওকে কথায় হারানো। শুধু প্রশ্ন করছিল। ওর এক প্রশ্নের জবাবে বলেছিলাম, 'এই প্রশ্নটার উত্তর তুমি দিবা। যেদিন উত্তর তৈরি হবে, সেদিন ঢাকায় এসো, আড্ডা হবে খুব।' সলিল সমাধির শিকার হয়ে চিরতরে চলে গেল সেই জিসান! মৃত্যুর কাছে হেরে গেল ২২ বছরের টগবগে এক তরুণ। মৃত্যু ওকে হারিয়ে দিল। কত কথা! সব গুলিয়ে যাচ্ছে রে পাগলা! ওর কথাগুলো কানে বাজছে। মুখটা ভাসছে। সেই মুখটাই যদি ডুবে না গিয়ে ভেসে থাকত জলে! ও সাঁতার জানত। তবুও সামান্য একটা পুকুরের জলে তলিয়ে গেল! তলিয়ে যাওয়ার আগে জিসান আমাদের শিক্ষা দিয়ে গেল– 'অতি আত্মবিশ্বাস' ও 'সক্ষমতা' কখনও কখনও আমাদের পরাজয়ের কারণ হয়ে দাঁড়ায়! একদিন নিশ্চয়ই আড্ডা হবে রে জিসান! ফেসবুকের বন্ধু তালিকায় আরও একটা 'ডেড আইডি' যুক্ত হলো!

জোবায়ের টিপু : খাগড়াছড়ির চেঙ্গী নদীর ব্রীজ থেকে বৈসাবী উৎসব দেখছিলাম। পিছনে ফিরে দেখি কিছুটা দূরে একটা ছেলে আদিবাসী বাচ্চাদের ছবি তুলছে। ডাক দিলাম…আরে জিসান জামিল নাকি! বলল, আরে ভাই তুমি এখানে? বললাম, ডিপার্টমেন্টের ফিল্ড ওয়ার্কে আসলাম। তুই এখানে কি করিস? ভাই, ঘুরতে আসছি। কথায় কথায় জানতে চাইলাম, যাবি কবে? ভাই, পকেটে এক হাজার টাকা আছে। শেষ না হওয়া পর্যন্ত আছি।
আজ তোর জীবন প্রদীপটা নিভে গেল। শেষ হয়ে গেলো আলো। আমাদেরটা শেষ না হওয়া পর্যন্ত আছি। দেখা হবে। ভালো থাকিস।

শফিকুল ইসলাম: তোর সোজাসাপ্টা কথাগুলো আর শুনবো নারে! যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস।

বিবর্ন তুষার: আজ জাবির বুক থেকে ঝরে গেল এক উজ্জ্বল নক্ষত্র।

সিয়ামুর রহমান সিয়াম: আমরা শোকাহত বন্ধু যেখানেই থাকিস ভালো থাকিস ।

সুমন মন্ডল মনি: " জহির রায়হান চলচ্চিত্র সংসদ" এর কর্মী জিসান জামিলের (৪৩ তম ব্যাচ, প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ) মৃত্যুতে আমরা শোকাহত। তাঁর আত্মার শান্তি কামনা করি।

মাহবুব মুন্সি: প্রথমবার দেখা ভার্সিটি বাসে,কড়া রোদে একটা টুপি পড়ে আছিলি,তোর পাশে বইসা ঢাকা গেছিলাম। তোর লম্বা চুল-দাড়ি দেইখা ভাবছি তুই আমার সিনিয়র। যাক সেসব, ক্যাম্পাস থেকে ঐদিনের মত আর কোনদিন তোর পাশে বইসা ঢাকা যাওয়া হইলো না আর!

বাপ্পি নবি: সেদিন তুই সমাজবিজ্ঞান অনুষদের সামনে একটি আম গাছের দিকে তাকিয়ে কি যেন খুজছিলি । আমি বল্লাম ভাল করে দেখ, একটা ভাল ছবি কিভাবে তোলা যায় ! তুই আমার কথা শুনে মুচকি একটি হাসি দিলি । কিন্তু জানা ছিল না ঐটাই ছিল তোর সাথে শেষ কথা। ৪৩তম আবর্তনের একজন বন্ধুকে এভাবে হারাতে হবে কল্পনাই করিনি । "ভাল থাকিস বন্ধু জিসান।

সোয়াইব রহমান সজীব: লম্বা চুল-দাঁড়ি, সুঠাম দেহ, চোখে গোলাকার চশমার কারণে সহজেই সবার নজরে পড়ত ছেলেটা। বেশিরভাগ সময় পরনে থ্রি কোয়ার্টার, কাধে ক্যামেরার ব্যাগ, হাতে ক্যামেরার ফিতা জড়িয়ে থাকত। দেখতে অনেকটা জলের গানের রাহুল আনন্দের মতো। ক্যাম্পাসে রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিল বলে ওর সাথে প্রতিবাদ-আন্দোলনে বেশি দেখা হত আমার। ব্যাচমেট হলেও ওর সাথে তেমন সম্পর্ক ছিল না। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মসূচির ছবি তুলত, স্লোগানের সাথে বাদ্য বাজাত। ২৫ এপ্রিল ঢাকা- আরিচা মহাসড়ক থেকে অনেকের সাথে ওকেও ধরে নিয়ে গিয়েছিল পুলিশ। পরে আমি থানায় গেলে পুলিশ ওর বেশভূষা নিয়ে ঠাট্টা করছিল। আজ যখন শিক্ষক ক্লাবের পুকুর থেকে ওর নিথর দেহ উঠানো হচ্ছিল তখন প্রতিবাদের দিনগুলোর মুখটার সাথে কিছুতেই মেলানো যাচ্ছিল না। ও যখন এনাম মেডিকেলে তখন ট্রান্সপোর্টে ওর ক্যামেরাটা এতিম হয়ে পড়ে ছিল! কিছুক্ষণ আগেও তো বৃষ্টির ছবি তুলেছিল।
শান্ত-শীতল পুকুর ওমন রাক্ষসী হয়ে উঠবে কে জানতো? আজীবনের ছুটিতে চলে গেল জিসান।
মানতে পারছি না। যেখানেই থাকো, ভালো থেকো জিসান।

তৌহিদ তুষার: পরশু রাতে তিন বন্ধু ক্যাম্পাসে কাঠাল পারতে বের হয়েছিলাম। কাঠাল কেটে টারজানে বসে আড্ডা দিচ্ছি,তখন প্রায় রাত ১টা। দেখি একটা ছেলে একা হাটতে হাটতে পাশ দিয়ে যাচ্ছে, দেখে চিনলাম- জিসান (প্রতœতত্ত্ব ৪৩ ব্যাচ , ঝঝই হল)। বললাম, এত রাতে একা একা কি করিস, বন্ধুবান্ধব কই। ভাই নিজেকে সময় দেই, একা ঘুরতেই ভালো লাগে। আরো কিছুক্ষণ কথা হল। কিচ্ছুক্ষন পর আমরা উঠলাম, ও বসে ছিল। একটু আগে শুনলাম বিকেলে টিচার্স ক্লাবের লেকে ডুবে মারা গেছে । এমন মৃত্যু সংবাদ সবসময়ই কষ্টের। ভালো থাকিস, যেখানেই থাকিস।

মশিউর রহমান: তোর সাথে কোনো কথাই হলো না তেমন করে। দেখতাম আর ভালো লাগতো! তেজী, উদ্যমী, উজ্জ্বল চোখ, যত্নে বড় করে তোলা চুল দাঁড়ি, সবুজ টিশার্টের বুকে লাল সূর্য… সব মিলিয়ে মুগ্ধ হতাম! কখনো বলিনি! কখনো বলবার আর সুযোগও হবে না ভাই! কমরেড!'

আসিফ রিবর্ন: নিজের হাতে জিসান ভাইরে যখন পানি থেকে টেনে তুললাম তখন মুখটা হাসাহাসি! প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের ৪৩ ব্যাচের এই ভাইটির সাথে আমার প্রথম পরিচয় ফার্স্ট ইয়ারের প্রথম দিকে ঠিক রাত ৩ টার দিকে শহীদ মিনারে ; ফাপর খাওয়ার মাধ্যমে! আজ ৩'৩০ টার সময় ভিসির পুকুরে গোসল করতে যাওয়ার সময় হঠাৎ শুনি ভাই ডুবে গেছে! ,
আমরা সবাই খুঁজা শুরু করলাম, হঠাৎ এক ভাইয়ের চিৎকার, মাঝ পুকুর থেকে ভাইয়ের মুখটা উঁচু করে ধরে কতবার বললাম ভাই যেনো বেঁচে যাই ঈশ্বর! কিন্তু ঈশ্বর সে ডাক শুনে নাই; বিধাতা থাকে তো ভদ্রপল্লীতে, আমাদের ডাক শুনার প্রয়োজন নাই তোর রাস্তার জ্যাম পাড়ি দিয়ে যখন এনামে পৌছালাম ততক্ষণে ভাই চলে গেছে পরপারে! আচ্ছা জিসান ভাই কি আর বটতলায় আসবে? বটতলার বেলালের দোকানে কি আর চা খাবে? শহীদ মিনারের ছবি তুলবে? প্রান্তিকের ছাউনিতে বসে কি আর গান গাবে! সেন্ট্রালফিল্ডের বাতাস উপেক্ষা করে ভাই ক্যামনে উপরে থাকবে? আচ্ছা ভাই কি উপর থেকে জাহাঙ্গীরনগরের দিকে তাকিয়ে থেকে সুইমিংপুলে গানের আসরের স্বাদ নিবে! জানিনা কি হবে? তবুও চাই ভাই আরেকটিবারের জন্য বটতলায় আসুক, এক কাপ চা খাক! ভাল থেকো ভাই! আজীবন মনে রাখবো তোমারে!!